ভূমিকা : ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ধরনের আদালতের মধ্যে ক্রেতা আদালত হল এক বিশেষ ধরনের আদালত। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে ক্রেতা বা কনজিউমার বা উপভােক্তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্য ক্রেতা সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা হয়, সেই আইন অনুযায়ী ক্রেতা আদালত গঠিত হয়।

ক্রেতার সংজ্ঞা : কিন্তু ক্রেতা সুরক্ষা আদালত বলতে কী বােঝায়, এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে আমাদের প্রথমে জানতে হবে ক্রেতা কাদেরকে বলে ? সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি যে, কোনাে ব্যক্তি যখন কোনাে ভােগ্যপণ্য বা পরিসেবার জিনিস নগদ মূল্য দিয়ে বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে কেনে তখন তাকে ক্রেতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এখানে মনে রাখতে হবে যদি কোনাে ব্যক্তি ব্যাবসায়িক ভিত্তিতে কোনাে জিনিস ক্রয় করে, তবে সেই ব্যক্তি ক্রেতা হিসেবে বিবেচিত হয় না।

ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের সংজ্ঞা : ভােগবাদী সমাজে জীবনধারণের প্রয়ােজনে মানুষ বিনোদনের তাগিদে বিভিন্ন ভােগ্যপণ্য বা পরিষেবা ক্রয় করে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে সব ভােগ্যপণ্য বা পরিসেবা কি সঠিক গুণমানের বলে চিহ্নিত হয়? এই উত্তরের অন্তরালে লুকিয়ে থাকে অসাধু ব্যবসায়ীদের অসাধু উদ্দেশ্য। সুতরাং যদি কোনাে ক্রেতা কোনাে সামগ্রী ক্রয়ের পর প্রতারিত হয়, তাহলে সেই ক্রেতা সঠিক পরিসেবা পাওয়ার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়। ক্রেতা যাতে সঠিক পরিষেবা পায় তার জন্য ভারত সরকার যে আদালত প্রতিষ্ঠা করেছেন তাকে ক্রেতা সুরক্ষা আদালত (Consumer Court) রূপে চিহ্নিত করা হয়।

ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের গঠন

১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত ক্রেতা সুরক্ষা আইন মােতাবেক ভারতে ক্রেতার স্বার্থ রক্ষার জন্য তিনটি স্তরে তিন ধরনের ক্রেতা আদালত গঠন করা হয়েছে। যথা一

(1) জেলা স্তরের ক্রেতা সুরক্ষা আদালত : রাজ্য সরকার জেলা স্তরের ক্রেতাদের সুরক্ষার স্বার্থে যে সংস্থা গঠন করে, তা জেলা ক্রেতা আদালত নামে পরিচিত। রাজ্য সরকার প্রয়ােজন মনে করলে জেলায় একাধিক ক্রেতা আদালত গঠন করতে পারে। জেলা ক্রেতা আদালত তিন জন সদস্যকে নিয়ে গঠিত। এই সম্মাননীয় সদস্যদের মধ্যে একজন হলেন জেলা জজ। তিনি হলেন জেলা ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের সভাপতি। বাকি দুজন সদস্য হলেন গ্র্যাজুয়েট কোনাে মহিলা বা পুরুষ। প্রত্যেক সদস্যই পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন, অর্থাৎ সদস্যরা ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকতে পারেন। এখানে ২০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দ্রব্যের মূল্য অথবা ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়ে মামলা দায়ের করা যায়। বর্তমান ভারতে ৪৫০ টিরও বেশি জেলা স্তরে ক্রেতা সুরক্ষা আদালত রয়েছে।

(2) রাজ্য স্তরের ক্রেতা সুরক্ষা আদালত : ক্রিস্তরবিশিষ্ট ক্রেতা আদালতের মধ্যবর্তী স্তরটি হল রাজ্য স্তরের ক্রেতা সুরক্ষা আদালত। রাজ্য স্তরে গঠিত সংস্থাটির নাম হল রাজ্য কমিশন বা স্টেট কনজিউমার রিড্রেসাল কমিশন। রাজ্য স্তরে ক্রেতা সুরক্ষা আদালত একজন সভাপতি এবং দুজন সদস্য-সহ মােট তিন জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। এই আদালতে একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন। অন্য দুজন সদস্য হলেন স্নাতক কোনাে মহিলা বা পুরুষ। এই আদালতের প্রত্যেকটি সদস্যই ৬৭ বছর বয়স পর্যন্ত নিজস্ব পদে বহাল থাকেন। এই আদালতে ২০ লক্ষ টাকার উপর কিন্তু ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের দাবি দাখিল করে মামলা দায়ের করা যায়। রাজ্য ক্রেতা আদালত বা রাজ্য কমিশন রাজ্য স্তরেই কাজ করে থাকে। রাজ্য সরকার এই কমিশনের সদস্যদের বেতন, ভাতা ও চাকরির শর্তাবলি স্থির করে থাকে।

