বাংলা ছোটগল্পের স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের হাত দিয়ে নানা ধরনের গল্প বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। সেই সব গল্পকে কেন্দ্র করেই অনেক সময় সমালোচনার লক্ষণ ও নীতি নির্ধারণ করা হয়েছে। তাই নিজের লেখা গল্প বা কোনো রচনা সম্বন্ধে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যদি কোনো মন্তব্য করেন তবে তা বিশেষভাবে চিন্তনীয়। এখানে তাঁর যে মন্তব্যটির উল্লেখ করা হয়েছে তাতে ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটিকে তিনি গীতিধর্মী বলে অভিহিত করেছেন। এ মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আলোচনা করতে হলে কয়েকটি বিষয় আগে চিন্তা করা প্রয়োজন।
রবীন্দ্রনাথ কবি। তাঁর প্রতিভা অন্যসমস্ত সত্ত্বাকে ছাড়িয়ে কবি-সত্ত্বাতেই অধিকতর প্রতিভাত। তাই তাঁর রচনার মধ্যে কবিত্বের বিচ্ছুরণ থাকা স্বাভাবিক। তাঁর গদ্য রচনাকেও অনেকে গদ্য কবিতা বলে অভিহিত করে থাকেন। বস্তুত কবির হাত দিয়ে যা নির্গত হয়েছে তা কবিতারই নামান্তর। এই হিসেবে ক্ষুধিত পাষাণ গল্পটির মধ্যে কাব্যগত গুণ থাকা অসম্ভব নয়। কিন্তু কাব্যগুণ যুক্ত গল্প আর গীতিধর্মী গদ্যের মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। যে কোনো গল্প বা উপন্যাস বা যে কোনো গদ্যের বর্ণনাত্মক অংশের মধ্যে যে ধ্বনি ঝংকৃত হয় তা তার কাব্যগুণ বলে অভিহিত করা যেতে পারে। কিন্তু গীতিধর্মীতা আর কাব্যময়তা একবস্তু নয়।
কোনো রচনার মধ্যে গীতিধর্মীতা তখনই আসে যখন তাতে ভাবোচ্ছ্বাসের প্লাবন অনুভূত হয়। কবিতার ক্ষেত্রে যাকে লিরিক বলা হয় তা হল এই ভাবোচ্ছ্বাস। ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক কবির ব্যক্তিত্বের প্রক্ষেপ সেখানে সহজেই এসে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে এই ভাবোচ্ছ্বাস দোষাবহ হলেও এটিই গীতিধর্মীতার প্রাণ। স্রষ্টা ও সৃষ্টি সেখানে একীভূত হয়ে পড়ে। আত্মপ্রক্ষেপের দ্বারা সমস্ত জগৎকে তখন তিনি আবিষ্ট করে দেখেন। এই হল গীতিধর্মীতার মূল কারণ। কিন্তু রচয়িতার আত্মপ্রক্ষেপ রচনার মধ্যে থাকলে তাকে গীতিধর্মী বললেও ভাবোচ্ছ্বাস রচনামাত্রকেই গীতিধর্মী বলা সঙ্গত নয়। কোনো গল্পের মধ্যে যে ভাবোচ্ছ্বাস রচয়িতার ব্যক্তিগত ভাবোচ্ছ্বাস, এবং সেই ভাবোচ্ছ্বাস যদি পাত্রপাত্রীর চরিত্রকে লঙ্ঘন করে যায় তখনই তাকে বলতে পারি গীতিধর্মী গল্প। পাত্রপাত্রীর চরিত্রের সীমানার মধ্যে উত্থিত ভাবোচ্ছ্বাসকে কাব্যধর্মী বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে কিন্তু কোনোমতেই তাকে গীতিধর্মী বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের অনেকগুলি গল্পের মধ্যে ভাবোচ্ছ্বাস লক্ষ করা গেলেও সেই সমস্ত গল্পকে গীতিধর্মী বলা যায় না। গীতিধ রচনা হিসেবে তুলে ধরা যেতে পারে গল্পগুচ্ছের ‘অধ্যাপক’, ‘মণিহারা’ প্রভৃতি গল্পকে কিম্বা ‘ডাকঘর’ নাটককে। কিন্তু আলোচ্য ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটির মধ্যে সেই ভাবোচ্ছ্বাস লক্ষিত হয় না, দ্বিতীয়ত নায়ক সত্ত্বাও লেখকসত্ত্বা এখানে একীভূত হয় নি।
‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটির মধ্যে যে অতীত দিনের স্মৃতি রোমন্বিত হয়েছে, সেখানে বর্ণনার আবহ রূপে ব্যবহার করা হয়েছে একটা গা ছমছমানি ভাব। গল্পকথক তথ্য নায়ক যেন স্বপ্নের ঘোরে পৌঁছে গেছেন আড়াইশো বছর আগের বাদশাহী দরবারে। সেই ভয় বিহ্বল রোমান্টিকতার মধ্যে পাঠকের মন হারিয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেখানে গল্পকথকের চিত্তবিভ্রমের ফলে এমন কোনো ভাবোচ্ছ্বাসের উদয় দেখতে পাওয়া যায় না যার সঙ্গে কবি স্বয়ং সম্পৃক্ত হয়ে আছেন। কিম্বা এমন ভাবোচ্ছ্বাস নেই যেখানে পাঠককেও প্লাবিত করে তুলতে পারে। বস্তুত আলোচ্য গল্পের স্বপ্নবিভোরতা পাঠকচিত্তে ক্ষণকালের মোহবিভ্রম সঞ্চার করে কিন্তু পরক্ষণেই পাঠক শুনতে পায় মেহের আলির কণ্ঠে লেখকের সতর্ক ধ্বনি, ‘সব ঝুট হ্যায়’।
একটা বিষয় হতে পারে এই যে, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পের পটভূমি শাহিবাগের বাড়িটি—যেখানে কিশোর রবীন্দ্রনাথ অনেক নির্জন দুপুর কল্পলোকে ভেসে কাটিয়েছিলেন, তার স্মৃতি সম্ভবত রবীন্দ্রনাথকে এই গল্প পাঠ করার সময় আচ্ছন্ন করতো। এবং নিজেকে কৈশোরের সেই দিনের রোমান্টিক বিহ্বলতায় হারিয়ে ফেলতেন। তাই এই গল্পকে তিনি গীতিধর্মী বলে উল্লেখ করে থাকতে পারেন। কিন্তু আলংকারিকের বিচারে একে গীতিধর্মী গল্প বলা যায় না।
আমাদের বিচারে রবীন্দ্রনাথের উক্ত মতকে আমরা সমর্থন করতে পারি না। কেন না, আলোচ্য গল্পের মধ্যে এমন কোনো ভাবোচ্ছ্বাসের প্লাবন লক্ষিত হয় নি, যার জন্যে একে গীতিধর্মী বলে আমরা মেনে নিতে পারি। তা ছাড়া আলোচ্য গল্পের মধ্যে লেখক ও গল্পকথক দুজনেই ভিন্ন সত্ত্বায় উপস্থিত ছিলেন। ফলে লেখকের নিজের ভাবোচ্ছ্বাস গল্পকথক তথা নায়কের ভাবোচ্ছ্বাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় নি। এই সব কারণে আলোচ্য গল্পটিকে আমরা গীতিধর্মী গল্প হিসেবে মেনে নিতে পারি না।
Leave a comment