কৃষি একটা দেশের সম্পদ। তাই বলা হয় সোনার কাঠি রুপোর কাঠি। পরিকল্পনার সার্থকতা নির্ভর করে এই সোনার কাঠি রুপোর কাঠির ব্যবহারের ওপর। সোভিয়েট রাশিয়া ও চিন দুই বৃহৎ দেশ, দুই বৃহৎ শক্তি। এই দুই দেশে পরিকল্পনার সার্থকতা ব্যর্থতার ওপর শিল্প ও কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছিল। ধনবিজ্ঞানের সূত্র অনুসারে বিনিয়োগের হার যত বাড়ে, আর্থিক প্রগতিও তত বাড়ে। এই সূত্র প্রযুক্ত হয়েছে সোভিয়েট দেশের পরিকল্পনায়, চিন দেশের পরিকল্পনায়। সোভিয়েট ও চিন দেশের আর্থিক প্রগতি নির্ভর করেছে কৃষিসম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর। সোভিয়েট রাশিয়ার পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য ছিল যে প্রথম দিকে কৃচ্ছসাধন করে বিনিয়োগ দিয়ে শিল্পের উপযোগী যন্ত্রপাতি প্রচুর কেনা হয়েছে, কেনা হয়েছে সামরিক সরঞ্জাম। এতে শিল্পে উৎপাদন বেড়েছে, সামরিক শক্তিতে অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু কৃষির উন্নতি বিশেষ হয়নি। কারণ সোভিয়েট রাশিয়ায় কৃষি বিনিয়োগ অপেক্ষাকৃত কম। কৃষিব্যবস্থা সম্পর্কে বিশেষ করে ভাবা দরকার। যন্ত্রপাতির খাতে বিনিয়োগ এলোেমলোভাবে বাড়িয়ে গেলেই আর্থিক প্রগতি সুনিশ্চিত হবে না। সোভিয়েট দেশের সামগ্রিক উৎপাদন গত পঁয়ত্রিশ বছরে কুড়িগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে অথচ কৃষি উৎপাদন দ্বিগুণও হয় নি। এই বৈকল্যের কারণ কী? কারণ কৃষিতে সঠিক বিনিয়োগ হয়নি। সোভিয়েট পরিকল্পনায় তখন এ-বোধ ছিল না যে যন্ত্রের মতো, পরিবহনের মতো, বিদ্যুৎশক্তির মতো, কৃষিজাতপণ্যও প্রগতি সঞ্চারে বড়ো উপকরণ। এই কথা না বুঝলে যা হয় তাই হয়েছে। সম্প্রতি সোভিয়েট দেশের আর্থিক উন্নতির হার দ্রুত কমে যাচ্ছে। এই অবনতির কারণ সোভিয়েট পরিকল্পনার ত্রুটি। কৃষির ব্যাপারে সোভিয়েত দেশের সরকার দু ধরনের ভুল করেছিল বলে লেখক মনে করেন। কৃষিকর্মের মোড় ঘোরাবার জন্য প্রধানত জোর দেওয়া হয়েছিল বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ট্রাক্টর তৈরির ওপর। ট্রাক্টর শিল্পে যে পরিমাণ টাকা ব্যয়িত হয়েছে, সে পরিমাণ টাকা সার তৈরির জন্য বরাদ্দ হয়নি। এছাড়া কৃষির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উপকরণ ক্রয়ের ব্যাপারে যথেষ্ট অবহেলা দেখানো হয়েছিল। উন্নত বীজশস্য কেনা, কীটনাশক ঔষধ প্রস্তুতের ব্যাপারে যথেষ্ট অমনোযোগ দেখানো হয়েছিল। ১৯৫৩-৫৪ সাল পর্যন্ত সোভিয়েট দেশে কৃষিকাজে নির্দিষ্ট বিনিয়োগের পরিমাণ কমে গেছে। অর্থবণ্টনের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া হয়নি। শ্রীযুক্ত নিকিতা ক্রুশ্চেভের ক্ষমতায় আসীন হবার আগে পর্যন্ত সোভিয়েট দেশে কৃষিবিনিয়োগের এই দিকটা কেউ সাগ্রহে বিবেচনা করেননি। এইসব কারণে পশ্চিম ইউরোপে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যখন কৃষি উৎপাদন ছয়-সাতগুণ বেড়েছে, তখন সোভিয়েট রাশিয়ায় তা উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেনি।