(3) জাতীয় স্তরে ক্রেতা সুরক্ষা আদালত : ত্রিস্তরবিশিষ্ট ক্রেতা আদালতের সর্বোচ্চ স্তরটি হল জাতীয় স্তর। এই স্তরের আদালতের নাম হল জাতীয় ক্রেতা বিরােধ নিষ্পত্তি কমিশন, যা জাতীয় কমিশন নামে পরিচিত। জাতীয় ক্রেতা আদালত জাতীয় স্তরে কাজ করে। জাতীয় ক্রেতা আদালত বা কমিশন পাঁচ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। এরমধ্যে একজন সদস্য সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত হন এবং অপর চার জন শুধুমাত্র সদস্যরূপে নিযুক্ত হন। এই চার জন সদস্যকে কমপক্ষে ৩৫ বছর বয়স্ক ও গ্র্যাজুয়েট হতে হবে। এদের মধ্যে মহিলা সদস্য হিসেবে একজন নিযুক্ত হবেন। এই আদালতের সদস্যরা ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকতে পারে। এক কোটি টাকার বেশি ক্ষতিপূরণের দাবি জানালে জাতীয় কমিশনে মামলা দায়ের করা যায়। মূলত কেন্দ্রীয় সরকারই জাতীয় কমিশনের সদস্যদের বেতন ও চাকরির শর্তাবলি নির্ধারণ করে থাকে।

ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের উদ্দেশ্য

দেওয়ানি, ফৌজদারি বা লােক আদালতের থেকে ক্রেতা আদালত এক সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির আদালত রূপে চিহ্নিত হয়। ক্রেতা আদালতের মূল উদ্দেশ্য ক্রেতাদের সুরক্ষা প্রদান। এই আদালতের অন্যান্য প্রধান উদ্দেশ্যগুলি হল一

  • কোনাে বিক্রেতা পণ্য বিক্রয়ের বা পরিষেবা প্রদানে অসাধু উপায় অবলম্বন করলে।
  • বিধিবদ্ধ পরি সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ত্রুটিবিচ্যুতি দেখা দিলে।
  • বিক্রেতা ন্যায্যমূল্যের বেশি দাবি জানালে।
  • কোন আইনের দ্বারা নির্ধারিত নির্দিষ্ট মূল্যের গুরুত্ব না দিলে।
  • ক্রেতাদের যথাযথভাবে শিক্ষিত করে তুললে।
  • ন্যায্য মূল্য নিয়ে সময় উত্তীর্ণ কোনাে পরিষেবা ক্রেতাকে প্রদান করা হলে।

এককথায় কোনাে ক্ষতিগ্রস্ত ক্রেতার অভিযােগের আইনসম্মত প্রতিকার বা নিষ্পত্তি বিধানই হল ক্রেতা আদালতের প্রধান উদ্দেশ্য।

ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের বৈশিষ্ট্য

ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের নিজস্ব কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি তাকে অন্যান্য আদালত থেকে পৃথক মর্যাদাদানে সাহায্য করেছে। যেমন一

(1) ত্রিস্তরে বিন্যস্ত : ক্রেতারা বিক্রেতার নিকট থেকে ক্রয় করা পণ্যের বিরুদ্ধে অভিযােগ করলে, সত্বর তা প্রতিবিধানের জন্য ক্রেতা সুরক্ষা আইন ত্রিস্তরীয় একটি ব্যবস্থা অবলম্বন করে। ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থার শীর্ষেরয়েছে জাতীয় ক্রেতা আদালত বা জাতীয় কমিশন, মধ্যবর্তী স্তরে রয়েছে রাজ্য ক্রেতা আদালত বা রাজ্য কমিশন এবং নিম্নস্তরে রয়েছে জেলা ক্রেতা আদালত। ক্রেতাদের অকারণ জটিলতার হাত থেকে মুক্ত করার জন্যই এই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

(2) অভিযােগকারীর নালিশ জানানাের কতকগুলি কারণ : ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে ক্লেতারা অভিযােগ জানায় কতকগুলি কারণের ভিত্তিতে, যথা— (a) ব্যবসায়ী, ব্যবসায়ের সঠিক প্রথা অনুসরণ করে অসৎ বা অবৈধ পথে ব্যাবসা করলে পণ্য বিনষ্ট হতে পারে, (b) পণ্যের প্যাকেটের উপর যে দাম লেখা থাকে, বিক্রেতা তার থেকে চড়া দামে কোনাে পণ্য বিক্রি করলে, (c) পণ্য ত্রুটিযুক্ত হলে, (d) যে ধরনের সেবা দানে বিক্রেতা অঙ্গীকারবদ্ধ তা রক্ষিত হলে ক্রেতাগণ ক্রেতা সুরক্ষা আইন অনুসারে অভিযােগ দাখিল করতে পারে।

