বাংলা সাহিত্যে দোসরহীন, বিশ্বসাহিত্যের সম্পদ ক্ষুধিত পাষাণ আইডিয়ার—ElDerado পথে ঘাটে মণিমুক্তো ছড়ানো। বাস্তব ও অবাস্তব, লৌকিক ও অতিলৌকিকের এক আশ্চর্য রসায়নে, অদ্ভুত সমাগমে রচিত হয়েছে এক অতিপ্রাকৃত প্রতিবেশে—তা কি ভৌতিক, না নিছক মস্তিষ্কের বিভ্রম—হ্যামলেটের ভাষায় বলি—“to be or not to be that is the question.”
শুধু ইলিউশন নয়, এ হ্যালিউসিনেশন—রজ্জুতে সর্পভ্রম নয়, রজ্জুই নেই—তবু সৰ্পদর্শন হচ্ছে—যাকে ভ্রম বলা যাছে না। তুলামাশুল আদায়কারী সেই সবজান্তা ব্যক্তি শাহ সুজার শ্বেতপাথরের প্রাসাদে আশ্রয় নিল—“একসময় ঐ প্রাসাদে অনেক অতৃপ্ত বাসনা, অনেক উন্মত্ত সম্ভোগের শিখা আলোড়িত হইত,—সেই সকল চিত্তদাহে, সেই সকল নিস্ফল কামনার অভিশাপে এই প্রাসাদের প্রত্যেক প্রস্তরখণ্ড ক্ষুধার্ত তৃষ্মার্ত হইয়া আছে ; সজীব মানুষ পাইলে তাহাকে লালায়িত পিশাচীর মত খাইয়া ফেলিতে চায়।” কাজেই এখানে যে অতিলৌকিক পরিবেশ অঙ্কিত, তার প্রাণ আছে—যার প্রাণিত অবয়ব চিত্রিত হয়েছে অমিত নৈপুণ্যে, শিল্পীর তুলির টানে টানে। প্রথমেই প্রাসাদ তার মোহিনী মায়ায় দিশাহারা করেছে “কিন্তু সপ্তাহ খানেক না যাইতেই বাড়িটার এক অপূর্ব নেশা ক্রমশই আমাকে আক্রমণ করিয়া ধরিতে লাগিল । সমস্ত বাড়িটা একটা সজীব পদার্থের মতো আমাকে তাহার জঠরসহ মোহরসে অল্পে অল্পে যেন জীর্ণ করিতে লাগিল।” অজগর যেন শিকারকে ক্রমশ গ্রাস করতে লাগল। এ কি কেবল ইন্দ্রিয়ের ভ্রম! “ইন্দ্রিয়ের ভ্রম বলিয়া পুনর্বার ফিরিয়া বসিতেই একেবারে অনেকগুলি পায়ের শব্দ শোনা গেল…ঈষৎ ভয়ের সহিত এক অপরূপ পুলক মিশ্রিত হয়া আমার সর্বাঙ্গ পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল।” প্রমথনাথ বিশী বলেছেন, এই গল্প পাঠককেই যেন অতীন্দ্রিয় সত্তা দান করে, পাঠকই যেন অতিপ্রাকৃত হয়ে পড়ে। (রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প : পৃ. ৫১) এ কি শুধুই স্নায়বিক টেনশন ও কল্পনাসক্তির ফল ? তার অতিরিক্ত কিছু আমাদের দেয় ক্ষুধিত পাষাণ। যার ভেতরে আছে বহু স্বপ্নভঙ্গের ‘ইতিকথা— যার মধ্যযুগীয় বিলাসবাসন, বর্ণচ্ছাটা মেঘত্বত্তের মত ভেসে ওঠে এই প্রাসাদে ; তার উদয় আছে, আছে বিকাশ—আছে শুন্যময় পরিনাম, পরিনামহীন শূন্যতা— এ কি স্বপ্ন, না সত্য ; কলানা না ইতিহাসের বাস্তব—জালি না, কিন্তু জানতেও ছাড়ি না। ফ্যানটামি আর রিয়ালের এ ইন্দ্ৰজাল—“Did I dream or wake?”