দ্বিতীয় ভুল এই যে, উৎপাদনের ব্যবস্থাগত অসুবিধে। ব্যাপারটা বিস্তৃত ব্যাখ্যার প্রয়োজন। বাণিজ্যক্ষেত্রে বা শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনের ব্যাপারটা প্রশস্ত ও সরলরেখায় এগোয়। মালিকের হাতে মূলধন আছে। মালিক কারখানা করবে, যন্ত্রপাতি কিনবে শ্রমিক নিয়োগ করবে। শ্রমিক মজুরি নিয়ে খাটবে পণ্য উৎপাদন করবে, মালিক পণ্য বিক্রয় করে লভ্যাংশ নেবেন। এই প্রক্রিয়া সহজ-সরল ও হৃদয়াবেগ বর্জিত। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা হলেও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের মালিকানায় শ্রমিকদের অধিকার জন্মাবে। কিন্তু শিল্পোৎপাদনের চরিত্র একই থাকবে। যন্ত্রের ভূমিকা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পোৎপাদনের প্রক্রিয়াও ততখানি সহজ হয়ে উঠবে। দু-তিন হাজার কারখানার সুষ্ঠু পরিচালন ব্যবস্থার ওপর উৎপাদনের প্রগতি অক্ষুণ্ণ থাকবে।
কিন্তু কৃষির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেক বেশি জটিল। কৃষিকর্ম হয় সারা দেশ জুড়ে হাজার হাজার গ্রামে। একই গ্রামে হয়তো দু-তিনশো কৃষিজীবী বর্তমান। তারা মনের দিক থেকে এক হলেও, ইচ্ছার দিক থেকে হয়তো নয়। উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এদের সবাইকে সমমন্ত্রে দীক্ষিত হতে হবে। একই চেতনার বিদ্যুৎ সকলের মধ্যে প্রবাহিত হতে হবে। সোভিয়েট দেশে প্রথম ভুল হয়েছিল একটি প্রতীকীতে। জমিদার ছিল শোষণের প্রতীক। তাই তাদের উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে চাষিরাও উৎফুল্ল হয়ে ফসল উৎপাদনে ব্রতী হবে, এই ধারণা ছিল যান্ত্রিক, এই যান্ত্রিক ধারণায় মানুষের হৃদয়ানুভূতি ও সংবেদনকে বোঝা হয়নি। ভূমিস্বত্ব সম্পর্কে চাষিদের মনে অন্যজাতীয় মোহ বিদ্যমান। জমি একদিকে যেমন কৃষিভূমি, অন্যদিকে তেমনি বসতির জমি। ভিটেমাটির সঙ্গে হৃদয়ের দুর্বলতা যথেষ্ট। তাই কৃষিজীবীর মনস্তত্ত্বকে না বুঝে রাষ্ট্রায়ত্ত জমিতে তাদের বশংবদ সেবার কথা ভাবা হয়েছিল। এই ধরনের যুক্তিতে অধিকাংশ কৃষকের মন হয়তো সায় দেবে না। সোভিয়েট দেশে সুদীর্ঘ সময় কেটেছে এই সায় পাওয়ার ব্যাপারে। এর ফলে উৎপাদনের হার স্তিমিত হয়ে গেছে। এছাড়া সব গ্রামেই পার্টির প্রভাব সমপরিমাণে বিদ্যমান ছিল না। তার ফলে সরকারের সঙ্গে কৃষিব্যবস্থার সম্পর্ক ঢিলে হয়ে গিয়েছিল। গ্রামের প্রয়োজন ও কর্তৃপক্ষের বরাদ্দ এক পথে চলেনি। যেখানে প্রয়োজন সার সেখানে হয়তো পৌঁছেছে ট্রাক্টর, যেখান সেচের জল দরকার, সেখানে পৌঁছেছে সার। এই ব্যবধান সোভিয়েট পরিকল্পনার দ্বিতীয় ত্রুটি।
