ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ কি
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের ধারণাটি প্রাচীন। অ্যারিস্টটলের রচনায় প্রথম এই নীতি এর ব্যবহার দেখা যায়। অ্যারিস্টটল রাষ্ট্রের কার্যাবলিকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করেছেন, যথা—
- (১) নীতি নির্ধারণ সংক্রান্ত কাজ (Deliberative),
- (২) নীতি প্রয়ােগ সংক্রান্ত কাজ (Magisterial ),
- (৩) বিচার সংক্রান্ত কাজ (Judicial)।
অ্যারিস্টটলের পর রােমান চিন্তাবিদ সিসেরাে ও পলিবিয়াস-এর রচনাগুলিতেও ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়ােগ লক্ষ করা যায়। এই দুজন দার্শনিক ছাড়াও চতুর্দশ শতাব্দীতে মার্সিলিয়াস এবং যােড়শ শতাব্দীতে বােদার রচনাতেও এই নীতির পরিচয় পাওয়া যায়। এ ছাড়া লক ও হ্যারিংটন ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে যথেষ্ট সমর্থন জানিয়েছিলেন।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতির অর্থ
যে-কোনাে স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকারের তিনটি বিভাগ যথা— শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ। সরকারের এই তিনটি আলাদা আলাদা বিভাগ যে নীতির দ্বারা স্বাধীনভাবে নিজ নিজ কার্য সম্পাদন করে থাকে, তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতি (theory of separation of power) বলা হয়। যেমন—সরকারের আইন বিভাগ আইন প্রণয়ন করে, আইনের প্রয়ােগ করে থাকে সরকারের শাসন বিভাগ এবং ন্যায়ের রক্ষাকর্তা হিসেবে ভূমিকা পালন করে বিচার বিভাগ।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মূল কথা
- (১) সরকারের যে বিভাগের যা কাজ, তা সেই বিভাগেরই করা দরকার।
- (২) এক বিভাগের কাজ আর-এক বিভাগের করা উচিত নয়।
- (৩) এক বিভাগের কাজ অন্য বিভাগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত নয়।
- (৪) একই ব্যক্তির একাধিক বিভাগের সঙ্গে জড়িত থাকা উচিত নয়।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রধান প্রবক্তাগণ
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের ধারণা আধুনিক কালের নয়, প্রাচীন গ্রিসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক অ্যারিস্টটল সরকারের কার্যাবলিকে আলােচনামূলক, শাসন পরিচালনামূলক এবং বিচার সংক্রান্ত এই তিন ভাগে ভাগ করেছিলেন। রােমান চিন্তানায়ক পলিবিয়াস (Polybius) এবং সিসেরো (Cicero) এই নীতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইতালির চিন্তানায়ক ম্যাকিয়াভেলি ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ এবং নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতিকে সমর্থন করেন। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণকে একটি বলিষ্ঠ তত্ত্ব বা মতবাদ হিসেবে প্রথম প্রতিষ্ঠিত করেন অষ্টাদশ শতাব্দীর খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মন্তেস্কু (Montesquieu)। তিনি ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণকে ব্যক্তিস্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ রক্ষাকবচ হিসেবে প্রচার করে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এক মৌলিক নীতি প্রবর্তন করেন। তিনি ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তার The Spirit of the Laws’ গ্রন্থে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির পূর্ণ তাত্ত্বিক রূপ দান করেন। তিনি হলেন ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মুখ্য প্রবক্তা। পরবর্তীকালে ইংল্যান্ডের আইনজ্ঞ ব্ল্যাকস্টোনের লেখা গ্রন্থে Commentaries on the Laws of England’ (১৭৬৫) ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়ােগ ঘটে। এ ছাড়াও ম্যাডিসন ও হ্যামিলটনের লেখাগুলিতেও ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির সমর্থন মেলে।
ক্ষমতা ব্রীকরণ নীতি সম্পর্কে মন্তেস্কুর মতামত
মন্তেস্কু বলেন, যখন একই শাসক অথবা একই শাসক সংস্থার মধ্যে আইন এবং শাসনক্ষমতার একত্রীকরণ ঘটে তখন স্বাধীনতা বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং বিপন্নও হয়। যেখানে আইন বিভাগ এবং শাসন বিভাগের থেকে বিচার বিভাগ পৃথক নয় – সেখানেও অনুরূপ ঘটনা ঘটে। কিন্তু যদি ক্ষমতার একত্রীকরণ না ঘটে, পৃথক্করণ ঘটে এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট তিনটি বিভাগ তাদের নিজস্ব পৃথক দায়িত্ব পালন করে, তবে এই সম্ভাবনা থাকতে পারে না। আসলে মন্তেস্কু ব্যক্তিস্বাধীনতার একজন একনিষ্ঠ পূজারি বলে পরিচিতি লাভ করেন। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির মধ্যে মন্টেস্কু ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল মন্ত্রকে খুঁজে পেয়েছিলেন।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাস্তব প্রয়ােগ
ফরাসি বিপ্লব ও আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের পশ্চাতে এই নীতির প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, ব্রাজিল, চিন প্রভৃতি দেশে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়ােগ লক্ষ করা যায়। ফ্রান্সের গণপরিষদ ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির গুরুত্বকে অপরিহার্য বলে চিহ্নিত করেছে।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োজনীয়তা