কাহিনির নায়ক মোহাবিষ্ট, মরীচিকা — মোহে আচ্ছন্ন। একদল প্রমোদচঞ্চল নারী কলহাস্যে স্নান করছে নদীজলে—“মনে হইল আড়াই শত বৎসরের কৃষ্ণবর্ণ যবনিকা ঠিক আমার সম্মুখে দুলিতেছে—ভয়ে ভয়ে একটি ধার তুলিয়া ভিতরে দৃষ্টিপাত করি।” দিনের বেলায় পরম হাস্যজনক মনে হল, কিন্তু সন্ধ্যা হলেই চুম্বকের মত সেই ক্ষুধিত পাষাণ টানতে থাকে। সেখানকার জগত সভ্য সমাজের বাইরে—বর্তমানে মধ্যযুগীয় সভা বসিয়েছে—“দরজা ঠেলিয়া আমি যেমনি প্রবেশ করিলাম অমনি মনে হইল যেন ঘরের মধ্য ভারি একটা বিপ্লব বাকিয়া গেল” আর নুপুরনিক্কনে, আতরের গন্ধে, বাদ্যগীতে, নহবতের আলাপে …..আমার চতুর্দিকে একটা প্রেতলোকের রাগিনী সৃষ্টি করিতে লাগিল” সে প্রেতলোক এতটাই বাস্তব যে—“এই অস্পৃশ্য অগম্য অবাস্তব ব্যাপারটা জগতে একমাত্র সত্য, আর সমস্তই মিথ্যা মরীচিকা” তারপর সেই আয়ব রমণী—তার দুর্দম টানে নায়কের অভিসার গা ছমছমে পরিবেশে ভয় আর সাসপেন্সের শেষসীমায় পৌঁছানো। সেই দূতীর পদাঙ্ক অনুসরণ—গালিচা পাতা ঘর কিয়দাংশ, নীলাভ স্ফটিকপাত্রে সুরার আহ্বান, সেই ভয়ঙ্কর খোজা তরোয়ালের ভীষণ শব্দ—সবশেষে মেহের আলির “সব ঝুটা হ্যায়” এবং সকাল হওয়ার সাথে সাথে আরব্য রজনীর অভিসারে যবনিকা পতন—কল্পনারাজ্যে বাস্তবের পদক্ষেপ। তবু জিতে যায় সেই ক্ষুধিত পাষাণ “এইরূপে আমার আরব্য রজনীর এক রাত্রি অকস্মাৎ শেষ হইল—কিন্তু এখনো এক সহস্র রজনী বাকি আছে।” সেই বাদশাহী ইতিহাসের এক চরিত্র হয়ে উঠলো নায়ক-পাষাণ যেন তার বিষপ্রয়োগে অবশ করল শিকারকে। বাতাসের হিল্লোলের মধ্যে এক নায়িকাকে বিদ্যুৎচমকে দেখতে পেত সে—“সে আমাকে পাগল করিয়া দিয়াছিল। আমি তাহারই অভিসারে প্রতি রাত্রে নিদ্রার রসাতল রাজ্যে স্বপ্নের জটিল পথসংকুল মায়াপুরীর মধ্যে টলিতে টলিতে কক্ষে কক্ষে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইয়াছি।” সেই আরব রমণী দর্পণে দেখা দিয়ে মিলিয়ে যায়—“সে যে নাগাল পেলে পালায় ছুটে লাগায় চোখে ধাঁধা।” সেই নায়ক বুঝতে পারলে—“অল্পে অল্পে যেন একটি মোহিনী সর্পিণী তাহার মাদকবেষ্ঠনে আমার সর্বাঙ্গ বাঁধিয়া ফেলিত।” তারপর গুমরে গুমরে কে যেন কেঁদে লইয়া যাও।” সেই সারঙ্গীর সংগীত, সুবর্ণমদিরায় চুরির ঝলক, বিষের জ্বালা, কটাক্ষের আঘাত। কি অসীম ঐশ্বর্য, কি অনন্ত কারাগার। তাই ফিরে গিয়েও আবার প্রাসাদে আসতে হল। বলতে হল “হে বহ্নি, যে পতঙ্গ তোমাকে ফেলিয়া পালাইবার চেষ্টা করিয়াছিল, সে আবার মরিবার জন্য আসিয়াছে।” গায়ে তার অশ্রুজল পড়ল, একজন রমণী ক্রমাগত চুল ছিঁড়ছে, রক্তে ভিজে যাচ্ছে তার মাথা, বৃষ্টি তার শরীরকে দিচ্ছে ভিজিয়ে—সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচল সে তুলনাগুলি আদায়কারী। না কি বাঁচল না?
