[1] জাপানি আক্রমণ প্রতিরােধ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন (১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর) জাপান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবারে অবস্থিত মার্কিন যুদ্ধ জাহাজ ধ্বংস করে অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধে যােগদান করলে বিশ্বরাজনীতিতে এক গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। একে একে ফিলিপিনস, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া, মালয় ও বদেশ বিধ্বস্ত করে (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ) জাপান ভারতের নিকটে এসে হাজির হয়। এই পরিস্থিতিতে জাপানি আক্রমণের মােকাবিলায় ভারতবাসীর সক্রিয় সাহায্য লাভের আশায় ব্রিটিশ সরকার ব্যগ্র হয়ে ওঠে।
[2] প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দের চাপ: মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট, ব্রিটেনের শ্রমিক দলের (Labour Party) নেতা ক্লিমেন্ট এটলি ও অন্যান্য ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ যুদ্ধে ভারতীয়দের সাহায্য নেওয়ার কথা বলেন। ভারতবাসীকে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা প্রদানের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি ঘােষণার জন্য তারা ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের চাপ দেন। চিনের রাষ্ট্রপতি চিয়াং কাই শেকও ভারতীয়দের স্বাধীনতার দাবিকে সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনার জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলকে অনুরােধ জানান।
[3] ভারতের শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে ব্রিটিশবিরােধী গণবিদ্রোহ শুরু হলে শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা দেখা দেয়। অপরদিকে, মিত্রপক্ষভুক্ত ব্রিটিশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে তার ঔপনিবেশিক শক্তিকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিলে ভারতের সহযােগিতার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে। এই লক্ষ্য নিয়েই যুদ্ধকালীন ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য, বিশিষ্ট সমাজসেবী ও খ্যাতনামা আইনজ্ঞ স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস তার একগুচ্ছ প্রস্তাব নিয়ে ভারতে আসেন।
২৯ মার্চ (১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ) এক সাংবাদিক সম্মেলনে ক্রিপস যেমন খসড়া প্রস্তাবগুলি সর্বজন সম্মুখে পেশ করেছিলেন, ঠিক তেমনই ১১ এপ্রিল আর এক সাংবাদিক সম্মেলনে সেগুলি সরাসরি প্রত্যাহার করে নিয়ে লন্ডন যাত্রা করেন।
[1] কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া: দেশবিভাগের সম্ভাবনাকে প্রশয় দেওয়ায় ক্রিপস প্রস্তাবের তীব্র বিরােধিতা করে কংগ্রেস তা প্রত্যাখ্যান করে।
[2] মুসলিম লিগের প্রতিক্রিয়া: লিগের প্রতিক্রিয়া ছিল অবশ্য দু-রকমের সন্তোষজনক, আবার হতাশাব্যঞ্জক। প্রদেশগুলিকে ভারত যুক্তরাষ্ট্রে যােগ দেওয়া বা না দেওয়ার স্বাধীনতা দেওয়ায় লিগ খুশি হলেও স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের, অর্থাৎ পাকিস্তান দাবি স্বীকৃত না হওয়ায় লিগ ক্রিপস প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
[3] শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া: ভারতীয় শিখ সম্প্রদায়ও ক্রিপস প্রস্তাব মেনে নিতে পারেনি। তাদের আশঙ্কা ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঞ্জাব ভারত থেকে আলাদা হয়ে গেলে শিখদের স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়বে।
[4] হরিজন সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া: হরিজন সম্প্রদায়ের নেতা আম্বেদকর এই ভেবে অসন্তোষ প্রকাশ করেন যে, ক্রিপস প্রস্তাব কার্যকরী হলে বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
[5] ইঙ্গ-ভারতীয় ও ভারতীয় খ্রিস্টানদের প্রতিক্রিয়া: ইঙ্গ ভারতীয় ও ভারতীয় খ্রিস্টান প্রভৃতি সম্প্রদায়ও এই প্রস্তাবের ফলে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার অভাব বােধ করে।
সমকালীন ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি ক্রিপস প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করায় এই প্রস্তাব শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। আসলে ভারতের বিভিন্ন জাতিগােষ্ঠীগুলির কাছে অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, মুসলিম, অনুন্নত সম্প্রদায় কারুর কাছেই এই প্রস্তাব গ্রহণযােগ্য ছিল না। তাই গান্ধিজি এই প্রস্তাবের সমালােচনা করে বলেন- “এই প্রস্তাবটি ছিল একটি ভেঙে পড়া ব্যাংকের ওপর আগামী তারিখের চেক কাটার শামিল” (A postdated cheque on a crashing bank)
Leave a comment