প্রবন্ধসাহিত্য জ্ঞানধর্মী রচনা, রচনাসাহিত্য হৃদয়ধর্মী রচনা। প্রবন্ধসাহিত্যে বিদ্যা, বৈদগ্ধ্য ও পাণ্ডিত্যের যুক্তিসংগত প্রয়োগও সিদ্ধান্তমুখীনতা লক্ষ করা যায়। বিষয় নির্ভর মননধর্মী গদ্যনিবন্ধ প্রবন্ধ, আর বিষয়-নির্ভর আত্মানুভূতিগত সৃষ্টিকে রচনা বলা হয়। এই দুই শ্রেণির রচনায় সাহিত্যিক আবেদন ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু কোনো কোনো লেখক বিষয়গত গুরুত্বও আত্মানুভূতিতে মিলিয়ে দেন। এই মিলনসাধনের ওপর সাহিত্যিক সাফল্য নির্ভর করে।
প্রবন্ধের আবেদন মস্তিষ্কের কাছে, রচনার আবেদন হৃদয়ের কাছে, অনুভূতির কাছে। শশিভূষণ দাশগুপ্ত রচনা শব্দটি আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন : “রচনা শব্দটি সাধারণত নির্মাণ, সৃষ্টি, গঠন, গ্রহণ, ভূষণ, স্থাপন, সন্নিবেশ, বিন্যাস প্রভৃতি অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। গদ্যপদ্যময় যে কোন সাহিত্যিক সৃষ্টিকে রচনা বলা যাইতে পারে।” এখানে উল্লেখযোগ্য ‘সাহিত্যসৃষ্টি’-কথাটি। এই সাহিত্যসৃষ্টির মূল্যেই প্রবন্ধের সাহিত্যিক মূল্য নিরুপিত হয়। ‘অলংকার কৌস্তুভ’ গ্রন্থে কবি কর্ণশূর বলেছেন: “অসাধারণ চমৎকারিনী রচনা হি নির্মিতিঃ।” অর্থাৎ অসাধারণ চমৎকারিনী রচনা রচনাই নির্মিতি। এই চমৎকারিনী শক্তি কী দিয়ে বোঝা যায়? শব্দের শুধু বিন্যাস পরিযোজনা, পদযোজনা, রীতি প্রভৃতি অর্থে চমৎকারিনী শক্তিকে বোঝানো হয়। এই সব কিছু মিলিয়ে যে ব্যাপারটি রূপ নিয়েছে তা রচনার পারিপাট্য। এই কারণে অনেকে প্রবন্ধ ও রচনার ভেদ না দেখিয়ে সন্দর্ভ কথাটি ব্যবহার করেন। ‘সন্দর্ভ’ শব্দের টীকাপ্রসঙ্গে বলদেব বিদ্যাভূষণ লিখেছেন—
‘গূঢ়ার্থস্য প্রকাশশ্চ সারোক্তিঃ শ্রেষ্ঠতা তথা।
নানার্থবত্বং বেদ্যত্বং সন্দর্ভ কথাতে বুধৈঃ।’
অর্থাৎ গুঢ়ার্থের প্রকাশ, সারোক্তি, শ্রেষ্ঠতা, নানার্থতত্ত্ব এবং বেদ্যত্ব প্রভৃতি লক্ষণযুক্ত রচনা ‘বুধগণ বা পণ্ডিতগণ কর্তৃক সন্দর্ভ নামে কথিত হয়। এই সব সংজ্ঞার সারকথা—নিয়মিত ক্রমযুক্ত পরস্পর-সংগত বাক্য বা বর্ণনা।
ইংরেজি সাহিত্যে ডি-কুইন্সি দুই শ্রেণির রচনার নাম দিয়েছেন- “Literature of Knowledge, “Literature of Power” জ্ঞানের সাহিত্য বিষয়ও পাণ্ডিত্য-কথা, মনস্বিতার কথা, শক্তিধর্মী রচনায় হৃদয়ের কথা, অনুভূতির কথা। Literature of Power বলতে এই ধরনের রচনাকে বোঝায়।
তত্ত্বগত এই সূত্র-পর্যালোচনার পটভূমিতে অশোক মিত্রের বক্ষ্যমান প্রবন্ধ ‘কৃষিসমস্যা ও আমরা র আলোচনা। অশোক মিত্র বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও মনস্বী। তিনি ধনবিজ্ঞানের আলোকে একটি বাস্তব বিষয় আলোচনা করেছেন। বিষয়টির প্রত্যাশিত সংখ্যাতত্ত্ব, পৃথক সংখ্যা বা সারণি চিত্র নাই। তবে উপযুক্ত তথ্য পরিবেশনে লেখক ক্লান্তিহীন। সাধারণত এই ধরনের রচনার সাহিত্যিক মূল্য সীমিত থাকে। কিন্তু লেখকের রচনাগুণে, ভাষার অধিকারে, শব্দচয়নের বৈশিষ্ট্যে, প্রবন্ধটি সাহিত্যশূন্য লাভ করেছে। এই দিক থেকে প্রবন্ধটি নীরস অর্থনীতির প্রবন্ধ নয়। বরং অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি-র জারকরসে জারিত হয়ে তা পাঠকের কাছে নতুন রসাস্বাদ এনে দিয়েছে।
