মন্তেস্কুর মতে, একই ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদের হাতে সরকারের সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলে ব্যক্তিস্বাধীনতা সংরক্ষিত হতে পারে না। সরকারের তিন শ্রেণির ক্ষমতা তিনটি পৃথক বিভাগের দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত। ইংরেজি আইনবিদ ব্ল্যাকস্টোন ও মন্তেস্কু তাঁদের উক্তি প্রতিধ্বনি করে বলেছেন যে, একই ব্যক্তি বা ব্যক্তি সংসদের হাতে সরকারের একাধিক বিভাগের কার্যাবলির দায়িত্ব অর্পিত হলে ব্যক্তি স্বাধীনতা ধবংস হবে। যাইহােক, স্বাধীনতার মূলমন্ত্র হিসেবে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের গুরুত্ব বা প্রভাব অপরিসীম। ফরাসি বিপ্লব ও আমেরিকার স্বাধীনতা। যুদ্ধের পশ্চাতে এই নীতির প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, মেস্কিকো, ব্রাজিল, চিন প্রভৃতি দেশে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।

ক্ষমতা স্বীকরণ নীতির পক্ষে মন্টেস্কু যুক্তি

(১) বিভাগীয় স্বাধীনতা: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি সরকারের প্রতিটি বিভাগের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। কোনাে বিভাগ অপর কোনাে বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করে না। মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাডিসন বলেছেন, একই হাতে সরকারের সকল ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর।

(২) দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি: প্রত্যেক বিভাগ নিজেদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন থাকে। প্রত্যেক বিভাগের কাজ সম্বন্ধে নাগরিকরা সচেতন থাকে বলেই বিভাগীয় দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি পায়।

(৩) স্বৈরাচারিতা রােধ: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়ােগের ফলে কোনাে বিভাগের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটে না। ফলে সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে কোনাে বিভাগই স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে পারে না।

(৪) ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষা: মন্তেস্কুর মতে, ক্ষমতা স্বত্ত্রীকরণ নীতি ব্যক্তিস্বাধীনতার পক্ষে উপযোগী। তিনি মনে করেন আইন প্রণয়ন, আইনের প্রয়ােগ এবং বিচারের কাজ একই সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত হলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুন্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কাজেই রাষ্ট্রপরিচালনার বিভিন্ন কাজ পৃথকভাবে বিভিন্ন বিভাগের উপর অর্পণ করা উচিত।

(৫) সরকারি কাজের কর্মদক্ষতা ও গতিশীলতা বৃদ্ধি: প্রত্যেক বিভাগের কাজ নির্দিষ্ট থাকায় কোন বিভাগের কাজ অন্য বিভাগের উপর নির্ভর করবে না। এই কারণেই প্রত্যেক বিভাগ দক্ষতার সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ সুসম্পন্ন করতে পারবে। এর ফলে সরকারি কাজে গতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে।

ক্ষমতা স্বীকরণ নীতির পক্ষে মন্টেস্কু যুক্তি

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত মন্তেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতির বিরুদ্ধে তেমন কোনাে সমালােচনা শুরু না হলেও উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে প্রবল সমালােচনার ঝড় ওঠে। অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মনে করেন, “সরকারের ক্ষমতার পূর্ণ স্বতন্ত্রীকরণ সম্ভব নয়, কাম্যও নয়।” এই নীতির বিপক্ষে যুক্তিগুলি নিম্নে আলােচনা করা হল一

(১) বাস্তব প্রয়ােগ অসম্ভব: সমালােচকদের মতে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাস্তব প্রয়ােগ সম্ভব নয়, কারণ পারস্পরিক সহযােগিতাই হল গণতান্ত্রিক সরকারের ভিত্তি, এখনও কোনো-না-কোনোভাবে এক বিভাগ অপর বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে বা অন্য বিভাগের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সর্বোপরি একই ব্যক্তি একাধিক বিভাগের সঙ্গে কোনাে না-কোনােভাবে সম্পর্কে যুক্ত থাকেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আইনসভা অনেকসময় আইনের রূপরেখা প্রস্তুত করে, কিন্তু তার পূর্ণাঙ্গ রূপ দেয় শাসন বিভাগ। অনেকসময় বিচার বিভাগ প্রচলিত আইনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নতুন আইন রচনা করে। আবার আইনসভার অধিবেশন বন্ধ থাকাকালীন অবস্থায় শাসন বিভাগ অর্ডিন্যান্স জারি করে। শাসন বিভাগকে কাজ করতে হয় মূলত আইন বিভাগ দ্বারা রচিত আইনের উপর ভিত্তি করে। তাই পূর্ণ ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণের বাস্তব প্রয়ােগ সম্ভব নয়।

(২) বাস্তব প্রয়ােগ কাম্য নয়: তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাস্তব প্রয়ােগ সম্ভব, তাহলেও এর প্রয়ােগ আদৌ কাম্য নয় বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন। কারণ এই নীতি বাস্তবে কার্যকর হলে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সহযােগিতার পরিবর্তে পারস্পরিক বিরােধিতা এবং সংঘাত বা সংঘর্ষ দেখা দেবে।

