১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা লাভের পর ভারতবর্ষের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন অনুভূত হয়। ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নতির স্বার্থে রাধাকৃষ্ণন কমিশন ও মুদালিয়র কমিশন বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে শিক্ষার সকল সারে উন্নয়নসাধনের উদ্যোগ প্রথম নেয় কোঠারি কমিশন (১৯৬৪ গ্র)। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই ভারত সরকারের উদ্যোগে ১৭ জন ভারতীয় ও বিদেশি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদকে নিয়ে গঠিত হয় কোঠারি কমিশন। ড. ডি এস কোঠারি সভাপতিত্বে এই শিক্ষা কমিশন বেশ কিছু লক্ষ্য স্থির করে। এগুলি হল—
(১) জাতীয় উৎপাদনমুখী শিক্ষা: কমিশনের মতে, সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শ্রমের মর্যাদা বৃদ্ধি পায় এবং তা রাষ্ট্রের জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। এ কারণে সমস্ত রকম কর্ম প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
(২) গণতান্ত্রিক চেতনা জাগ্রত করা : ভারতবর্ষ গণতান্ত্রিক দেশ। তাই শিক্ষার্থীদের মনে গণতান্ত্রিক চেতনা জাগ্রত করা একান্ত প্রয়োজন, যাতে ভবিষ্যতে এই আদর্শের প্রতি তারা শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারে। সর্বজনীন বিদ্যালয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সমাজ, অর্থনৈতিক সবরকম বৈচিত্র্য সহ শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে।
(৩) চরিত্রগঠন : গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় শৃঙ্খলাবোধ, সহমর্মিতা বোধ, ভ্রাতৃত্ববোধ ইত্যাদি গুণগুলোর অধিকারী হওয়া একান্ত প্রয়োজন। তাই শিক্ষার্থীদের চরিত্রের এই গুণাবলির বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে শিক্ষা কাঠামো গঠন করা উচিত।
(৪) ভাষাশিক্ষা : মনের ভাব প্রকাশের মূল মাধ্যম হল ভাষা। তাই শিক্ষার লক্ষ্য হলো ব্যক্তির ভাষার বিকাশ ঘটানো। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে শিক্ষার্থীদের ভাষাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করা উচিত।
(৫) জাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ সাধন : কোঠারি কমিশনের মতে, বিদ্যালয় স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভারতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব জাগ্রত করা জরুরি।
(৬) জাতীয় সংহতি বোধ জাগ্রত : ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার মূল লক্ষ্যই হল জাতীয় সংহতির বিকাশ। শিক্ষার্থীদের মনে শৈশব থেকেই ধর্ম, জাতি, ভাষা সম্পর্কে সংহতিবাদ বিকাশ ঘটানো অত্যন্ত জরুরি।
(৭) সমসুযোগ দান : নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সকল স্তরের মানুষ যাতে শিক্ষাক্ষেত্রে ও পরবর্তী জীবনে জীবিকার ক্ষেত্রে সমান সুযোগ লাভ করতে পারে, কমিশন সেদিকে লক্ষ্য রেখে শিক্ষাকাঠামাে প্রবর্তনে উদ্যোগী হয়।
(৮) নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ জাগরণ : কমিশনের মতে, শিক্ষার্থীর মধ্যে নীতিগত মূল্যবোধ জাগ্রত করার লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হওয়া উচিত। শিক্ষার মাধ্যমে মৌলিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটাতে হবে, যাতে উদারমনা ভাবাপন্ন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে।
(৯) আধুনিকীকরণের শিক্ষাদান : কোঠারি কমিশনের মতে, শিক্ষার্থীকে দ্রুত পরিবর্তিত সমাজজীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আধুনিক সময়ের উপযোগী হয়ে ওঠা শিক্ষা দিতে হবে।
(১০) জ্ঞানের পরিধি বিস্তার : কমিশনের মতে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের পরিধি বিস্তারের লক্ষ্যে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হওয়া উচিত।
(১১) সামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করা : কোঠারি কমিশনের মতে, শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম উদ্দেশ্য হল সামাজিক পরিবর্তনে সাহায্য করা। সেই পরিবর্তন যাতে উন্নয়নমুখী হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা শিক্ষা কাঠামোর অন্যতম লক্ষ্য ছিল।
(১২) উদ্ধারকর্মী শিক্ষার বিকাশ : কোঠারি কমিশন শিক্ষা কাঠামোকে শিক্ষার্থীদের কাছে উদার মনস্ক সৃজনশীল করে উপস্থাপিত করাতে চেয়েছিল। এই কমিশনের লক্ষ্য ছিল উদারনৈতিক ভাবধারার শিক্ষার মধ্য দিয়ে বিকাশ ঘটানো।
Leave a comment