১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ স্বাধীনতা পায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল দেশের নাগরিকের জন্য সুপরিকল্পিত এক শিক্ষাব্যবস্থা। এই উদ্দেশ্যে ১৯৪৭-৪৮ খ্রিস্টাব্দে উচ্চশিক্ষার জন্য রাধাকৃয়ণ কমিশন গঠন করা হয়। মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নতির জন্য প্রথমে ১৯৪৮-৪৯ খ্রিস্টাব্দ তারাচাঁদ কমিটি এবং ১৯৫২-৫৩ খ্রিস্টাব্দে মুদালিয়র কমিশন গঠন করা হয়। এ ছাড়া জাতীয় নারী শিক্ষা কমিটি (১৯৫৯ খ্রিঃ.) গঠিত হয়। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও শিক্ষাব্যবস্থার কিছু কিছু সংস্কার ও উন্নয়ন ঘটলেও আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। কারণ যে কমিশন ও কমিটিগুলি নিয়ােগ করা হয়েছে তারা সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থার এক-একটি অংশের উন্নতির উপর সুপারিশ করেছিল। ফলে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থার সমন্বয়ের অভাব এর দরুন শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নতি হয়নি। তাই স্বাধীন ভারতের শিক্ষার সব দিকগুলো একত্রে বিবেচনা করে প্রথম পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ১৪ জুলাই, ডি এস কোঠারি (Dr. Daulat Singh Kothari) নেতৃত্বে  ভারতীয় শিক্ষা কমিশন বা কোঠারি কমিশন (১৭৬৪-৬৬) গঠন করা হয়।

কোঠারি কমিশন সমগ্র ভারতের শিক্ষার সামগ্রিক লক্ষ্য নির্ণয় করেছে। দেশ স্বাধীন হবার পর জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে শিক্ষার সংস্কার সাধন করতে বিভিন্ন কমিশন গঠনের কারণগুলি হল— 

(১) পূর্বের কমিশন সমূহের পদক্ষেপ : শিক্ষার সংস্কারের উদ্দেশ্যে রাধাকৃষ্ণ কমিশন, মুদালিয়র কমিশন, জাতীয় নারী শিক্ষা কমিটি গঠিত হয়। ওদের সুপারিশ সমূহের কিছু কিছু অংশ সরকার গ্রহণ করে ও শিক্ষাক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন ঘটায়। তবে এই কমিশন সমূহ তাদের কার্য ও সুপারিশ শুধু উচ্চশিক্ষা, মাধ্যমিক শিক্ষায় সীমাবদ্ধ রাখে।

(২) সার্বিক শিক্ষার বিকাশ : কোঠারি কমিশনের প্রথম কমিশনার যা প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত শিক্ষার পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করে, শিক্ষার প্রতিটি স্তরের গুরুত্বপূর্ণ একটিকে বাদ দিয়ে আর-একটি সম্ভব নয়।

(৩) জাতীয় সম্পদ সৃষ্টি : উদ্দেশ্য মুখী জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। শিক্ষা যাতে জাতীয় সম্পদ সৃষ্টিতে সাহায্য করতে পারে, তার জন্য বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান সরবরাহ এবং কর্মে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে শিক্ষার উদ্দেশ্য।

(৪) জাতীয় সংহতির জাগরণ : কোঠারি কমিশনের মতে, শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হল জাতীয় সংহতি বোধের জাগরণ ঘটনা। স্বাধীন ভারতে সাধারণ মানুষের মধ্যে জাতীয় চেতনা ও ঐক্যবোধ জাগরণ করতে হবে। ফলে জাতীয় সংহতি বৃদ্ধি পাবে।

(৫) ব্যক্তিগত গুণাবলির বিকাশ : ভারতবর্ষের সমস্ত জনগণের চারিত্রিক বিকাশ সাধন করতে হবে। প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিগত গুণের অধিকারী হওয়া একান্ত বাঞ্ছনীয়। তাই শৃঙ্খলাবোধ, সহযোগিতা, আত্মত্যাগ, সহমর্মিতার, নেতৃত্ব প্রদান ইত্যাদি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলির বিকাশ এই কমিশনের অন্যতম উদ্দেশ্য।

