কৃষ্ণদাসের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থটি দর্শন, কাব্য ও ইতিহাসের একটি আকর গ্রন্থ হিসাবে বাংলা সাহিত্য মনীষার মণিমঞ্জুষায় একটি উজ্জ্বল রত্নবিশেষ। বৈষ্ণবের কাছে অগাধ বিশ্বাসের স্বচ্ছ সরোবরে ভক্তির শ্বেতপদ্ম স্বরূপ। গ্রন্থটির রচনাকাল বিতর্কের বিষয়। ড. সুকুমার সেনের মতে ১৫৬০-৮০ খ্রীস্টাব্দে গ্রন্থটির লিপিকাল। আদি, মধ্য ও অস্ত্য লীলা’য় গ্রন্থটি গঠিত। এটি বাংলা সাহিত্য প্রথম পঠনীয় অর্থাৎ অ-গেয় গ্রন্থ। আদিলীলায় প্রথম বারো পরিচ্ছেদ মুখবন্ধ, শেষ পাঁচ পরিচ্ছেদ চৈতন্যের বাল্যলীলা, পৌগণ্ডলীলা, কৈশোর ও যৌবনলীলার সারাংশ। কেননা—
“বৃন্দাবনদাস ইহা চৈতন্যসঙ্গনামে
বিস্তারী বর্ণিলা নিত্যানন্দ আজ্ঞাবলে।”
মধ্যলীলার কাহিনীপট—চৈতন্যের শেষ লীলার পূর্বাভাস, সন্ন্যাস গ্রহণ ও নীলাচলে আগমন, দক্ষিণ-ভ্রমণ, রামানন্দ রায়ের সঙ্গে তত্ত্বালোচনা, নীলাচলে প্রত্যাবর্তন ও গৌড়ীয় ভক্তদের সঙ্গে মিলন রথযাত্রায় নৃত্য ইত্যাদি বিষয়। অন্ত্যলীলায় শিবানন্দ সেন ও পথের কুকুরের কাহিনী, রূপের নীলাচলে আগমন, প্রদ্যুম্ন মিশ্র ও রঘুনাথ দাসের কথা। মহাপ্রভুর দিব্য বিরহপ্রলাপ, বিরহোন্মাদে সমুদ্রে পতন ও উদ্ধার ইত্যাদি বিষয় স্থান পেয়েছে। “চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থটি ‘গীতা’, ‘গীতগোবিন্দ’, ‘লঘুভাগবতামৃত’, ‘অমরকোষ’, ‘পাণিনিসূত্র’ প্রভৃতি বিশ্রুত গ্রন্থের পরিবেশ শাসিত বৈদগ্ধ-নিষ্ঠার স্মারক।
‘চৈতন্যচরিতামৃত’ আখ্যানগ্রন্থ নয়, তত্ত্ব-ভাবনায় প্রোজ্জ্বল। সনাতন-রূপের ভক্তিতত্ত্ব, স্বরূপ দামোদরের রঘুনাথের পরমতত্ত্ব গ্রন্থটিতে অভিমূর্ত। ঈশ্বরের সঙ্গে জীবের ভেদাভেদ সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে তার মন্তব্য—
“ঈশ্বরের তত্ত্ব যেন জ্বলিত জ্বলন
জীবের স্বরূপ যৈছে স্ফুলিঙ্গের কণ ॥”
‘অচিন্ত্যভেদাভেদতত্ত্ব’ গ্রন্থটিতে সুপ্রতিষ্ঠিত। শ্রীমতী রাধা কৃষ্ণের হ্লাদিনী রশ্মির স্নেহে উদ্ভাসিতা। তিনি কৃষ্ণের আকাঙক্ষা-উৎসবের শ্রেয়সী। তিনি মহাভাবময়ী—
“হ্লাদিনীর সার অংশ তার প্রেম নাম।
আনন্দ চিন্ময় রস প্রেমের আখ্যান॥”