ক্ষুধিত পাষাণে শুধু মনস্তাত্ত্বিক ভ্রমই নেই, অতিলৌকিতা জগতের শিহরণ এখানে বর্তমান। তার গা-ছমচমে রোমহর্ষক ভাব এক শিহরণ জাগায়। অপূর্ব কৃতিত্বের সাথে রবীন্দ্রনাথ একটি realistic Setting তৈরি করে তথাকথিত আরব্য রজনী কথাকে বাস্তবের সিঁড়ি দিয়ে মধ্যযুগের রঙ্গমঞ্চে নিয়ে গেছেন পাঠককে। আমরা যেন ক্ষুধিত পাষাণকে অনুভব করি। মধ্যযুগীয় পাষাণ যেন জগদ্দল হয়ে চেপে বসে বুকে। De Quincey-র Dream Vision-এর সাথে একমাত্র তুলনা চলে এর। এ যেন এক অতিপ্রাকৃতের কল্পনারাজ্য। “সেই অবাধ কল্পনা ও সংগীত প্রবাহের মধ্যে যেন অবাস্তব কোথাও কিছু নাই, অবাস্তব কুহেলিকার আবরণ যাহা কিছু ছিল সব ঘুচিয়া গিয়াছে।” (নীহাররঞ্জন রায়) গল্পের কাহিনির শুরু ও শেষ লে স্টেশনে, মাঝে এই গল্পের অতিলৌকিক কাহিনি—মনে হয় ক্ষুধিত পাষাণ তার শুরু ও শেষের সাথে মূল গল্পকে স্তম্ভ দিয়ে জুড়েছে—এই যা যোগ। গল্পটুকু শুধু মধ্যযুগীয় কাহিনি ও তার অনুভবে ও সীমাবদ্ধ তাকতে পারতো। কাজেই ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ অতিপ্রাকৃত রসে সমৃদ্ধ হলেও অবাস্তব রূপকথা নয়। হালকা মনোবিভ্রম, মায়ামোহ ও মরীচিকা এই প্রতিবেশের পটভূমি রচনা করেছে। বস্তু ও বিষয়, ফ্যানটাসি ও রোমান্সের মণিকাঞ্চন যোগ ঘটেছে এখানে। তাই এ শুধু মনোধিকারজনিত চিত্তবিভ্রম নয়, পৈশাচিক প্রতিহিংসা আর জমাট বেঁধে থাকা পাপমোহের জীবসত্তা লাভ করে অতিলৌকিক অথচ প্রাণস্পন্দনময় বাতাবরণ গড়ে ওঠার মায়াপুরী যেন এ গল্প। গীতিময়, সাংগীতিক অতিপ্রাকৃত অনুভবগ্রাহা—এক ফ্রেমে সাহিত্যের বিশ্বরূপদর্শন ক্ষুধিত পাষাণ।
Leave a comment