মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের চরিত্রগুলি অতীতাশ্রয়ী হলেও নবযুগের দৃষ্টিভঙ্গিতে সেগুলি রূপায়িত হয়েছে। ঘটনার আধার সেকালের এবং মোটামুটি পূর্ব পরিচিত। কিন্তু আশ্রয়ী চরিত্রটি নতুন যুগের ভাবে সতি। বাংলা কাব্যে একটি মধুসূদনের মুখ্য ভূমিকা প্রাচীনের আধারে নবীনের প্রতিষ্ঠা। এই কাজে অগ্রণী হতে তিনি প্রথাসিদ্ধ দোষগুণের কথা ভাবেননি। দোষগুণ সামাজিক লক্ষণ, তার বিচার বাইরে থেকে হয়, ধর্মের দিক থেকে নীতির দিক থেকে, কবি এখানে চেয়েছেন মানুষের ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যের রহস্য খুঁজতে। সেখানে বিচার সামাজিক পারিবারিক ন্যায়নীতির দিক থেকে নয়, ধর্ম ও সংস্কারের মাপকাঠিতে নয়, ব্যক্তিগতভাবে কামনা বাসনাই মূল্যই এখানে বেশি, আবেগ এবং নিজস্ব চিত্ত ধর্মই একান্ত মুখ্য, কখন সামাজিক ন্যায় নীতি একটা বহিরঙ্গ পীড়ন মাত্র, কখনও সামগ্রিক কল্যাণের প্রতিরূপ এই উভয় ক্ষেত্রেই মানুষের ব্যক্তিগত বাসনা সামাজিকতার সঙ্গে সংঘাতে প্রবৃত্ত হয়। সামাজিক বোধ চায় তাকে সংযত করতে। আর সে চায় সামাজিক বোধকে অতিক্রম করতে। সাহিত্যিক এরূপ ক্ষেত্রে দণ্ডধারী সমাজকর্তার ভূমিকা গ্রহণ করেন না। তিনি মানব হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করে তার ভাবাবেগের উৎস ও ধর্ম লক্ষ্য করেন বীরকাব্যের নারীচরিত্রগুলিই স্রষ্টার এই বোধ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত অথচ যুক্তিগ্রাহ্য ভাবেই উৎসারিত।
বীরাঙ্গনা কাব্যের এগারোখানি পত্রের মধ্যে কেকয়ী এবং জনার পত্র দুটি সাহিত্য গুণের দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই চরিত্রদুটির মধ্যে কয়েকটি দিকে বেশ মিল আছে, সঙ্গে দুজনেই বয়স্কা রমণী, অন্যান্য অধিকাংশ নারীর ন্যায় নগণ্যা, নন প্রৌঢ়া বা মধ্য বয়স্কা বলেই মনে হয়। দুজনেই বিবাহিতা। উভয়ের ধারণা স্বামী তাদের প্রতি অন্যায় অবিচার করছেন, কেকয়ী অভিযোগ তুলেছেন স্বামী দশরথের প্রতি লিখিত তার পত্রে। জনা অভিযোগ করেছেন স্বামী নীলধ্বজকে, দুটি ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষত বাৎসল্যই অভিযোগের কারণ, কেকয়ীর পুত্র ভরত তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সেইজন্যই কেকয়ীর ক্রোধ। জনার ক্রোধ পুত্র প্রবীরের ঘাতক কৃষ্ণার্জুনের পদে নীলধ্বজ আত্মসমর্পণ করেছে। আসলে দুটি পত্রই প্রত্যক্ষত স্বামী দ্রোহীতার কেকয়ী দশরথের প্রতি তার তীব্র নিন্দাবাদ বর্ষণ করেনি, তাঁকে অভিশাপ দিয়েছে। বলেছে কেকয়ী দেশব্যাপী প্রচার করে বেড়াবে যে স্বামী দশরথ পাপী, ‘পরম অধর্ম্মচারী রঘুকুলপতি’ কেকয়ী অভিশাপ দিয়ে নিরস্ত হয়না, পুত্র, ভরতকে নিয়ে