দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে জার্মানির আক্রমণের চাপে মিত্রশক্তির দেশগুলি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। ভারতেও জাপানের আক্রমণের প্রবল সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই জটিল পরিস্থিতিতে ভারতের ব্রিটিশ সরকার ভারতবাসীর আর্থিক ও সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। যদিও কংগ্রেস এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়, ফলে এক রাজনৈতিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। এই পরিস্থিতিতে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে ক্রিপস মিশন ভারতে আসে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) ও এক প্রস্তাব পেশ করে যা ক্রিপস প্রস্তাব নামে পরিচিত।
স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে এক সপ্তাহ ধরে আলােচনার পর ২৯ মার্চ একগুচ্ছ প্রস্তাব রাখেন, যা ‘ক্রিপস প্রস্তাব’ নামে পরিচিত।
-
[1] যুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরেই ভারতে একটি যুক্তরাষ্ট্র (Union) প্রতিষ্ঠা করা হবে।
-
[2] ওই যুক্তরাষ্ট্রকে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনাধিকার ডােমিনিয়ন-এর মর্যাদা দান করা হবে।
-
[3] যুদ্ধশেষে ভারতীয় প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ রচিত সংবিধান প্রবর্তন করা হবে।
-
[4] অবিলম্বে ভারতীয় নেতৃবৃন্দকে বড়ােলাটের শাসন পরিষদে অংশগ্রহণ ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলিতে প্রতিনিধি হিসেবে যােগদানের সুযােগ দেওয়া হবে।
-
[5] সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার জন্য স্বতন্ত্র সংবিধান চালু হবে।
-
[6] গণপরিষদ রচিত সংবিধান কোনাে প্রদেশের পছন্দ না হলে সেই প্রদেশটি ভারতীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে নতুন সংবিধান রচনা করতে পারবে।
-
[7] সংবিধান রচিত না হওয়া পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে। বিনিময়ে তারা ভারতের সম্পদ যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করবে।
২৯ মার্চ (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) এক সাংবাদিক সম্মেলনে ক্রিপস যেমন খসড়া প্রস্তাবগুলি সর্বজন-সম্মুখে পেশ করেছিলেন, ঠিক তেমনি ১১ এপ্রিল আর-এক সাংবাদিক সম্মেলনে সেগুলি সরাসরি প্রত্যাহার করে নিয়ে লন্ডন যাত্রা করেন।
[1] পূর্ণ স্বাধীনতাদানের অনুল্লেখ: এই প্রস্তাবটিতে পূর্ণ স্বাধীনতা-দানের কোনাে উল্লেখ ছিল না। ব্রিটিশ সরকার, বিশেষত চার্চিলের অনিচ্ছুক মনােভাব এই প্রস্তাবকে ব্যর্থ করেছিল। তিনি কখনোই চাননি ভারত স্বাধীন হােক। আসলে এটি ছিল লােক-দেখানাে কৌশলমাত্র।
[2] সংবিধান সভাকেন্দ্রিক সমস্যা: ক্রিপস প্রস্তাবগুলিতে সংবিধান সভায় ভারতীয় প্রতিনিধিদের সরাসরি নির্বাচনের দ্বারা নিয়ােগের কথা কিছু বলা হয়নি। এ ছাড়াও এই প্রস্তাবে সংবিধান সভাকে সার্বভৌম ক্ষমতা না দেওয়ায় হিন্দু মহাসভা, লিবারেল পার্টি প্রভৃতি দলও ক্রিপস প্রস্তাবের কঠোর সমালােচনা করে।
[3] ভারত বিভাজনের ইঙ্গিত: ক্রিপস প্রস্তাবে দেশীয় রাজ্যগুলির ৯ কোটি মানুষের ভাগ্য দেশীয় রাজন্যবর্গের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। যা আসলে প্রচ্ছন্নভাবে ভারত বিভাজনেরই ইঙ্গিত দেয়। তাই জাতীয় কংগ্রেস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরােধিতা করে। গান্ধিজি এই প্রস্তাবের সমালােচনা করে বলেন- “এই প্রস্তাবটি ছিল একটি ফেলপড়া ব্যাংকের ওপর একটি আগামী তারিখের চেক কাটার শামিল”(A post dated cheque on a crashing bank)
[4] সর্বজনীন গ্রহণযােগ্যতার অভাব: ভারতের বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠীগুলির কাছে অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, মুসলিম, অনুন্নত সম্প্রদায়- কারও কাছেই এই প্রস্তাব গ্রহণযােগ্য ছিল না। তাই এই প্রস্তাব ব্যর্থ হয়েছিল।
Leave a comment