অশোক মিত্র একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে বৈজ্ঞানিক চিন্তার রঞ্জন থাকা স্বাভাবিক। তিনি অর্থনীতিশাস্ত্রে তত্ত্ব ও সূত্রকে প্রয়োগ করেছেন। বৈজ্ঞানিকের নির্মোহ বিশ্লেষণে তথ্যগুলিকে বিশ্লেষণ করেছেন। লেখক নীরস প্রাবন্ধিক নন। তাঁর সরস মন্তব্য ও মানবিকতা মাঝে মাঝে প্রবন্ধকে সুস্বাদু ও রসগ্রাহ্য করে তুলেছে। এই দিক থেকে ‘কৃষিসমস্যা ও আমরা’ প্রবন্ধটি কেবল অর্থনীতি বিষয়ক আলোচনা নয়, একটি স্বতন্ত্র সাহিত্যিক নিবন্ধ। লেখকের সূক্ষ্ম কাব্যিকতা কখনও শব্দে, কখনও ভাবনাতে প্রকাশ পেয়েছে। সাধারণত ধনবিজ্ঞানের প্রবন্ধে এই ধরনের আস্বাদ পাওয়া যায় না।

লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি বৈজ্ঞানিক, তথ্য সন্ধানী ও সাহিত্যিকের। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে লেখক প্রথমেই বলেছেন, “অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা মিলিয়ে বিজ্ঞান।” এই বিজ্ঞান-বুদ্ধির ভিত্তিতে আছে অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতি। লেখকের লেখায় অনুভূতির প্রমাণ যেমন পাওয়া যায়, তেমনি অভিজ্ঞতার স্পর্শও পাওয়া যায় প্রচুর। রাশিয়া ও চিনদেশের অভিজ্ঞতাকে লেখক গ্রহণ করেছেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে দেখা দেয় দর্শন, এই দর্শন একটি জ্ঞানবিষয়ক সিদ্ধান্ত নিয়ে আসে। আলোচ্য প্রবন্ধে লেখক সেই সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নতুন নতুন অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে যাচাই করলে অনেক সময় সিদ্ধান্তের রদবদল হয়। লেখক সোভিয়েট পরিকল্পনার অভিজ্ঞতা নির্ভর পরিবর্তনকে স্বাগত জানিয়েছেন। সোভিয়েট পরিকল্পনার ত্রুটিকে, লেখক তুলে ধরেছেন। এই ভুল দেখে কীভাবে চিন দেশের সরকার নতুন পরিকল্পনা নির্মাণ করল এবং সেই পরিকল্পনারও ত্রুটি কোথায় সে সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। প্রথমত ভারত সম্পর্কে লেখকের নির্মোহ দৃষ্টি ভারতের আর্থিক প্রগতির ধীরগতিকে সাহায্য করেছে, এ-বিষয়ে মন্তব্য করতে দ্বিধাহীন। এই সব অভিজ্ঞতাকে লেখক তত্ত্বগত ভাবে দেখেন নি, দেখেছেন অভিজ্ঞতালব্ধ সত্য হিসেবে। লেখক তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির কথা এই কারণে প্রথম অনুচ্ছেদে বলেছেন “অভিজ্ঞতা থেকে দর্শন, দর্শন থেকে অনুশীলন, কিছু কিছু সংস্কার প্রাক্তন মোহ-আবরণ ঘুচিয়ে ফেলে, নতুন আবিষ্কার থেকে নতুন চিন্তার সাযুজ্যবন্ধন হয়। চিন্তা এবং পরিচয়ের রসায়নে এমনি করেই বিজ্ঞান গতির আবেগ পায়।” লেখকের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এই “গতির আবেগ” এক নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে। অভিজ্ঞতা থেকে যে দর্শনের সীমায় লেখক পৌঁছেছেন, সেই অভিজ্ঞতা লেখকের পক্ষে যে ফলপ্রসূ হয়েছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।