পিতৃগৃহে চলে যাবার সিদ্ধান্ত জানায়, পুত্রকেও পিতৃদ্রোহী করে তোলবার ভয় দেখায়। কেকয়ীয় এই পতিদ্রোহ কীসের জন্য ? দশরথের কোন অপরাধের কোন্ পীড়নের জন্য সে এতটা ক্রুদ্ধ, উত্তেজিত ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। কারণ সে দেখেছে অযোদ্ধা জুড়ে উৎসবের আয়োজন চলেছে। সন্ধান করে জেনেছে, রাজা দশরথ রামচন্দ্রকে যুবরাজ রূপে অভিষিক্ত করতে যাচ্ছেন, এটি তার ক্ষোভ ও ক্রোধের কারণ।
কেকয়ী দশরথকে প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ করেছিল। তার পুত্র ভরতকেই করবেন। কিন্তু এখন সেকথা বিস্মৃত হয়ে তিনি রানি কৌশল্যার কথায় ভুলে রামকে যুবরাজ করেছেন। কেকয়ীর কাছে এর একটিই কারণ রানি কৌশল্যার মোহে রাজা মুগ্ধ এবং সেই কারণেই কেকয়ীর ওপর এই অন্যায় অসত্য চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রামকে কোনোদিক থেকেই কেকয়ী ভরতের চেয়ে উপযুক্ত মনে করেন না। সে বলে—
পুত্র তব চারি, নরমণি।
গুণশীলোত্তম রাম, কহ কোন্ গুণে,
কী কুহকে, কহ শুনি কৌশল্যা মহিষী
ভুলাইলা মন তব ? কী বিশিষ্ট গুণ
দেখি রামচন্দ্রে, দেব, ধর্ম নষ্ট করো?
তার মধ্যে কোনো সুস্পষ্ট যুক্তি হয়তো পাঠক লক্ষ্য করবেন না, কিন্তু সুতীব্র ভাবাবেগ পাঠক অনুভব করবেন। নিজ পুত্রের জন্য পক্ষপাত যে-কোনো মমতার সহজাত প্রবৃত্তি, ভরত তার নিজের পুত্র এটিই তার কাছে পর্যাপ্ত কারণ।
মধুসূদন কিন্তু চরিত্রটির আরও গভীরে প্রবেশ করেছেন, তিনি কেকয়ীর মধ্যে রানি কৌশল্যার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জয় পরাজয়ের সূত্রটাকে এখানে অনুসরণ করেছেন। কেকয়ী বর্তমানে বিগত যৌবনা এই কারণেই কামুক স্বামী দশরথ তাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি এত সহজে ভঙ্গ করল। এই বিশ্বাস তার হয়েছে, এই বিশ্বাসের মধ্যে অবগত যৌবনের জন্য রমণী হৃদয়ের এক ট্র্যাজিক আর্তিও প্রকাশ পেয়েছে। অনুরূপ, নীলধ্বজের প্রতি জনা পত্রিকায় জনা চরিত্রকে অবলম্বন করে মধুসূদনের নারী চরিত্র সম্পর্কে গভীর ভাবনা আরও একবার প্রকাশ পেয়েছে, জনার যে চিত্রটি তিনি একেছেন তা এক বীরঙ্গনা রমণীর, কৃষ্ণকান্তের সঙ্গে তিনি স্বামীকে প্রবৃত্ত করতে চাইছেন। স্বামী অরাজি বলে তিনি নিজেই যুদ্ধযাত্রার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। কিন্তু তিনি এই বীরঙ্গনা রূপ আসলে গভীর বাৎসল্য বোধেরই এক ধরনের প্রকাশ পুত্র প্রবীর কৃষ্ণার্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে স্থিত। জনা চায় প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে। স্বামী নীলধ্বজের সাহস নেই কৃষ্ণার্জুনের সম্মুখে দাঁড়াবার। তিনি তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন এই নিদারুণ লজ্জা জনাকে বিদ্ধ করেছে। প্রবল বা বাৎসল্যের সঙ্গে মিলেছে তীব্র আত্মসম্মানবোধ।
