প্রথাগত শিক্ষার প্রথম পর্যায় হল প্রাথমিক স্তর। আবার, আধুনিককালের নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা ব্যবস্থার দ্বিতীয় স্তর হল প্রাথমিক শিক্ষা। কোঠারি কমিশনের মতে, বিদ্যালয় প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রথম সাত-আট বছরের শিক্ষাস্তরটিকে বলা হয় প্রাথমিক শিক্ষাস্তর। ভারতীয় সংবিধানের ৪৫নং ধারা অনুযায়ী ৬-১৪ বছর পর্যন্ত সমস্ত শিশুকে অবৈতনিক, আবশ্যিক ও সর্বজনীন মৌলিক শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাই প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনা করে কোঠারি কমিশন এর কয়েকটি উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেছে।
(১) উৎপাদনমুখী জ্ঞান ও দক্ষতা সৃষ্টি: প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের উৎপাদনমুখী জ্ঞান ও দক্ষতা সৃষ্টি করে সমস্ত শিক্ষার্থীদের কর্মের প্রতি আগ্রহ সঞ্চার করা প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য।
(২) সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও সুস্থ জীবন পরিবেশ: প্রাথমিক স্তরে শিশুদের যথার্থ উপলব্ধির মাধ্যমে জীবন, পরিবেশ, কৃষ্টি, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের প্রতি সচেতনতা ও আগ্রহ সৃষ্টি করা প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য।
(৩) নাগরিক জীবনের বৈশিষ্ট্য অর্জন: সংস্কার -উদারমনা, গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার উপযোগী মনোভাব, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতার বিকাশ প্রাথমিক স্তর থেকে হওয়া উচিত। ফলে পরবর্তী জীবনে শিক্ষার্থীদের পথ সুগম হবে।
(৪) বাচনিক বিকাশ সাধন: ভারতবর্ষের মতে বহু ভাষাভাষী রাষ্ট্রের নাগরিক যাতে পরস্পরের সঙ্গে যথাযথ সংযোগ সাধন করতে পারে, তার জন্য প্রাথমিক স্তর থেকে ভাষা শিক্ষা দেওয়া প্রয়োজন।
(৫) পরিবেশ শিক্ষা: প্রাথমিক স্তরে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রারম্ভিক সূচনা হিসেবে পরিবেশ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পরিবেশ শিক্ষার ব্যবস্থা থাকা উচিত।
(৬) নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশ: শিশুর মধ্যে বিভিন্ন মানসিক গুণাবলি বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার বিকাশের সুযোগ এই স্তরের শিক্ষার মধ্যে থাকা উচিত।
(৭) সামাজিক বিকাশ: শিক্ষার্থী যে সমাজের মধ্যে বড়াে হয় সেই সমাজের নানারকম আচার-আচরণ, রীতিনীতি, প্রথা ইত্যাদি সম্পর্কে পরিচিতি করানো শিক্ষণের উদ্দেশ্য।
(৮) প্রাক্ষোভিক বিকাশ: প্রক্ষোভ কথাটির অর্থ হল আবেগ। বাল্যকালে শিক্ষার্থী যাতে সমাজসম্মত আচরণ করে, তার আবেগের যাতে সামঞ্জস্য থাকে তা দেখাই শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।
(৯) সু-অভ্যাস গঠন: শৈশব এবং বাল্যকাল হল শিশুর অভ্যাস গঠনের সময়। এই সময় শিশুর মন থাকে নরম। তাই এই বয়সে থেকে ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস, খাবার আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস ইত্যাদি নানারকম সু-অভ্যাস গড়ে তােলা প্রাথমিক শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য।
(১০) সৃজনশীলতার বিকাশ: প্রত্যেকটি শিশুর মধ্যে কিছু না কিছু সৃজন ক্ষমতা রয়েছে। এই সৃজনক্ষমতার বিকাশের জন্য হাতের কাজ, ছবি আঁকা, আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট এর কাজ, মাটির কাজ করানোর মাধ্যমে তাদের সৃজন ক্ষমতার বিকাশ ঘটাতে হবে। এ ছাড়া ছড়ার গান, কবিতা, নাচ ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের প্রতিভাকে চেনা যায়।
(১১) বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিকাশ: বর্তমান যুগ হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। তাই এই বয়স থেকেই কম্পিউটার সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান, বিজ্ঞানের নিজস্ব জ্ঞান, যেমন গ্রহ, নক্ষত্র, পৃথিবী ইত্যাদি সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক চিন্তার বিকাশ ঘটানোর শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য।
(১২) শ্রমের প্রতি মর্যাদাবোধ: শিক্ষার্থীদের মধ্যে শ্রমের প্রতি মর্যাদাবোধ গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন ছোটো ছোটো কাজ বিদ্যালয়ে করতে হবে।
কোঠারি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার সাংগঠনিক কাঠামো
কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী, প্রাথমিক শিক্ষার স্তরের দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা— (a) নিম্ন প্রাথমিক স্তর এবং (b) উচ্চ প্রাথমিক স্তর।
(a) নিম্ন প্রাথমিক শিক্ষার স্তর : শিক্ষার এই স্তরে শিক্ষার কাল হবে চার থেকে পাঁচ বছর, অর্থাৎ প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত।
(b) উচ্চ প্রাথমিক শিক্ষাস্তর : এই শিক্ষার কাল হবে দুই থেকে তিন বছরের। এক্ষেত্রে পঞ্চম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার সময়কাল নির্ধারিত হবে।
কোঠারি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষার পাঠক্রম
প্রাথমিক শিক্ষাস্তর যেহেতু দুটি অংশে অর্থাৎ নিম্ন প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্তরে বিভক্ত, যেহেতু উভয় স্তরে পাঠক্রমের মধ্যে বেশ কিছু প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়। উভয় স্তরে ভাষা, গণিত, শারীরশিক্ষা, কর্মশিক্ষা ও সমাজসেবা, বিজ্ঞান, সমাজবিদ্যা প্রভৃতি সকল বিষয় পড়ানো হয়ে থাকে। কেবলমাত্র পার্থক্য থাকে এই যে, নিম্ন প্রাথমিক স্তরে তুলনায় উচ্চ প্রাথমিক স্তরের বিষয় এর গভীরতা বেশি হয়।
কিন্ডারগার্টেন, প্রি-বুনিয়াদি বিদ্যালয় এবং বালশিক্ষা মন্দির-এর বর্ণনা দাও।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যাগুলি আলােচনা করো ও সমাধান লেখো।
Leave a comment