(৬) ভাষা নীতি গ্রহণ : যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হল ভাষা। ভারতবর্ষের মতো বহু ভাষাভাষী রাষ্ট্র সংযোগ স্থাপনের জন্য ভাষার বিকাশ ও দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজন। এর জন্য ভাষানীতি গ্রহণ করা হয়েছে।

(৭) জাতীয় চেতনা বোধের বিকাশ : শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হলে, তবেই জাতীয় চেতনা বোধের উন্মেষ ঘটেছে এবং সমাজের প্রতি ইতিবাচক মনােভাব গড়ে উঠবে। তাই এই কমিশনের একটি উদ্দেশ্য হল। জাতীয় চেতনার বিকাশ সাধন।

(৮) গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ : শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানো ভারতীয় শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। দেশের প্রতিটি নাগরিকের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আস্থাশীল হওয়া দরকার।

(৯) সমাজের পরিবর্তন : শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হল সমাজের পরিবর্তন। জ্ঞানের জগতে যে ক্রমাগত পরিবর্তন ঘটে চলেছে, আধুনিক সমাজ সেই পরিবর্তন রূপায়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। 

কোঠারী কমিশনের গঠন

১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই ভারত সরকার ড. দৌলত সিং কোঠারির সভাপতিত্বে মােট ১৭ জন সদস্যকে নিয়ে কোঠারি কমিশন গঠন করে। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবর এই কমিশন কাজ শুরু করে এবং দু-বছর পর ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুন একটি রিপোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পেশ করে।  রিপোর্টের শিরোনাম ছিল Education and National Development (শিক্ষা ও জাতীয় বিকাশ)।

রিপোর্টের বিবরণ : সমগ্র রিপোর্ট ৬৯২ পৃষ্ঠার একটি বৃহৎ বিবর্ণ রূপে পেশ করা হয়, যে চারটি খন্ডে বিভক্ত ছিল। প্রথম খন্ডে ছিল সাধারণ সমস্যা সম্পর্কে আলােচনা, দ্বিতীয় খন্ডে শিক্ষা সম্পর্কে আলােচনা, তৃতীয় খন্ডে শিক্ষা পরিকল্পনার বাস্তব আলােচনা ও চতুর্থ খন্ডে ছিল কয়েকটি বিবরণ। তবে রিপোর্টের মূল অংশ ছিল ৪৮৯ পৃষ্ঠা।

সদস্যগণ : কমিশনের সভাপতি ছিলেন一

  • UGC-র চেয়ারম্যান ডি এস কোঠারি (Prof. D S Kothari) এবং
  • সম্পাদক ছিলেন জে পি নায়েক (Sri J P Naik)।

এ ছাড়াও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য সদস্যরা হলেন

  • আর এই গােপাল স্বামী (Sri R A Gopalaswamy),
  • পি এন কৃপাল (Sri PN Kripal),
  • এম ভি মাথুর (Prof. M V Mathur),
  • ড. টি সেন (Dr. T Sen),
  • কে জি সৈয়দ্দিন (Dr. K G Saiyidain),
  • এ আর দাউদ (Sri HARDwood),
  • কে এস পানানদিকার (Kumari S Panandikar),
  • বি পি পাল (Dr. B P Pal) প্রমূখ।

বিদেশি শিক্ষাবিদদের মধ্যে এই  কমিশনের সদস্য ছিলেন ইংল্যান্ডের

  • ভি এস ঝা (Dr. VS Jha) ও
  • এইচ এল এলভিন (Mr. H L Elvin), (ইংল্যান্ডের লন্ডন) প্রফেসর
  • রজার রিভেলি (P Roger Revelle), (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের) প্রফেসর
  • এস এ সুএমভক্সি (Prof. S A Shumovsky),
  • এম জা টমাস(Jean Thomas),
  • জে এফ এম ম্যাকডুগাল (J.F. Mc Dougall), (প্যারিস)
  • সাদাতোশি ইহারা (Mr. Sadatoshi Ihara) (জাপানের)।