চিনদেশের কর্তৃপক্ষ ও মানুষ সোভিয়েট অসাফল্য থেকে শিক্ষালাভ করেছে। চিনদেশের কর্তৃপক্ষ বুঝেছে যে শুধুমাত্র বিদ্যুৎ পরিবহন যন্ত্রের প্রসারের দিকে নজর দিলেই চলবে না। কৃষিঘটিত বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়াতে হবে। এই পথে না গেলে সোভিয়েট দেশের মতো ব্যর্থ করুণ অবস্থা হবে। চিনদেশের জনগণ এই উপলব্ধির ওপর ভর করে কৃষিক্ষেত্রে তারা মনোযোগ দিয়েছে। তারা নতুন ধরনের হাল-লাঙল-কাস্তে-খুরপি প্রভৃতি কিনেছে। এছাড়া কীটনাশক ঔষধ, উন্নত বীজশস্য ক্রয়, উন্নত রোপণ প্রণালী প্রভৃতি ব্যাপারে চিনদেশের সরকার মনোযোগী হয়েছে। তারা কৃষিসমস্যা, বিনিয়োগ নিয়ে অল্প আলোচনা করেছে। কৃষি উন্নয়ন প্রণালীর সমস্যাগুলিকে নিয়ে চিনদেশের কর্তৃপক্ষ নানা আলাপ-আলোচনা ও গবেষণায় মন দিয়েছে। “ভারী শিল্পের” ওপর গুরুত্ব না দিয়ে কৃষি-বিনিয়োগে অধিকতর সুফল পাওয়া যাবে।
কিন্তু চিনদের বড়ো সমস্যা ছিল কৃষকদের সঙ্গে হার্দ্য বিনিময়ের ব্যাপারে। এক্ষেত্রে তারা রাশিয়ার পথের অনুযাত্রী। চিন এক বৃহৎ দেশ। সাত লক্ষ গ্রাম, আর চল্লিশ কোটি লোকের জীবিকা কৃষিকার্য। এত লক্ষ গ্রাম এবং এক কোটি লোককে বশংবদ করতে সচেষ্ট হতে হবে, নচেৎ কৃষিতে উন্নতি অসম্ভব হয়ে উঠবে। অনেকেরই কুসংস্কার আছে এই ভেবে যে একনায়কত্বের দেশে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণযোগ্য। কিন্তু আইনের দণ্ডাঘাতে চল্লিশ কোটি লোককে বশে আনা যায় না। চিন দেশের সুদূর গ্রামে-গঞ্জে চিন কর্তৃপক্ষের বা পার্টির প্রভাব বেশি। তবু একথা মনে হয় যে পার্টির মধ্যস্থতা পেরিয়ে অতিরিক্ত কিছু করার প্রয়োজনীয়তা চিন কর্তৃপক্ষ উপলব্ধি করেছেন। এবং সেই কারণে গ্রামে গ্রামে ‘কমিউন’ গড়ে তুলেছেন। ‘কমিউন’ প্রথার সুফল-কুফল দুদিকই আছে। সুফল এই যে ‘কমিউন’ চালু হবার পর থেকে মেয়েরা বাইরের কাজে বেশি আগ্রহী হয়েছে। বাইরে গিয়ে বাড়তি উপার্জন করছে। এর ফলে কৃষির উৎপাদন বাড়ছে। পরিবার-পিছু আয়ের সীমারেখা ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে। ঘটনা এমন ধারা চললে, গ্রামাঞ্চলে মানুষের সন্তুষ্টি বাড়বে এবং কর্তৃপক্ষ কৃষিজীবীদের কাছ থেকে বেশি সহযোগিতা আশা করতে পারেন।
চিনদেশে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধির প্রয়াস ভারতের পক্ষেও আদর্শযোগ্য। চিনদেশের সঙ্গে ভারতের সাদৃশ্য প্রচুর। দুদেশেই পুঙ্খিত সমস্যার সমাহার। কৃষিক্ষেত্রে জরাজীর্ণতা, জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্ধিত হার—এসবই চিনের সমস্যা। এসবের মধ্যে চিনদেশের পঁয়ত্রিশ কোটি কৃষককে এগোতে হবে।
Leave a comment