শিক্ষার সামগ্রিক মূল্যায়ন ও পুনর্গঠনের জন্য ভারত সরকার ড. ডি এস কোঠারি-র সভাপতিত্বে দেশি-বিদেশি শিক্ষাবিদদের নিয়ে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। ড. কোঠারির নামানুসারে এই কমিশন কোঠারি কমিশন নামেও অভিহিত।

ভারতীয় শিক্ষা কমিশনে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে। যে, এই শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীকে দায়িত্বশীল সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুত করা। তাদের নান্দনিক, বৌদ্ধিক এবং সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দেওয়াই এই স্তরের শিক্ষার উদ্দেশ্য। তাই কোঠারি কমিশন প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত যে পাঠক্রম রচনার কথা বলেছিল তা হল- “Education is a three fold process of imparting knowledge, developing skills and inculcating proper interests, attitudes and values.” অর্থাৎ এর মধ্যে আমাদের স্কুল পাঠক্রম শুধুমাত্র জ্ঞানার্জনে সহায়তা করা নিয়ে ব্যস্ত। যোগ্য নেতৃত্ব বিকাশে সহায়তা করা, মূল্যবোধ সম্পর্কে উৎসাহিত করে তােলা প্রভৃতি বিষয় আমাদের বিদ্যালয় পাঠক্রমে পরিলক্ষিত হয় না। তাই শিক্ষা কমিশন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের সুপারিশ করে।

এই স্তরে ভাষা, প্রাথমিক গণিত, প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ সংক্রান্ত ধারণা গড়ে তােলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যথা—

(১) ভাষা : মাতৃভাষা বা একটি আঞ্চলিক ভাষা।

(২) গণিত : প্রাথমিক গণিত ভাষা ও গণিতের উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। 

(৩) প্রাকৃতিক পরিবেশ বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যা : প্রকৃতি বিজ্ঞান ও প্রাণী বিজ্ঞানের প্রকৃতি পাঠের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। 

(৪) পরিবেশ বিজ্ঞান ও সমাজবিদ্যা : তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে পাঠ্য। 

(৫) সমাজসেবা : নিম্ন প্রাথমিক স্তরে শিশুর সমাজ সম্পর্কে সচেতনতা করে তোলার উদ্দেশ্যে সমাজসেবামূলক কাজ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

(৬) ভূবিদ্যা : চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের রােমান হরফ, ম্যাপ, চার্ট প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানাতে হবে। 

(৭) সৃজনশীল কাজ : শিক্ষার্থীদের চারুকলা, সংগীত, হাতের কাজ মাটির জিনিস তৈরি, কাগজের কাজ প্রভৃতি শেখানো প্রয়োজন।

(৮) কর্মশিক্ষা : সুতো কাটা, উদ্যান রচনা প্রভৃতি তৈরি, এ ছাড়া স্বাস্থ্য শিক্ষা অর্থাৎ দৈহিক চর্চা, সু-অভ্যাস গড়ে তোলা প্রভৃতি শিক্ষা দিতে হবে।

এই স্তরের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো হল—

(১) আবশ্যিক দুটি ভাষা : (a) মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা, (b) হিন্দি, ইংরেজি— দুটি ভাষা আবশ্যিক হলেও শিক্ষার্থীরা একটি করে ঐচ্ছিক ভাষা তৃতীয় ভাষা রূপে শিখতে পারবে।

(২) গণিত : এই স্তরে পাটিগণিত, বীজগণিত, সমীকরণ ও জ্যামিতি থাকবে। এ ছাড়া পাঠ্যসূচিতে থাকবে বিভিন্ন গ্রাফ চিত্র, সম্বন্ধে ধারণা।

(৩) বিজ্ঞান : পঞ্চম শ্রেণিতে থাকবে—পদার্থবিদ্যা, ভূবিদ্যা, জীববিদ্যা। ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকবে— পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিজ্ঞান। সপ্তম শ্রেণিতে থাকবে— পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা।

(৪) সমাজবিজ্ঞান : কমিশনের সুপারিশের যোগ্য শিক্ষক ও প্রয়োজনীয় সুযোগ থাকলে ইতিহাস, ভূগোল, পৌরনীতি পড়ানো হবে।

(৫) চারুকলা : চারুকলা ও হস্তশিল্প পাঠ্যসূচিতে আরও বেশি প্রাধান্য লাভ করবে।

(৬) কর্মশিক্ষা ও সমাজসেবা : মাটির কাজ, মডেল তৈরি, কৃষিখামার তৈরি, বাঁশের কাজ, চামড়ার কাজ, সেলাই, বাগান তৈরির কাজ ইত্যাদি কাজ ছাড়াও সমাজসেবামূলক কাজের মাধ্যমে সামাজিক বোধের বিকাশ ঘটাতে হবে।

(৭) শারীরিক শিক্ষা : খেলাধুলা ও দেহ চর্চাকে সময় তালিকায় উপযুক্ত স্থান দেওয়া হবে। খেলাধুলার মধ্যে থাকবে ক্রিকেট, ফুটবল, টেনিস, বাস্কেট বল, হকি, দাবা, ক্যারাম চাইনিজ চেকার ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়।

(৮) নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা : শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশের জন্য সপ্তাহে একটি-দুটি পিরিয়ড এই শিক্ষার জন্য রাখতে হবে।

পাঠক্রম সংগঠনের মাধ্যমে কমিশন চেয়েছিল নিম্নপ্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থী লেখা, পড়া ও অঙ্কনের বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞানলাভ করবে। বিভিন্ন গঠনমূলক ও সৃষ্টিধর্মী কাজে অংশগ্রহণ করবে সক্রিয়ভাবে। শিশুর মানসিক, দৈহিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পাঠক্রম নির্ধারণ করা হবে।

উচ্চ প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের গণিত বিষয়ে যোগ্যতা এমন তৈরি করতে হবে যাতে তারা কঠিনতর অঙ্ক সমাধানে পারদর্শী হয়ে ওঠে। পাঠক্রমের পরিধি যেমন বাড়বে সেই সঙ্গে বিষয়বস্তুর গভীরতাও বাড়বে। ছেলেদের চরিত্র গঠনের জন্য সংবদ্ধ চেষ্টা করতে হবে। যাতে সমস্ত ধর্মের প্রতি সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল হয় সেই শিক্ষা দিতে হবে। চারুকলা, গান নাটক ইত্যাদি সৃষ্টিধর্মী কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজের বিকশিত করতে পারে, হাতের কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে শ্রেণিকক্ষ পরিষ্করণ, স্কুল সাজানো ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে সামাজিক বিভিন্ন কাজে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ তাদের সমাজসেবামূলক কাজের অংশীদার হিসেবে গড়ে তুলবে।