প্রথমেই লেখক তাঁর দৃষ্টিকোণ ঠিক করে নিয়েছেন—“অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা মিলিয়ে বিজ্ঞান। শুধু অনুভূতির ধাতু দিয়ে যা রচনা সম্ভব তা দর্শন। আর একমাত্র অভিজ্ঞতায় ভর করে যদি এগোতে হয়, তাহলে যেখানে পৌঁছাব তা বড়ো জোর পুরাণবৃত্তান্তে”—এই সূত্র বর্তমান প্রবন্ধের নির্মাণকলার ভিত্তি। ধনবিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধটির ভাবপ্রেরণা অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতা। কিন্তু কৃষিসমস্যা ও কৃষকদের সংকট বোঝাতে গিয়ে লেখক সংখ্যাতত্ত্বের জটিলতা সৃষ্টি না করে সূচকের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কোথাও তাঁর এই উল্লেখ অনুভূতি-বিশিষ্ট নয়। এইখানেই প্রবন্ধটির সাহিত্যিকমূল্য।
সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রগতি দেখে লেখক মুগ্ধ। কিন্তু এই ভাবটি লেখক অনুভূতিঘন ভাবে প্রকাশ করেছেন : ‘‘সোভিয়েট ইউনিয়নের আশ্চর্য প্রগতি আমাদের মুগ্ধতার উজ্জ্বল আকাশে উত্তীর্ণ করে।” অথবা সোভিয়েট-পরিকল্পনার বিনিয়োগের বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করে লেখক বলেছেন : “প্রথম দিকে কৃচ্ছ্রসাধন করো, অস্তিমে অপরূপ ফল পাবে।” অথবা “পরিণামে যদি দুঃখমগ্ন না হতে চাও, আপাতত নিবৃত্তির মন্ত্র শেখো, বিনিয়োগ বাড়াও।”
চাষিদের হার্দিক সমস্যার কথা লেখক অনুভূতি দিয়ে প্রকাশ করেছেন, “চাষিদের মন অসেতুসম্ভব হবার ফলে মনের আদানপ্রদানও অবরুদ্ধ থেকেছে।” কৃষিসম্পদ জাতির আর্থিক প্রগতির মেরুদণ্ড। এই ভাবনাকে লেখক প্রকাশ করেছেন এইভাবে: “সোনার কাঠি-রুপোর কাঠি সব কিছুই তাই কৃষিসম্পদ, এই সোনার কাঠি রুপোর কাঠি এখনও যেহেতু ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমাদের পরিকল্পনার ব্যর্থতা সর্বত্র এক অপ্রচ্ছন্ন নৈরাশ্যের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে।” এইভাবে ভাষাশিল্পে ভাবধর্মিতা, কাব্যধর্মিতার স্পর্শ লেখাটির সাহিত্যমূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রবন্ধটিতে Synthetic বা সংশ্লেষণী দৃষ্টি প্রাধান্য পেয়েছে বলে লেখাটি একটি নিজত্ব অর্জন করেছে। এই অনন্যত্ব রচনাটিকে সাহিত্যমূল্যে মূল্যবান করেছে।
প্রবন্ধশিল্পের জন্য প্রয়োজন ভাষাশিক্ষা, শব্দের ব্যঞ্জনাশক্তি, চিন্তার গভীরতা, যুক্তিসজ্জা এবং সর্বোপরি একটি সিদ্ধান্তমুখী স্বচ্ছ ভাবদৃষ্টি। এই সব গুণে গুণান্বিত হয়ে লেখাটি পাঠকের আস্থা ও শ্রদ্ধা অর্জন করেছে। প্রবন্ধটিতে সমালোচকের মনের সঙ্গে আশাবাদের সুর যেমন ব্যঙ্কিত হয়েছে, তেমনি উদ্যত হয়েছে সতর্কবাণী। কৃষকরা নতুন ভুবনের নির্মাতা। তারাই দেশের জীবন ও জীবিকাকে নিয়ন্ত্রিত করে। তাদের অবিরত পরিশ্রমের ফসলে দেশের মানুষ জীবনধারণ করে। এইদিক থেকে বলা চলে কৃষকরা দেশের প্রধান সম্পদ। কিন্তু বিনিয়োগের ফল যদি ভাগচাষি ও দরিদ্র চাষিদের হাতে এসে না পৌঁছায় তা যদি কালোবাজারের অন্ধকারে হারিয়ে যায়, তাহলে তো দুঃস্থ চাষিরা বিপন্ন হবে। অনটনে ক্লিষ্ট হয়ে চাষিরা ফসলের প্লাবন সৃষ্টি করতে পারবে না। তাতে দেশের স্বনির্ভরতা ক্ষুণ্ন হবে। এই বক্তব্যকে লেখক এইভাবে প্রকাশ করেছেনঃ “অধিকাংশ কৃষকের অভাব-অসন্তোষের ভিত্তিতে নতুন পৃথিবী গড়া সম্ভব নয়, উৎপাদনের উদ্দাম বন্যার ঢল এ-অবস্থায় নামবার নয়। গণতন্ত্রের ছায়ায় যে মস্ত পরীক্ষা আমাদের দেশে চলছে তাকে সফল করতে গেলে তাই বিনম্রচিত্তে কৃষিসমস্যার উৎসানুসন্ধানে যেতে হবে, নিরপেক্ষ তুলাদণ্ড নিয়ে বিচার করে দেখতে হবে কোথায় স্কলন-পতন ঘটেছে। কোথায় কোন ধরনের উন্নতি সম্ভব।” এই আত্মবিশ্লেষণী মনোভাব প্রবন্ধটির প্রধান দৃষ্টিভঙ্গি।
Leave a comment