[1] মর্লে-মিন্টো শাসনসংস্কারের ব্যর্থতা: মর্লে-মিন্টো সংস্কার (১৯০৯ খ্রি.) একদিকে যেমন ভারতবাসীর আশা পূরণ করতে পারেনি তেমনই অন্যদিকে কংগ্রেসের নরমপন্থী বা চরমপন্থী কারােরই মন জয় করতে পারেনি। আসলে এই আইন প্রবর্তনের নেপথ্যে ছিল ব্রিটিশ শাসনের প্রতি মুসলিমদের সমর্থন আদায়ের দুরভিসন্ধি।
[2] স্বায়ত্তশাসন বিষয়ক বিক্ষোভ প্রশমন: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর ব্রিটিশ সরকার তার পূর্বকথা মতাে ভারতবাসীকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ফিরিয়ে দেয়নি। এর ফলে ভারতবাসীর মনে যে তীব্র ক্ষোভ জন্মেছিল তা প্রশমনের প্রয়ােজন ছিল।
[3] নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের বিবাদের অবসান: ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের সুরাট বিচ্ছেদ-এর পর চরমপন্থীরা জাতীয় কংগ্রেস থেকে দূরেই ছিলেন। এরপর নির্বাসন থেকে ফিরে তিলক অনুধাবন করেন যে, চরমপন্থী ও নরমপন্থীদের মিলন ছাড়া জাতীয় অগ্রগতি অসম্ভব। তাই ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের লক্ষৌ অধিবেশনে চরমপন্থীরা যােগদান করলে জাতীয় কংগ্রেস আবার প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
[4] কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের ঐক্য: বঙ্গভঙ্গ রদ, তুরস্কের ওপর ইটালির আক্রমণ, বলকান যুদ্ধ এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধযাত্রা ভারতীয় মুসলিমদের ক্ষুম্ধ করে তােলে। এই সময় মুসলিম লিগের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। নতুন মুসলিম নেতৃত্ব আলিগড়ের সংকীর্ণ রাজনীতি বিসর্জন দিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে সহযােগিতার নীতি গ্রহণ করে। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেসের লক্ষ্ণৌ অধিবেশনে যােগ দিয়ে লিগ-নেতৃত্ব জাতীয় কংগ্রেসের ‘স্বরাজ’ এর আদর্শ মেনে নেয় এবং যৌথভাবে জাতীয় আন্দোলন পরিচালনায় সম্মত হয়।
[5] হােমরুল আন্দোলনের তীব্রতা: লক্ষ্র চুক্তি (১৯১৬ খ্রি.) স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তিলক ও বেসান্তের নেতৃত্বে আলাদা আলাদা হােমরুল আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনের তীব্রতায় ব্রিটিশের মনােভাবে পরিবর্তন ঘটে। ভাইসরয় চেমসফোর্ড ভারত সচিবকে টেলিগ্রাম করে জানান যে, হােমরুল আন্দোলন ভারতবাসীর ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
[6] আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির প্রভাব: রাশিয়ায় ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণির সাফল্য ভারতবাসীকে যেভাবে জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ করে তুলেছিল তাতে ব্রিটিশ সরকার ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া আমেরিকা-সহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ তাদের উপনিবেশগুলিতে স্বাধীনতার অধিকার প্রত্যর্পণের নিশ্চয়তা দিলে ভারতেও ব্রিটিশ বাধ্য হয় একই প্রতিশ্রুতি দিতে।
[1] জাতীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়া: মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার আইনের বিরুদ্ধে ভারতের তৎকালীন জাতীয় নেতারা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। বালগঙ্গাধর তিলক এই শাসন সংস্কারকে ‘সম্পূর্ণভাবে অগ্রহণযােগ্য’ বলে সমালােচনা করেন। শ্রীমতি অ্যানি বেসান্ত এই আইনকে ‘দাসত্বের নামান্তর’ অ্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, “এই প্রস্তাব ইংল্যান্ডের পক্ষে চালু করা এবং ভারতের পক্ষে গ্রহণ করা অসম্মানজনক।”
[2] মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া: মুসলিম সম্প্রদায় এই আইনকে মেনে নিতে পারেনি। আসলে ব্রিটিশ সরকারের তুরস্ক নীতি নিয়ে মুসলিম সমাজ এমনিতেই বিপর্যস্ত ছিল। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর ব্রিটিশ সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও ভারতীয় মুসলমানদের মনে প্রবল সন্দেহ ও অবিশ্বাস দেখা দিয়েছিল। তাই এই শাসন সংস্কার ভারতীয় মুসলিমদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
[3] কংগ্রেসি নেতাদের প্রতিক্রিয়া: জাতীয় কংগ্রেসের নরমপন্থী গােষ্ঠী এই আইনের প্রতি নরম মনােভাব জানালেও, কংগ্রেসের একটা বড়াে অংশ এই আইনের বিরােধিতা করেছিল। হাসান ইমামের সভাপতিত্বে বােম্বাইয়ে আয়ােজিত জাতীয় কংগ্রেসের এক অধিবেশনে মন্টেগু-চেমসফোর্ডের শাসন সংস্কারের প্রস্তাবগুলিকে, নগণ্য, নৈরাশ্যকর ও অসন্তোষজনক ‘inadequate, disappointing and unsatisfactory’ বলে সমালােচনা করা হয়। জাতীয় কংগ্রেস আইনগত প্রতিশ্রুতির দাবি জানিয়ে বলে, ভারতকে অনধিক পনেরাে বছরের মধ্যে পূর্ণ দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থা দিতে হবে। দিল্লিতে আয়ােজিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে মদন মােহন মালব্য, লখনউ চুক্তি অনুযায়ী স্বায়ত্তশাসনের অধিকার জানায়। কংগ্রেসের চরমপন্থী নেতারা এই আইনকে ‘অসন্তোষজনক, অপ্রচুর ও হতাশজনক’ বলে সমালােচনা করেন।
[4] শিক্ষিত ভারতীয়দের প্রতিবাদ: মন্ট-ফোর্ড সংস্কার আইনে ভারতবাসীকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার বদলে, একটি নকল সংবিধান দেওয়া হয়েছিল। তাই শিক্ষিত ভারতীয়রা এই সংস্কার আইন মেনে নেয়নি। কেন্ত্রিজ গােষ্ঠীর ঐতিহাসিকগণও সমালােচনার সুরে বলেন- এই আইনের মাধ্যমে ভারতীয় রাজনীতিকদের ব্রিটিশ সরকারের অর্থনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। শিক্ষিত শ্রেণি এই মতের পক্ষ নেয়, এবং শাসনসংস্কারের বিরােধিতা করে।
Leave a comment