(৩) সরকারের বিভাগ নিয়ে মতপার্থক্য: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেঙ্কস গুডনাউ প্রমুখের মতে, সরকারের বিভাগ তিনটি নয় পাঁচটি। যথা—

  • (a) আইন বিভাগ,
  • (b) শাসন বিভাগের কর্মকর্তাগণ,
  • (c) শাসন বিভাগের কর্মচারীগণ,
  • (d) বিচার বিভাগ এবং
  • (e) নির্বাচকগণ।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উইলােবি মনে করেন, সরকারের বিভাগ দুটি যথা শাসন বিভাগ এবং আইন বিভাগ। সুতরাং সরকারের কাজকে তিনটি ভাগে ভাগ করে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি চালু করলে বাস্তবে অনেক অসুবিধা আছে।

(৪) স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হতে পারে না: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কার্যকরী হলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুগ্ন হয় এবং স্বৈরাচারিতার পথ প্রশস্ত হয়। এই নীতি প্রয়ােগের ফলে এক বিভাগ অপর বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বলেই সরকার স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। তাই এই নীতিটি কোনাে বিভাগের স্বাধীনতার রক্ষাকবচ হয়ে উঠতে পারে না।

(৫) জৈব মতবাদের যুক্তি: জৈব মতবাদ অনুযায়ী সরকার হল জীবদেহ সদৃশ। জীব দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি যেমন পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল তেমনি সরকারের বিভাগগুলিও পারস্পরিক বন্ধনে আবদ্ধ। ব্লুন্টলির ভাষায় বলা যায় যে, দেহ ও মস্তিষ্ক আলাদা করলে যেমন ব্যক্তির মৃত্যু অনিবার্য তেমন সরকারের বিভিন্ন বিভাগকে পরস্পর থেকে আলাদা করলে রাষ্ট্রের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।

(৬) সরকার বিভাগের সহযােগিতার অভাব: সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় আইন ও শাসন বিভাগের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে হয়। কিন্তু ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রযুক্ত হলে প্রতিটি বিভাগ নিজ নিজ বিভাগের কাজকর্ম ও ক্ষমতার সংরক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে ফলে এক বিভাগ অপর বিভাগকে কোনােরকমভাবেই সহযােগিতা করতে পারবে না। একবিংশ শতকের প্রযুক্তির দুনিয়ায় অষ্টাদশ শতকের চিন্তাধারা সময় উপযােগী বা প্রযােজ্য নয় বলেই ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়ােগযােগ্য বলে বিবেচিত নয়।

(৭) বিভিন্ন বিভাগের দক্ষতা নষ্ট হবে: বর্তমান কল্যাণকর রাষ্ট্র সরকারি কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য এক বিভাগের সঙ্গে আর-এক বিভাগের কাজকর্মের সুষ্ঠু সহযােগিতার ফলেই সু-আইন প্রণয়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সুবিচার প্রদান করা সম্ভবপর হবে। কিন্তু ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি কার্যকরী হলে প্রতিটি বিভাগ পরস্পরের সঙ্গে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়বে। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রযুক্ত হলে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের দক্ষতা নষ্ট হয়ে যাবে।

(৮) দায়িত্বহীনতা: ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়ােগের ফলে সরকারি বিভাগগুলির মধ্যে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা দেখা দিতে পারে। এর ফলস্বরূপ প্রতিটি বিভাগ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করলে নিজেদের দায় অপর বিভাগের উপর চাপানাের চেষ্টা করতে পারে, তাতে জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

(৯) ক্ষমতার প্রশ্নে অসাম্য: আইন বিভাগ অন্যান্য বিভাগের তুলনায় শক্তিশালী হয়। আইন বিভাগ কর্তৃক রচিত আইনের পথ ধরেই শাসন ও বিচার বিভাগকে কাজ করতে হয়। এরজন্যই বলা হয় সরকারের সব বিভাগ সমক্ষমতাসম্পন্ন নয়, তিনটি বিভাগের মধ্যে আইন বিভাগ বাস্তবে অনেক বেশি ক্ষমতা ভােগ করে।

(১০) জনকল্যাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি: আধুনিক কল্যাণকামী রাষ্ট্রে সরকারকে জনকল্যাণমুখী কাজকর্ম করতে হয়। এরজন্য সরকারের প্রতিটি বিভাগের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য ও সহযােগিতা একান্ত কাম্য। কিন্তু ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রযুক্ত হলে প্রতিটি বিভাগ স্বতন্ত্রভাবে কাজ করবে এবং পরস্পরের মধ্যে ঐক্য ও সহযােগিতা নষ্ট হয়ে যাবে। এর ফলস্বরূপ জনস্বার্থজড়িত কল্যাণমূলক কাজ ব্যাহত হবে।

(১১) সমাজতন্ত্রবাদীদের যুক্তির: সমাজতন্ত্রবাদীরা মনে করেন যে, পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকারের সব বিভাগই ঐক্যবদ্ধভাবে ধনি-বণিক শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করে। তাই এরূপ শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি প্রয়ােগ করে জনগণের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।