ক্রান্তীয় অঞ্চলের দুর্বল ঘূর্ণিঝড়কে ক্রান্তীয় ডিপ্রেসন বলে। এই ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় 40 কিলােমিটারের কম। এর নিম্নচাপ কেন্দ্রটি কয়েকটি সমপ্রেষরেখা দ্বারা আবদ্ধ। সমপ্রেষরেখাগুলি বহু দূরে দূরে অবস্থিত। বায়ুর চাপীয় ঢাল অতি মৃদু। তাই বাতাসের গতিবেগ এই ঝড়ে খুবই কম। আন্তঃক্রান্তীয় অঞ্চলে (ITCZ) এই প্রকার ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা খুব বেশি এবং আয়ন বায়ু বলয়ে এর সংখ্যা খুবই কম।
ক্রান্তীয় প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব প্রান্তে পেরু, ইকুয়েডরের পশ্চিম উপকূল দিয়ে কোনাে কোনাে বছর ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে, বিশেষত ক্রিসমাসের সময় যে দক্ষিণমুখী উয় স্রোত প্রবাহিত হয়, তাকে এল নিনাে বলে।
ক্রান্তীয় প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বভাগে সাধারণত গভীর সমুদ্র থেকে ঠান্ডা জল ওপরে ওঠে। (Upwelling) বলে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কম (প্রায় 20 °সে.) থাকে এবং ওখানকার বায়ুমণ্ডলে তাই উচ্চচাপ বিরাজ করে।
কিন্তু কোনাে কোনাে বছর ক্রিসমাসের কাছাকাছি সময় ওখানকার সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে। আর তার ফলে ওখানে বায়ুর উয়তা তথা আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায় এবং বায়ুর চাপ কমে গিয়ে বায়ুমণ্ডলের স্থিতাবস্থা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে যায়।
এইভাবে ক্রান্তীয় প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বভাগে সমুদ্রপৃষ্ঠের উন্নতা বৃদ্ধি ও তার ফলে ওখানকার আবহাওয়ায় যে অস্বাভাবিক পরিবর্তন হয়, সেই সমগ্র ঘটনাকে এল নিনােনামে অভিহিত করা হয়। সাধারণত পেরুইকুয়েডরের উপকূলে 2 থেকে 7 বছর অন্তর একবার করে এই ধরনের অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে এবং এর স্থায়িত্বকাল হয় 9 মাস থেকে 2 বছর পর্যন্ত।
বায়ুমণ্ডলের স্বাভাবিক অবস্থায় নিরক্ষীয় অঞ্চল বরাবর সমুদ্রপৃষ্ঠে জলের উয়তা থাকে প্রায় 27 °সে.-30 °সে.। প্রায় 100 মিটার গভীরতায় ওপরের উয় জল (30 °সে.) ও এর নীচে শীতলতর (20 °সে.) জলপুঞ্জের মধ্যে এক বিভেদ তল লক্ষ করা যায়। এটি থার্মোক্লাইন নামে পরিচিত।
বায়ুমণ্ডলের স্বাভাবিক অবস্থায় নিরক্ষরেখা বরাবর প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্ব উপকূলে পেরু স্রোতের শীতল জলরাশি উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব আয়ন বায়ু দ্বারা পশ্চিম দিকে সঞ্চালিত হয়। পশ্চিমদিকে জল ক্রমশ সরে যাওয়ায় ওই জায়গায় নীচ থেকে শীতল জল ওপরে উঠে আসে। পূর্ব উপকূলের ওই ভারী ঠান্ডা জল আগত সূর্যরশ্মির দ্বারা তুলনামূলকভাবে বেশি উত্তপ্ত হতে পারে না। অর্থাৎ জলের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য উয়তা (Sensible Temperature) কম হয়। কিন্তু ওই জল বায়ু তাড়িত হয়ে যতই মহাসাগরের পশ্চিমদিকে যেতে থাকে ক্রমাগত সূর্যরশ্মি গ্রহণে তা ধীরে ধীরে ততই উত্তপ্ত হতে থাকে।