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়ােজনীয়তা আছে কি না তা নিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ দেখা যায়। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কতকগুলি তথ্যের দ্বারা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছেন। এগুলি নিম্নে আলােচনা করা হল一
মন্তেস্কুর ধারণা হয়েছিল যে, স্বৈরাচারী শাসনে জনগণের স্বাধীনতা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল কারণ, একই ব্যক্তির হাতে সরকারের একাধিক বিভাগের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। এর ফলস্বরূপ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়ােজনীয়তা দেখা যায়।
মন্তেস্কু মনে করতেন, ক্ষমতা একজন ব্যক্তির উপর ন্যস্ত না থেকে সরকারের সংশ্লিষ্ট এক-একটি বিভাগের উপর ন্যস্ত হলে一
- (১) ক্ষমতার অযথা কেন্দ্রীভবন ঘটবে না,
- (২) এর ফলে ক্ষমতার প্রয়ােগ আরও বেশি সুষ্ঠু ও যথার্থ হবে এবং
- (৩) ব্যক্তিস্বাধীনতা শাসকের স্বৈরাচার থেকে রক্ষা পাবে।
আইন প্রণয়ন, আইনের প্রয়ােগ এবং বিচারের কাজ একই সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত হলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এই কারণে রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব সরকারের বিভিন্ন বিভাগের উপর অর্পণ করা হয়েছে। সুতরাং ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়ােজনীয়তা লক্ষ করা যায়।
১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘The Spirit of the Laws’ শীর্ষক গ্রন্থে মন্তেস্কু বলেন যে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়ােজন কারণ আইন ও শাসন বিষয়ক ক্ষমতা একই ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টির হাতে ন্যস্ত থাকলে স্বাধীনতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। কারণ আইনসভা স্বৈরতন্ত্রী আইন প্রণয়ন করবে এবং শাসন বিভাগ তা স্বৈরতন্ত্রী পদ্ধতিতে প্রয়ােগ করবে।
আবার বিচার বিভাগীয় এবং শাসন বিভাগীয় ক্ষমতা যদি একই ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদের হাতে ন্যস্ত থাকে তার ফলে বিচারপতিরা হিংসা ও দমনপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। তাই মন্তেস্কু স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়ােজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন।
ব্ল্যাকস্টোনেরও মতে, জনগণের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতা সংরক্ষণের জন্যই সরকারের তিনটি বিভাগ ভিন্ন ভিন্নভাবে কার্য সম্পাদন করে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখবে বলেই এই নীতির প্রয়ােজনীয়তা দেখা যায়।
উপরােক্ত সমস্ত ব্যাখ্যার দ্বারা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির তাৎপর্য বা গুরুত্ব যেমন বােঝা যায় তেমনি এই নীতি প্রয়ােগের প্রয়ােজনীয়তাও উপলব্ধি করা যায়। এই নীতি প্রয়ােগের সার্থকতা হল এই যে, সরকারের তিনটি বিভাগই তাদের কাজ ও ক্ষমতা প্রয়ােগের দিক থেকে সর্বদা পৃথক। কোনাে বিভাগ অপর বিভাগের কাজে কখনােই হস্তক্ষেপ করবে না এবং প্রত্যেক বিভাগের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় থাকবে।
মূল্যায়ন: পরিশেষে বলা যায় যে, বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী যেমন – অধ্যাপক জন স্টুয়ার্ট মিল মনে করেন, এই নীতি বলবৎ হলে এক বিভাগ অন্য বিভাগের কাজে অযথা বাধা সৃষ্টি করবে ফলে সরকার অচল হয়ে পড়বে। এই সমালােচনা করলেও এই নীতির গুরুত্বকে কোনােভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
এ কথা বলা দরকার যে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ অর্থে সরকারের কোনাে বিভাগের মধ্যে কোনাে সম্পর্ক থাকবে না সে-কথা কিন্তু মন্তেস্কু বলেননি, বিভিন্ন বিভাগগুলির হাতে পরস্পরকে সংযত করতে যেসব ক্ষমতা দরকার তার প্রতিটির গুরুত্বকে তিনি মেনে নিয়েছেন। জনসাধারণকে কৃপা করা বা জনকল্যাণের প্রতি নজর দিলেই রাষ্ট্রের কাজ ফুরিয়ে যায় না, মানুষকে বেঁচে থাকার, তার জীবিকা বা অন্যান্যভাবে পুষ্টি সাধনের ব্যবস্থা রাষ্ট্র কি করতে হবে এবং এক্ষেত্রে খামখেয়ালিপনা নয়, সমতার দৃষ্টি নিয়ে রাষ্ট্রকে অগ্রসর হতে হবে। মানুষের শান্তি ও নিরাপত্তার পরিবেশ গড়ে দিতে হবে বা মানুষের সুখ সুবিধার দিকে দৃষ্টি দিতে রাষ্ট্রশক্তিকে সংযমের পরীক্ষা দিতে হবে। মন্তেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি এই সংযমী শাসনেরই এক উল্লেখযােগ্য পদক্ষেপ।
সর্বোদয় প্রসঙ্গে গান্ধীজীর ধারণা ব্যাখ্যা করাে।
রাষ্ট্র প্রসঙ্গে গান্ধীজীর ধারণা ব্যাখ্যা করাে।
রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে গান্ধিবাদের ধারণা ও মার্কসীয় ধারণার মধ্যে তুলনা | রাষ্ট্রের প্রকৃতি সম্পর্কে গান্ধিজি ও মার্কসীয় ধারণার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য
Leave a comment