সূচনা: কোরিয়া যুদ্ধে ভারত এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জওহরলাল নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বে ভারত সরকার কোরিয়া সমস্যায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিশ্বের দরবারে প্রশংসিত হয়।
[1] যুদ্ধবিরতি ঘােষণায়: দুই কোরিয়ার মধ্যে সমস্যার সূচনা লগ্নেই তা সমাধানের উদ্দেশ্যে জাতিপুঞ্জ ৯ জন সদস্যের একটি অস্থায়ী কমিশন (United Nations Temporary Com mission on Korea বা UNTCOK) গঠন করে। যার সভাপতি ছিলেন, বিশিষ্ট ভারতীয় কূটনীতিবিদ কে.পি.এস. মেনন। প্রতিবেদনে মেনন বৃহৎ শক্তিবর্গকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই সমস্যা মিটিয়ে নেবার আহবান জানান এবং তা না হলে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে সাবধান করে দেন। এই কমিশনের দায়িত্ব ছিল শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে কোরিয়ায় একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা। অবশেষে ভারতের অদম্য প্রচেষ্টায় ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জুলাই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছিল।
[2] যুদ্ধবন্দি সমস্যায়: যুদ্ধ শেষে যুদ্ধবন্দি সমস্যার সমাধানের জন্য ভারতের জেনারেল থিমাইয়ার সভাপতিত্বে গঠিত হয় ‘নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের প্রত্যাবাসন কমিশন (Neutral Nations Repatriation Commission)। নিরপেক্ষ রাষ্ট্রজোটের এই কমিশন ঘােষণা করে যেㅡ
-
[a] স্বদেশে ফিরতে না চাওয়া যুদ্ধবন্দিরা নিরপেক্ষ দেশে বাস করতে পারবেন।
-
[b] স্বদেশে ফিরতে অনিচ্ছুক যুদ্ধবন্দিরা বেসামরিক ব্যক্তিরূপে চিহ্নিত হবেন। অনিচ্ছুক ও বেসামরিক ১৫ হাজার যুদ্ধবন্দি ফরমােজা (তাইওয়ান) এবং ৭ হাজার উত্তর কোরিয়ান যুদ্ধবন্দি দক্ষিণ কোরিয়ায় বসবাস করতে পারবেন।
-
[c] যুদ্ধবন্দিদের ৬০ দিনের মধ্যে নিজ নিজ দেশে ফেরৎ পাঠাতে হবে। কমিশনের এই ঘােষণায় যুদ্ধবন্দি সমস্যার সন্তোষজনক মীমাংসা হয়।
[3] শান্তির প্রতি দায়বদ্ধতায়: দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে ভারতও উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী বলে চিহ্নিত করে। তবে কোরিয়া সমস্যার সমাধানে তৃতীয় কোনাে পক্ষের হস্তক্ষেপের প্রস্তাবে ভারত প্রতিবাদ জানায়। ভারত জানায়, এতে কোরিয়া সমস্যা আরও জটিল হবে। ভারতের লক্ষ্য ছিল যুদ্ধের কর্মসূচি থেকে উভয়পক্ষকে সরিয়ে শান্তির পথে নিয়ে আসা। এই প্রতিবাদে শান্তির প্রতি ভারতের দায়বদ্ধতা সুস্পষ্ট হয়।
[4] মার্কিন আগ্রাসনের বিরােধিতায়: তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক রাষ্ট্রসংঘকে তাঁবেদার সংগঠনে পরিণত করার প্রচেষ্টাকে সমালােচনা করেন। তিনি এ ব্যাপারে স্পষ্ট ভাষায় ভারতের উদ্দেশ্য বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন ভারত স্থায়ীভাবে নিরপেক্ষ নয়; জোটবদ্ধ তাে নয়ই। উত্তর কোরিয়ার বিরােধিতা করার অর্থ পশ্চিমি দেশগুলিকে তােষণ করা নয়।
[5] চিন-কোরিয়া যুদ্ধবিরতিতে: জাতিপুঞ্জের শান্তিরক্ষা বাহিনী উত্তর কোরিয়া দখলের পর চিন সীমান্তে ইয়ালু নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে বােমাবর্ষণ শুরু করলে সােভিয়েত মদতপুষ্ট চিনের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী জাতিপুঞ্জের বাহিনীর ওপর পালটা আক্রমণ করে। চিনা বাহিনী দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওল দখল করে নিলে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি টুম্যান সেনাপতি জেনারেল ম্যাক আর্থারকে বরখাস্ত করে চিনের সঙ্গে সমঝােতা চায়। অবশেষে সােভিয়েতের মধ্যস্থতায় উভয়ের মধ্যে যে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব আসে ভারত তাতে সমর্থন জানায়। ভারতের সভাপতিত্বে একটি নিরপেক্ষ কমিশনের ওপর দুই দেশের বন্দি বিনিময় দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইতিপূর্বে জাতিপুঞ্জে চিনকে আক্রমণকারী বলে অভিহিত করে একটি প্রস্তাব পাস হলে ভারত তার বিরােধিতা করে।
[6] জোটনিরপেক্ষতার সুদৃঢ়করণে: ভারত যে জোটনিরপেক্ষ নীতির প্রতি আন্তরিকভাবে বিশ্বাসী তা কোরিয়ার যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা থেকে পরিস্ফুট হয়। ভারতের জোটনিরপেক্ষতার মধ্যে যে কোনাে খাদ নেই, তা বােঝা যায় যখন নেহরু সরকার প্রথমে উত্তর কোরিয়াকে আক্রমণকারী দেশ হিসেবে ঘােষণা করে এবং পরে মার্কিন নীতির সমালােচনা করে।
[7] পরস্পরবিরােধী সমালােচনা:
-
[i] কোরিয়া যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার লক্ষ্যে ভারতের ভূমিকাকে চিন ও রাশিয়া পশ্চিমি তােষণ বলে সমালােচনা করে। আবার,
-
[ii] আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশ কোরিয়ার সমস্যায় ভারতের ভূমিকাকে কমিউনিস্ট তােষণ বলে সমালােচনা করে।
উপসংহার: কোরিয়ার সংকট বা কোরিয়া যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা ভারত মনেপ্রাণেই চেয়েছিল। ভারতের এই আন্তরিক, সৎ ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পরােক্ষভাবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে উৎসাহিত করেছিল।
Leave a comment