এভাবে ক্রমাগত বিরামহীন উয় জলের সঞ্চয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম উপকূল অঞ্চলে এক বিশাল উয় জলক্ষেত্র (Pool of Warm Water) সৃষ্টি হয়। জলরাশির পুঞ্জীভবনের ফলে পশ্চিম উপকূলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা পূর্ব-উপকূল অপেক্ষা 1 মিটার বা তার চেয়েও বেশি হয়। ঠিক এ অবস্থায় এই অংশে থার্মোক্লাইনের গভীরতা হয় প্রায় 200 মিটার। অপরপক্ষে পূর্ব উপকূলে থার্মোক্লাইন প্রায় সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থান করায় পাতলা হয়ে আসে। তাই শীতল পেরুস্রোতের শীতল জল উয় জলের আবরণকে সরিয়ে সহজে ওপরে উঠে আসে।
জলের সমােচ্চশীলতা ধর্মের জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম উপকূলের জলরাশি থার্মোক্লাইন অনুসরণ করে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে নিরক্ষীয় অন্তঃস্রোতরূপে প্রবাহিত হয়। এই প্রক্রিয়া ততক্ষণ চলতে থাকে যতক্ষণ না প্রশান্ত মহাসাগরের উভয় উপকূলের সমুদ্রতলের উচ্চতা ও থার্মোক্লাইনের গভীরতা সমান হয়। পূর্ব উপকূলে থার্মোক্লাইনের গভীরতা বৃদ্ধি পেলে পেরু স্রোতের শীতল জলরাশি উয় জলরাশির আবরণকে ঠেলে ওপরে উঠে আসতে পারে না। তাই পূর্ব উপকূলে নিম্নচাপ এবং পশ্চিম উপকূলে উচ্চ চাপের সৃষ্টি হয়। বায়ুচাপের বিপরীতমুখী অবক্রমের ফলে বাতাস প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম উপকূল থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। বায়ু তাড়িত উয় জলরাশি পূর্ব উপকূলে পৌছে দক্ষিণমুখী হয়ে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল বরাবর প্রবাহিত হয়।
-
এল নিনাের প্রভাবে নিরক্ষরেখার যেখানে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয় সেখানকার আকাশে বজ্র মেঘের সঞ্চার ঘটে। এল নিনাের প্রভাবে পেরু ও ইকুয়েডরে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ফলে বন্যার সৃষ্টি হয়।
-
আমাজন নদী অববাহিকা, কলম্বিয়া, মধ্যে আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় শুষ্ক আবহাওয়া বিরাজ করে। ফলে দাবানলের সৃষ্টি হয়।
-
দক্ষিণ-মধ্য আফ্রিকায় এল নিনাের আবির্ভাবের বছরে ডিসেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত শুষ্কতর আবহাওয়া লক্ষ করা যায়।
-
এল নিনাের আবির্ভাবের পর উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার গ্রীষ্মকালের অর্ধেকের বেশি সময় বাতাসের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি থাকে।
-
দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর আবির্ভাবের সাথে সাথে ভারতীয় মৌসুমি বায়ুর এক গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এল নিনাের বছরগুলিতে অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভারতে খরা এবং পেরু-চিলির শুষ্ক মরুভূমিতে অতি বৃষ্টির ফলে বন্যা হয়। 1997 খ্রিষ্টাব্দের শেষ ভাগ থেকে আজ পর্যন্ত এল নিনাের প্রভাবে প্রায় 16, 000 লােক প্রাণ হারিয়েছে।
-
স্বাভাবিক বছরগুলিতে ইকুয়েডর ও পেরুর শুষ্ক জলবায়ু অঞ্চলে যেখানে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ থাকে 10-13 সেমি, সেখানে এল নিনাের সময় এই অঞলে 300 থেকে 400 সেমি বৃষ্টিপাত ঘটে থাকে। ফসলের উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে যায় এবং অর্ধ শুষ্ক অঞ্চলগুলি সবুজ ঘাসে ভরে ওঠে।
-
এল নিনাের ফলে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে উয় স্রোত প্রবাহিত হওয়ায় মাছের খাদ্য নষ্ট হয়। ফলে মৎস্য আহরণ কমে যায় এবং মৎস্যজীবীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
Leave a comment