আলোচ্য প্রবন্ধে লেখক তথ্যরাশি, সংখ্যাতত্ত্বের নানা প্রামাণিক উদাহরণ দিয়ে সোভিয়েট রাশিয়া, চিন ও ভারতের উৎপাদনের গড় পরিচয় বা জাতীয় আয়ের সূচক সংখ্যা লিপিবদ্ধ করেছেন। লেখক যুক্তিবাদী। তাই যুক্তিসূত্রকে তাঁর আলোচনায় বার বার অনুসৃত হতে দেখা যায়। সোভিয়েট ইউনিয়নের আর্থিক উন্নতির বিশালতা লেখককে মুগ্ধ করেছে-“সোভিয়েট ইউনিয়নের অগ্রগতি আমাদের মুগ্ধতার উজ্জ্বল আকাশে উত্তীর্ণ করে।”—এই বর্ণনায় লেখকের কাব্যিক অনুভূতি ও উপলব্ধি প্রকাশিত হয়। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সূচনা-সময়ের সঙ্গে হালের অবস্থা তুলনা করে লেখক বিস্মিত ও পরিকল্পনার গুরুত্ব সম্পর্কে শ্রদ্ধান্বিত। এক্ষেত্রে যে সূত্রটিকে লেখক পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলেছেন, তাহল বিনিয়োগের অঙ্ক বাড়লেই উৎপাদনও বাড়বে। এটাই লেখকের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু লেখকের যুক্তিবাদী মন এই প্রাথমিক সিদ্ধান্তকে অভিজ্ঞতার আলোকে বিচার করে দেখেছে। বিনিয়োগের কত অংশ ইস্পাত-যন্ত্রপাতি সড়ক-বন্দর-বিদ্যুৎ-সেচনে ব্যয়িত হবে, কত অংশ নিত্যকার তাৎক্ষণিক চাহিদার ইন্ধন মেটাতে ব্যয়িত হবে, তা নিয়ে যে সৃষ্ট অঙ্ক আছে তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। সোভিয়েট পরিকল্পনায় এই বিনিয়োগের অগ্রাধিকার ব্যবস্থাকে লেখক সাধুবাদ জানিয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলেছেন লোকে যদি ভোগ্যসামগ্রী ক্রয় করে বিনিয়োগের একটা অংশ ব্যয় করে, তবে তা ভ্রান্ত পথ হবে। সোভিয়েট রাশিয়া অন্তত ওই দিক থেকে একটা নতুন পথ দেখিয়েছে। “প্রথম দিকে কৃচ্ছসাধন করো, অস্তিমে অপরুপ ফল পাবে।” দেশবাসীর এই কষ্টস্বীকার থেকেই উৎপাদনের জোয়ার আসে এবং যন্ত্রপাতি থেকে আরও যন্ত্রপাতি বা উৎপাদন উপকরণ কিনে দেশের কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট ভবিষ্যৎ দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। লেখক যে এই দিকটাকে গুরুত্বপূর্ণ সহকারে তুলে ধরেছেন, তাতে তাঁর বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণিত হয়।

লেখক সোভিয়েট, চিন ও ভারতের তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। তাঁর দৃষ্টির মূল লক্ষ্য ভারতের কৃষিব্যবস্থা ও আর্থিক প্রগতি। ১৯৫১ সাল থেকে দেশে আর্থিক পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। কিন্তু ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ বারো-তেরো বছরে কৃষি উৎপাদন তেমন বাড়েনি। জনসংখ্যা যথেষ্ট বেড়েছে। তাই তিরিশ শতাংশ বৃদ্ধির হারও যথোপযুক্ত নয়। নানা আলোচনা-অর্থব্যয় অধ্যবসায়ের পর এই উন্নতি সামান্য মাত্র। ঘাটতির আনুপাতিক অঙ্ক একই রকম আছে। লেখকের আলোচনায় সাধারণ হিসেব দিয়ে ভারতের আর্থিক অগ্রগতির শোচনীয়তা দেখিয়েছেন। এক্ষেত্রে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিজ্ঞান ও অনুভূতি দুইই আছে। লেখক কৃষিসম্পদের গুরুত্বকে স্বীকার করেছেন গভীরভাবে, এক্ষেত্রে তাঁর প্রকাশভঙ্গি সাহিত্যধর্মী। “সোনার কাঠি রুপোর কাঠি সব কিছুই তাই কৃষিসম্পদ। এই সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি এখনও যেহেতু ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমাদের পরিকল্পনার ব্যর্থতা সর্বত্র এক অপ্রচ্ছন্ন নৈরাশ্যের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে।” এই নৈরাশ্যকে লেখক উৎকণ্ঠা বলে বর্ণনা করেছেন এবং এক্ষেত্রে লেখক ইতিবাচক বিশ্লেষণ করেছেন। “উদ্‌বেগ থেকে প্রশ্নের উৎস, আত্মবিশ্লেষণের আরম্ভ।”

লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি সমালোচনামূলক ও ইতিবাচক। তিনি স্বীকার করেছেন যে বারো-তেরো বছরে তিন হাজার কোটি টাকা কৃষি সম্প্রসারণে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এই বিনিয়োগের আর্থিক পরিমাণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসেছে অকৃষিজীবীদের কাছ থেকে। কৃষকদের ওপর করের শাস্তি দেওয়া হয়নি। এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সমস্যাকে বুঝতে সাহায্য করেছে। লেখক যুক্তিসংগতভাবে একথা বুঝিয়েছেন যে রাষ্ট্রকর্তৃক সেচের জল বাড়াবার, উন্নত কৃষিপ্রণালী শেখাবার, শস্যের উচিত মূল্য বজায় রাখবার, উন্নত বীজশস্য এবং উৎকৃষ্ট সার পৌঁছোবার নানা ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবু কৃষিতে ব্যাপ্তি আসছে না কেন? এ প্রশ্নেরও লেখক সঠিক উত্তর দিয়েছেন। “সন্দেহ না হয়েই পারে না আমাদের সমস্ত ব্যবস্থায় কোথাও একটা মস্ত ফাঁকি থেকে যাচ্ছে। গ্রামোন্নয়নের গঠনপ্রণালীতে কোনো অবহেলা প্রবেশ করেছে।” এই সত্যসন্ধান লেখকের গবেষক-মনের ফলশ্রুতি। এর উত্তর লেখক দিয়েছেন “হয়তো যে-সব সাহায্য বিলোনো হচ্ছে, অর্ধপথে তারা লক্ষভ্রষ্ট হচ্ছে। আমাদের পল্লিসমাজ এখন অনাচার দিয়ে ঘেরা: শ্রেণি ও বর্ণভেদহেতু অনাচার এখনও প্রচুর। সমাজতন্ত্রের ধুয়ো আওড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিত্তবানদের সমৃদ্ধতর করবার সুযোগ-সুবিধে বাড়ছে বই কমছে না।”