(3) আইন বিশেষজ্ঞদের প্রয়ােজন নেই : ক্রেতারা এইরূপ আদালতে এককভাবে নালিশ জানানাের অধিকার ভোগ করে থাকে। অর্থাৎ অভিযােগপত্র দাখিল করার জন্য কোন আইন বিশেষজ্ঞের প্রয়ােজন হয় না। অভিযােগকারী ক্রেতা নিজেই তার মামলা পরিচালনা করতে পারে। ক্রেতা সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে ক্রেতাদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য অসৎ ব্যবসায়ীদেরও শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তা ছাড়া রাজ্য স্তরে ও জাতীয় স্তরে স্বেচ্ছাসেবী ক্রেতা আদালত গঠন করা হয়। ক্রেতা আন্দোলনের সঙ্গে ক্রেতা বা কনজিউমারদের যােগাযােগ স্থাপন করা হয়।

(4) ক্রেতা সুরক্ষা আইনের প্রয়ােগ : সকল প্রকার পণ্য ও পরিষেবার ক্ষেত্রে এই আইন প্রয়ােগ করা হয়। কেন্দ্রীয় সরকার গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কোনাে পণ্য ও পরিষেবা এর অন্তর্ভুক্তি থেকে অব্যাহতি দিতে পারে। তা ছাড়া এই আইন অনুযায়ী, ব্যক্তিগতভাবে কোনাে ক্রেতা, কোনাে কোম্পানি আইন দ্বারা রেজিস্ট্রিকৃত কোনাে সমিতি, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার, ক্রেতা স্বার্থবিরােধী কাজের জন্য অভিযােগ দায়ের করতে পারে। কোনাে ক্রেতার যদি মৃত্যু হয়, তবে তার উত্তরাধিকারী বা প্রতিনিধি উক্তু অভিযােগ পেশ করতে পারে।

(5) ক্রেতা আদালতের নির্দেশ আপিলযােগ্য : অধস্তন ক্রেতা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন ক্রেতা আদালতে আপিল করার অধিকার ক্রেতাদের রয়েছে। এমনকি সর্বোচ্চ ক্লেতা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধেও সুপ্রিমকোর্টে আপিল করা যায়।

ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের ক্ষমতা ও কার্যাবলি

(1) সকল প্রকার পণ্য ও পরিষেবা ক্ষেত্রে ক্রেতা আদালত কাজ করে। তবে কোনাে কোনাে পরিষেবা কেন্দ্র বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এই আইনের বাইরে রাখতে পারে। অর্থাৎ ক্রেতা আদালতকে নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে থেকেই কাজ করতে হয়।

(2) ক্রেতা আদালতে দেওয়ানি, ফৌজদারি ও ভারতীয় দণ্ডবিধি প্রয়ােগের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কোন সাক্ষীকে হাজির হতে বলা, প্রতিপক্ষকে সমন জারি, সাক্ষীকে হলফনামা পেশ করতে বলা প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।

(3) ক্রেতা সুরক্ষা আইনে ২৫ নং ও ২৭ নং ধারা অনুসারে ক্রেতা আদালতের আদেশ অমান্য করলে বা আদেশ মানতে ব্যর্থ হলে আদেশ অমান্যকারীর জেল ও জরিমানা দুটোই হতে পারে।

পরিশেষে বলা যায় যে, উপরোক্ত আলােচনার মাধ্যমে ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের গঠন, উদ্দেশ্য, বৈশিষ্ট্য, ক্ষমতা ও কার্যাবলি সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের যতটা সম্ভব অবগত করার চেষ্টা করা হয়। বর্তমানে ক্রেতাদের সুরক্ষার্থে এই আদালত যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

লোক আদালত গুলোর উদ্দেশ্য, গঠন ও কার্যাবলি বা কার্যপদ্ধতি | লােক আদালতের ধারণা

লোক আদালত বলতে কী বোঝায়? লােক আদালতের সঙ্গে সাধারণ আদালতের পার্থক্য | লােক আদালতের উপযােগিতা/সুবিধা

ভারতের বিচারব্যবস্থা জনস্বার্থ বিষয়ক মামলার গুরুত্ব আলােচনা করাে।