সূচনা: যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের রাজনীতিতে এক অচলাবস্থা তৈরি হয়। কংগ্রেস এবং লিগের মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। জিন্না পাকিস্তান দাবিতে অটল থাকায় এই দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। অপর দিকে বড়ােলাট লিনলিথগাের স্থলে নতুন বড়লাট ওয়াভেল ভারত নিয়ে উদ্ভূত সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেন। তিনি লন্ডনের ব্রিটিশ মন্ত্রীসভাকে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার অনুরােধ জানান।
[1] ওয়াভেল পরিকল্পনা: বড়ােলাট ওয়াভেল ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুন কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের কাছে একটি সূত্র উত্থাপন করেন, সেটিই ওয়াভেল পরিকল্পনা নামে খ্যাত। তিনি বলেন—
-
[i] নতুন সংবিধান গৃহীত না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় নেতাদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে।
-
[ii] বড়ােলাটের শাসন পরিষদে বর্ণহিন্দু ও মুসলমান সদস্যের সংখ্যা সমান থাকবে।
-
[iii] একমাত্র বড়ােলাট ও প্রধান সেনাপতি ছাড়া শাসন পরিষদের অন্য সমস্ত সদস্য হবে ভারতীয়।
-
[iv] ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে পর্যন্ত ভারতের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ব্রিটিশের হাতেই থাকবে।
-
[v] সরকার যতটা সম্ভব তাড়াতাড়ি ক্ষমতা হস্তান্তর করবে এবং সংবিধান রচনার কাজ আরম্ভ করবে।
[2] সিমলা বৈঠক
-
আলােচ্য বিষয়: ওয়াভেলের পরিকল্পনা মেনে সিমলায় এক বৈঠক বসে (১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৫ জুন)। কংগ্রেস, মুসলিম লিগ ও অন্যান্য দলের নেতাদের এই সম্মেলনে যােগ দেওয়ার আহ্বান জানানাে হয়। সিমলা বৈঠকে বড়ােলাট ওয়াভেলের পরিকল্পনাগুলি আলােচিত হয়। তবে এই বৈঠকের মূল আলােচ্য বিষয় ছিল দুটি- প্রথমটি ছিল, বড়ােলাটের কাউন্সিল বা শাসন পরিষদ যে সমস্ত নীতির ভিত্তিতে কাজ করবে সেগুলি ঠিক করা। দ্বিতীয়টি ছিল, কাউন্সিল কীভাবে গঠিত হবে বা এই কাউন্সিলের কারা সদস্য হবে তা ঠিক করা।
-
পরিণতি: জিন্না যখন বড়ােলাটের কার্যনির্বাহক সমিতিতে লিগের দ্বারা মুসলিম সদস্য নিয়ােগের দাবি জানান তখন কংগ্রেস সে দাবি মেনে নিতে চায়নি। এ ছাড়া ব্রিটেনের রক্ষণশীল দলও ভারত ত্যাগ করতে রাজি ছিল না। ফলে সিমলা বৈঠক ব্যর্থ হয়।
[3] ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন
-
উদ্দেশ্য: মন্ত্রী মিশনের উদ্দেশ্য ছিল দুটি- [a] ভারতকে স্বাধীনতাদান এবং ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার জন্য যে গণপরিষদ তৈরি হবে তার গঠন, পদ্ধতি ও নীতি নির্ধারণ করা। [b] ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলির বৃহত্তর মতৈক্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালের জন্য একটি জনপ্রতিনিধিভিত্তিক সরকার গঠন করা।
-
প্রস্তাব: এই মিশনের প্রধান প্রস্তাবগুলি ছিল- [a] ভারতে একটি দ্বিস্তর বিশিষ্ট যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হবে। দেশীয় রাজ্যগুলি এই যুক্তরাষ্ট্রে যােগ দিতে পারবে। [b] কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। কেবলমাত্র পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যােগাযােগ বিষয়ক ক্ষমতা থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর। প্রদেশগুলিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হবে। [c] প্রদেশগুলিকে তিনটি বিভাগে বিভক্ত করা হবে। [d] ভারত যুক্তরাষ্ট্রে যােগদানে ইচ্ছুক দেশীয় রাজ্য ও প্রদেশগুলির নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান রচনার জন্য গণপরিষদ গঠিত হবে। [e] নতুন সংবিধান চালু হলে যে-কোনাে নির্বাচিত প্রাদেশিক আইনসভা ইচ্ছা করলে যে-কোনাে বিভাগে যােগ দিতে কিংবা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতেও পারবে। [f] যতদিন না নতুন সংবিধান প্রণীত হয়, ততদিন ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকার গঠন করা হবে।
[4] মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা
-
মাউন্টব্যাটেনের লক্ষ্য: ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের লক্ষ্য ছিল অখণ্ড ভারত। তাই ২৪ মার্চ থেকে ৬ মে র মধ্যে তিনি ভারতীয় নেতৃমণ্ডলী ও রাজন্যবর্গের সঙ্গে ১৩৩টি বৈঠক করেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই নতুন বড়ােলাট বুঝে নেন যে, ভারত বিভাগ ছাড়া ভারতীয় সমস্যার কোনাে সমাধান নেই।
-
বিভিন্ন প্রস্তাব: মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাবে বলা হয়- [a] ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি ডােমিনিয়নের সৃষ্টি করা হবে। ডােমিনিয়ন দুটি সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বিষয়সমূহ পরিচালনা করবে। [b] মুসলমান প্রধান প্রদেশ—সিন্ধু, ব্রিটিশ অধিকৃত বালুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পশ্চিম পাঞ্জাব ও পূর্ব বাংলা নিয়ে পাকিস্তান গড়া হবে। [c] পাঞ্জাব ও বাংলাকে বিভক্ত করে কোন্ অঞ্চলকে কোন্ ডােমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত করা হবে তা নির্ধারণের জন্য একটি সীমানা নির্ধারণ কমিশন ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই গঠিত হবে। [d] আসামের শ্রীহট্ট জেলা কোন ডােমিনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হবে তা গণভােটে স্থির হবে। [e] দেশীয় রাজ্যগুলি নিজ নিজ রাজ্যে সার্বভৌম ক্ষমতা লাভ করবে এবং ইচ্ছা করলে তারা যে-কোনাে ডােমিনিয়নে যােগ দিতে পারবে। [f] প্রতি ডােমিনিয়নের নির্বাচিত গণপরিষদ নিজ এলাকার সংবিধান রচনা করবে। [g] যতদিন না সংবিধান রচিত হচ্ছে ততদিন ব্রিটিশ সরকার নিযুক্ত একজন গভর্নর-জেনারেল ওই ডােমিনিয়নে থাকবেন। [h] স্বাধীনতা লাভের পর প্রতি ডােমিনিয়নের নির্বাচিত আইনসভা নিজ নিজ দেশের জন্য আইন রচনা করবে।
উপসংহার: ভারতবাসীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সদিচ্ছা না থাকলেও সমকালীন ভারতের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি ব্রিটিশকে স্বাধীনতা দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য করে।
Leave a comment