স্বামী নীলধ্বজের ভীরুতা ও কাপুরুষতা তার মনোভাবকে আরও তীব্র হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। আজ জনা তাই প্রায় উন্মাদিনী, স্বামী নীলধ্বজের প্রতি যে মনোভাব সে ব্যক্ত করেছে তাকে একরূপ স্বামীদ্রোহীতা বলা যায়। এদেশে পরিচিত পরিবারতন্ত্রে তার সমর্থন নেই, বিশেষত মধুসূদন যখন এইকাব্য লেখেন তার অব্যবহিত পূর্বে মধ্যযুগীয় সমাজবিধিতে এইরূপ মনোভাব ছিল একান্ত গর্হিত। কিন্তু মধুসূদন তার মধ্যেই মনুষ্যত্বের নতুনত্ব খুঁজে পেয়েছেন, জনার ক্রোধ ও ক্ষোভের মধ্যে একটা বড়ো সত্য আছে তাহল স্বাধীনতা প্রিয়তা, জনা পুত্র প্রবীরের পাণ্ডব বিরোধিতা সমর্থন করেছিল এই কারণেই যে প্রবীর পাণ্ডবদের অশ্বমেধের ঘোড়াকে ধরে প্রতিরোধ করেছিল। আত্মসমর্পণ করেনি। নীলধ্বজ রাজাকে প্রবীর ও জনা মিলে একরূপ বাধ্য করেছিল পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। প্রবীর মৃত্যুবরণ করে দেশপ্রেমিকের মৃত্যু। অনার গভীর বেদনায় বাৎসল্যের সঙ্গে মিশেছে দেশপ্রেমের বোধ। এই আধুনিক চেতনা জনাকে সামান্য নারীর ঊর্ধে স্থাপন করেছে। মধ্যযুগীয় মূল্যবোধ জনার আচরণ স্বামীদ্রোহ। মধুসূদন আধুনিক চেতনায় তাকে নতুন তাৎপর্যে মণ্ডিত করেছেন। জনা স্বদেশপ্রেমে আত্মমর্যাদায় যে মহিমায় উঠেছে, পুত্রের মৃত্যুর মূল্য দিয়ে গভীর বেদনার মধ্যে তাকে উজ্জ্বল দান করেছে, মধুসূদনের জনা তাই সামান্য নারী নয়।
জনার বিদ্রোহ শুধু স্বামীর ভীরুতার বিরুদ্ধে নয়, সমকালীন দেশবাসীর বিচারহীন অন্ধতার বিরুদ্ধেও, সমগ্র ভারত যখন কৃষ্ণকে ভগবান এবং কৃষ্ণ সখা অর্জুনকে পুরুষোত্তম বলে প্রণাম জানাচ্ছেন এবং স্বামীও সেই স্মৃতিকারদের দলে যোগ দিয়েছে, তখন জনা মুক্ত দৃষ্টিতে সেই চিন্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পতাকা তুলেছে। কৃষ্ণ এবং অর্জুনের জীবন কাহিনি তাদের নারী সাহচর্য, চরিত্র শৈথিল্য, এমনকি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে তাদের প্রতিক্ষেত্রে অন্যায় আচরণ উঠেছে জনার বাক্যে—
শিখণ্ডী সহকারে কুরুক্ষেত্র চরণে
কৌরব গৌরব ভীষ্ম বৃদ্ধ পিতামহে
সংহারিল মহাপাপী, দ্রোণাচার্য গুরু,
কী কুশলে নরাধম বধিল তাহারে
দেখ স্মরি।
তাই প্রতিবাদী নারী চরিত্র হিসাবে জনা প্রচলিত ভাব ভাবনার ঊর্ধ্বে উঠেছে। গড্ডালিকা স্রোতে সে গা ভাসিয়ে দেয়নি। অনুরূপ প্রৌঢ়া রমণী হয়েও কেকয়ী তার মাতৃত্ব পত্নীত্বকে অক্ষুণ্ণ রাখতে যে বিদ্রোহের অবতারণা করেছে তা বড়োই বিস্মিত করে। এককথায় মধুসূদনের এই চরিত্র দুটি অক্ষয় কীর্তি হয়ে উঠেছে।
Leave a comment