কৃষ্ণদাস কবিরাজ অন্যান্য চরিতকারের মতো শ্রীচৈতন্যের আদি ও মধ্যলীলা বিশদভাবে বর্ণনা করে কালক্ষেপ করেন নি। মূলতঃ তিনি শ্রীচৈতন্যের নীলাচলে অন্ত্যলীলা বর্ণনায় মনোনিবেশ করেছেন। তিনি চৈতন্যদেবের আবির্ভাবকাল (১৪৮৫ খ্রীঃ) এবং তিরোধানকাল (১৫৩৩ খ্রীঃ) উল্লেখ করেছেন এইভাবে—
“শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য পৃথিবীতে অবতরি।
অষ্টচল্লিশ বৎসর প্রকট বিহরি ।।
চৌদ্দশত সাত শকে জন্মের প্রমাণ।
চৌদ্দশত পঞ্চান্নে হৈল অন্তর্ধান ৷৷”
আবার বাসুদেব সার্বভৌমের সঙ্গে বিচার, রায় রামানন্দের সঙ্গে পর্যালোচনা, যবনপণ্ডিত প্রসঙ্গ, দাক্ষিণাত্য ভ্রমণের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার সাক্ষ্যে এই গ্রন্থ ঐতিহাসিকের কাছে মূল্যবান হয়ে উঠেছে। এই গ্রন্থের বিশেষত্ব, চরিতকার চৈতন্যজীবনকে প্রথানুগ (Conventionalized) বহিরঙ্গে রাখেন নি, শ্রীচৈতন্যের কবি স্বভাবের স্বরূপ উদঘাটনেও সচেষ্ট হয়েছেন—
“ভোজন করহ ছাড় বচনে চাতুরী”।
ইত্যাদি অসংখ্য পক্তি এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়। বস্তুতঃ এই পরিশ্রমী ও প্রাজ্ঞ কবি-স্বভাবের করক্ষেপে মহাপ্রভুর জীবন এক অলৌকিক আদর্শের সর্বায়ত সংবেদনে উপনীত হয়েছে। অন্যদিকে চিন্ময় বিভূতির সঙ্গে মানব জীবনরসের সম্পূর্ণ ও সুষম সমাহারে এই যোগক্ষেম কবির শক্তি প্রমাণিত হয়েছে। তাই সম্ভবতঃ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হয়ে ওঠার গৌরব অর্জন করেছে।
বর্ধমান জেলার কাটোয়ার কাছে ঝামটপুর গ্রামে বৈদ্য পরিবারে কবির জন্ম হয়। (ড. যদুনাথ সরকারের মতে ১৫১৭ খ্রীস্টাব্দে, ড. বিমানবিহারী মজুমদারের মতে, কবির জন্ম ১৫২৭ খ্রীস্টাব্দে, জগদ্বন্ধু ভদ্রের মতে, ১৪৯৬ খ্রীস্টাব্দে, মৃত্যু ১৫৮২ খ্রীস্টাব্দে)। পিতা ভগীরথ, মা সুনন্দা দেবী। কবি নিত্যানন্দের শিষ্য ছিলেন। পরে নিত্যানন্দের নির্দেশে বৃন্দাবনে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। বৃন্দাবনের গোস্বামীদের কাছ থেকে তথ্যাদি জেনে এই মহাগ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটির রচনাকাল সম্পর্কে যথাক্রমে ১৬১২ খ্রীস্টাব্দ, ১৬১৫ খ্রীস্টাব্দ, ১৫৬০-১৫৮০ খ্রীস্টাব্দ, ১৫৯২ খ্রীস্টাব্দ বলে ভাবা হয়েছে। মনে হয়, ষোড়শ শতকের শেষ পাদে বা সপ্তদশ শতকের প্রথমভাগে গ্রন্থটি সম্পূর্ণ হয়।
Leave a comment