টাস্ক ফোর্স গঠন : কোঠারি কমিশন ১২টি টাস্ক ফোর্স (Task Force) এবং ৭টি কর্মীদল বা ওয়ার্কিং গ্রুপ (Working Group) নিয়ে কাজ করেছিল। এই ১২টি টাস্ক ফোর্স হল—

  • বিদ্যালয় শিক্ষা (School Education),
  • উচ্ছশিক্ষা  (Higher Education),
  • কৃষিবিদ্যা শিক্ষা (Agricultural Education),
  • কারিগরি শিক্ষা (Technical Education),
  • বয়স্কশিক্ষা  (Adult Education),
  • বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণা (Scientific Education and Research),
  • শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষকের মর্যাদা (Teachers’ Training and Teachers’ Status),
  • শিক্ষার্থী কল্যাণ (Students’ Welfare),
  • নতুন শিক্ষা কৌশল ও পদ্ধতি (New Techniques and Methods),
  • মানবশক্তি (Manpower),
  • শিক্ষামূলক প্রশাসন (Educational Administration) এবং
  • শিক্ষার অর্থনীতি (educational Finance).

কর্মীদল : অপরদিকে ৭টি কর্মীদল ছিল—

  • নারীশিক্ষা (Women’s Education),
  • অনুন্নত শ্রেণীর শিক্ষা  (Education of Backward Classes),
  • বিদ্যালয় গৃহ (School Building),
  • পরিসংখ্যান (Statistics),
  • বিদ্যালয় ও সম্প্রদায়ের সম্পর্ক (School Community relations),
  • প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা (Pre-primary Education)
  • বিদ্যালয় পাঠক্রম (School Curriculum)।

কর্মপদ্ধতি : স্বাধীন ভারতে এই কমিশনই প্রাক্‌-প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সকল স্তর এবং বৃত্তি শিক্ষা, নারী শিক্ষা প্রভৃতি অন্যান্য শিক্ষার সম্পর্কে সামগ্রিক পর্যালোচনা করে বিস্তৃত সুপারিশ পেশ করে। এটিই হল ভারতের প্রথম পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা কমিশন। কমিশন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ৯০০০০ ব্যক্তির সঙ্গে আলােচনা করেছে। এ ছাড়া ভারতের বাইরেও বিভিন্ন শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলােচনা করেছে। কমিশন প্রাপ্ত ২৪০০ মেমোরেন্ডাম এবং লিখিত বক্তব্য বিশ্লেষণ করে পর্যালোচনা করে। বিগত শিক্ষা ব্যবস্থার সম্পর্কে ২১ মাসব্যাপী কাজ করেছিল। কমিশন শিক্ষার লক্ষ্য সম্পর্কে প্রথমেই বলেছে – “The destiny of India is being shaped in her classrooms.” বিজ্ঞান ও যন্ত্রবিদ্যার যুগে শিক্ষাই নিয়ন্ত্রণ করেছে জাতির সম্পদ, কল্যাণ ও নিরাপত্তা।

তাই শিক্ষাকে এমনভাবে রূপান্তরিত করতে হবে যাতে শিক্ষা জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয় ও মানুষের প্রয়ােজন ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে সমর্থ হয়।

শিক্ষকদের জীবিকা মূলক পরিস্থিতি ও তার উন্নয়ন জন্য কমিশন যে সুপারিশ গুলি করেছে তা উল্লেখ করো এবং বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে তার মূল্যায়ন করাে।

মুদালিয়র কমিশনের সুপারিশগুলি তত্ত্ব এবং আদর্শগত দিক থেকে আকর্ষণীয় হলেও প্রয়ােগের দিক থেকে ত্রূটিপূর্ণ। —এরুপ বলার কারণ কী?

মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য, সুবিধা ও অসুবিধাগুলি বিস্তারিত আলােচনা করাে।