প্রশ্নঃ কোরেশী মাগন ঠাকুরের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তরঃ আরাকানরাজের (১৬৩৮-৪৫) অমাত্য হিসেবেই মাগন ঠাকুরের (১৬০০-১৬৬০ খ্রিঃ) সাথে আমাদের পরিচয়। তার পিতা শ্রীবড় ঠাকুর এবং তিনিও ছিলেন রাজার অমাত্য। কবি কোরেশী মাগন ঠাকুরের প্রপিতামহ ছিলেন আরব থেকে আগত কোরেশ। তিনি গৌড় হয়ে চট্টগ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এখানেই মাগন ঠাকুরের জন্ম। মাগন ঠাকুরের পিতা রোসাঙ্গে গিয়ে রাজকর্মচারীর পদ পান।

রাজা তার কুমারী কন্যার অভিভাবক করেন মাগনকে। পিতার মৃত্যুর পর কন্যাটিকে মাগণ ঠাকুর রাজভ্রাতুষ্পুত্র সাউদের সাথে বিয়ে দেন। কৃতজ্ঞতাবশত রাজদম্পতি মাগন ঠাকুরকে মুখ্যমন্ত্রী বা মহামাত্য করেন।

মাগন ঠাকুর ছিলেন বিদগ্ধ পণ্ডিত। তিনি আরবি, ফারসি, বর্মি, বাংলা প্রভৃতি ভাষা জানতেন। কাব্য, নাটক ও সাহিত্যে তার ব্যুৎপত্তি ছিল। তিনি সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। আহত আলাওল যখন হার্মাদদের এড়িয়ে রোসাঙ্গে আশ্রিত হন, তখন মাগণ ঠাকুর তাকে রাজ অশ্বারোহীর পদ দিয়ে সাহায্য করেন। পরে আলাওলকে বিভিন্ন কলাবিদরূপে জানতে পেরে তাকে সংগীত শিক্ষক বা কাব্যগুরু হিসেবে গ্রহণ করেন এবং অশ্বারোহী পদ ছাড়িয়ে আলাওলকে কাব্য অনুবাদে আত্মনিয়োগ করান। মাগণ ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় আলাওল ‘পদ্মাবতী’ (১৬৫১) এবং ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’ রচনা আরম্ভ করেন (১৬৫৮)।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসে মধ্যযুগে আরাকান রাজসভাকে ঘিরে বেশ কিছু সাহিত্য রচিত হয়। এ সাহিত্য রচনায় যারা পৃষ্ঠপোষক ছিলেন, তার মধ্যে মাগণ ঠাকুর অন্যতম। মাগণ ঠাকুর নিজেও নানা শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন এবং কেবল কাব্য রচনায় তিনি পৃষ্ঠপোষকতাই করেন নি, নিজেও রচনা করেছেন ‘চন্দ্রাবতী’ নামে একখানি রোমান্টিক উপাখ্যান। তার এ কাব্যটি দেশি রূপকথাভিত্তিক। চন্দ্রাবতীতে রূপকথার উপাদান যেমন আছে, তেমনি আছে প্রণয় কাব্যের দেশি-বিদেশি সব উপাদান।

কবিত্বে পাণ্ডিত্যে মাগণ ঠাকুর প্রথম শ্রেণীর একজন নন বটে, তবে তার ভাষা সুন্দর ও সুবিন্যস্ত, ভঙ্গি ঋজু এবং কাব্যটি বিভিন্ন রসের ও বিচিত্র ঘটনার সমাবেশের দরুন সুখপাঠ্য। দেশি ঐতিহ্যসম্মত উপকরণে ও আদর্শে তিনি সুপ্রাচীন দৈশিক রীতিতে নিৰ্মাণ করেছেন তার কাব্যসৌধ।

তবে একথা অনস্বীকার্য যে কবি হিসেবে আমাদের কাছে নন্দনীয় না হলেও আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য চর্চার প্রসঙ্গে মাগণ ঠাকুর অনস্বীকার্য ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তারই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ও আন্তরিকতায় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে একটি বিশেষ শাখা ঋদ্ধ হয়েছে। ফলে যুগপৎ কবি ও কবিদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তার নাম বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা হয়েছে।