এই অসাম্য যে কাঠামোর মধ্যে আছে, তাকে দূর না করতে পারলে রাষ্ট্রীয় সাহায্য ব্যর্থ হতে বাধ্য। মহাজন ও উচ্চবিত্ত কৃষকরা যদি রাষ্ট্রীয় সাহায্যের সিংহভাগ গ্রহণ করে নেয়, তাহলে সাধারণ ভাগচাষি ও ভূমিহীন চাষিরা কী পারে? তাদের মন তাই নৈরাশ্যে আচ্ছন্ন থাকে, তাদের না থাকে উৎসাহ না থাকে কর্মপ্রেরণা। উৎপাদন যে মহৎ ব্রত, এই বোধ থেকে তারা ভ্রষ্ট হয়। লেখক তাই সমস্যার ত্রুটির কেন্দ্রকে প্রণিধান করতে সচেষ্ট হয়েছেন এবং সমস্যা সমাধানের জন্য যে পথ লেখক দেখিয়েছেন তা যথার্থ। লেখক সঠিকভাবেই ধরেছেন অসন্তোষের ভিত্তিতে নতুন দুনিয়া গড়া যাবে না। আর্থিক প্রগতি ছাড়া দেশের অগ্রগতি সম্ভব হয় না এবং কৃষি-উৎপাদনের ওপর এই আর্থিক প্রগতি নির্ভর করে। এই কারণে লেখক কৃষি-উৎপাদনের ব্যাপারে যেমন সঠিক পরিকল্পনার রূপায়ণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন, তেমনি কৃষকদের মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার দিকেও নজর দিয়েছেন। একে লেখক বলেছেন, “হার্দ্য-বিনিময়” বা “মন দেওয়া-নেওয়ার সমস্যা।” উন্নত ও সমৃদ্ধ চিনদেশও এই সমস্যার সমাধান করতে পারে নি। তাই লেখক আহ্বান করেছেন নতুন দৃষ্টিভঙ্গির। “গণতন্ত্রের ছায়ায় যে মস্ত পরীক্ষা আমাদের দেশে চলছে তাকে সফল করতে হলে তাই বিনম্রচিত্তে কৃষিসম্যার উৎসানুসন্ধানে যেতে হবে, নিরপেক্ষ তুলাদণ্ড নিয়ে বিচার করে দেখতে হবে কোথায় স্খলন-পতন ঘটেছে, কোথায় কোন্ ধরনের উন্নতি সম্ভব।”

আত্মবিশ্লেষণের পথেই সমস্যাসমাধানের এই মানসিকতা থেকে লেখকের আশাবাদী ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সার্থকতা। লেখক জানেন যে সমস্যাসমাধানের ক্ষেত্রে ভ্রান্তি হতে পারে। “আমাদের ভুল হতে পারে, ভুল না শোধরালে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এক দিকে প্রয়োজন এরূপ স্বীকৃতির, অন্য দিকে যাকে দেখতে পারি না তার আপাতবাক্য চললেও কী জানি হয়তো কোনো অপরূপ মাধুরী লুকিয়ে থাকতে পারে। সে রকম ঔদার্যেরও সমান প্রয়োজন। এই নির্দ্বিধা আত্মবিশ্লেষণের এবং নির্মোহ পরানুশীলনের আরও বিলম্ব ঘটলে ঘোর অমঙ্গল, সত্যি আমাদের হাতে সময় বেশি নেই।”

—এই সতর্কবাণী দিয়ে লেখক প্রবন্ধ শেষ করেছেন। এই আলোচনায় দুটো দিক ফুটে উঠেছে—(১) সমস্যার উৎস সন্ধান, (২) জরুরি সমাধান পন্থা। কাঠামোগত অসাম্যকে যে সমস্যা সমাধানের পথে বাধা মনে করা হচ্ছে তা যথার্থ। কিন্তু এই বাধা কেমন করে ভাঙবে, বিপ্লবের পথে না সংস্কারের পথে সে কথা এখানে বলা নেই। তাহলে প্রবন্ধটির মধ্যে সম্পূর্ণতা আসত।