কৃত্তিবাসের আত্মপরিচয়


রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত সেকাল কবিতায় লিখেছিলেন—

হায়রে কবে কেটে গেছে কালিদাসের কাল।

পন্ডিতেরা বিবাদ করে লয়ে তারিখ সাল ॥

কৃত্তিবাসের কবিমহিমা স্মরণ করে এমন কথা পাঠকেরও মনে হতে পারে। কারণ কৃত্তিবাসের আত্মপরিচয় নামে অনেকগুলি পয়ার ছত্র পাওয়া গেছে। তার তথ্যাদি এমন জটিল যে, বিভ্রান্ত গবেষকেরাও হয়ে পড়েছেন, ১৩০৪ বঙ্গাব্দে নগেন্দ্রনাথ বসু ‘কৃত্তিবাসের আত্মপরিচয়’ এই নাম দিয়ে ৯টি পয়ারছত্র মুদ্রিত করেন এবং দীনেশচন্দ্র সেন ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ এর দ্বিতীয় সংস্করণে উল্লেখ করেন। অথচ কৃত্তিবাসী পুঁথিগুলিতে এই আত্মপরিচয় অনুপস্থিত। প্রসঙ্গক্রমে প্রশ্ন জাগে নগেন্দ্রনাথ ও দীনেশ চন্দ্র তাহলে কোন পুঁথি বা কোন উৎস থেকে এই ছত্রগুলি পেলেন? এর সঠিক উত্তর কি তা নির্ণয় করা দুরূহ, তবে বিভিন্ন তথ্য ও অনুমানের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন গবেষক যে মন্তব্য পেশ করেছেন তার উপর নির্ভর করে কৃত্তিবাসের ‘আত্মপরিচয়’ উদ্ঘাটন করা যেতে পারে।


রামায়ণ পাঁচালীর অমর কবি কৃত্তিবাস যথার্থই বাংলা দেশের ‘কীর্তিবাস’। কিন্তু রাজমহল থেকে চট্টগ্রাম এবং ওড়িষার উপকূল থেকে কামরূপ পর্যন্ত ভূভাগের আবাল বৃদ্ধ বণিতার চিত্তপটে ভাগীরথী ধারার মত যিনি প্রবাহিত করেছেন রামকথামৃত, তাঁর সম্বন্ধে নিঃসংশয় তথ্য আজও অজ্ঞাত। অবশ্য তাঁর আত্মপরিচয়ে অনেক দুর্লভ তথ্য উদঘাটিত। কিন্তু দুঃখের বিষয় তা বহুমত ভেদের কণ্টকে আকীর্ণ। নিজের জন্মসন কবি এভাবেই উল্লেখ করেছেন

আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পূর্ণ মাঘমাস। 

তথি মধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস।।

গবেষক সুখময় মুখোপাধ্যায় ১৩৮৯ খ্রীষ্টাব্দের ৩রা জানুয়ারি (মাঘমাস, রবিবার, শ্রীপঞ্চমীর দিন) কৃত্তিবাসের জন্মদিন বলে সিদ্ধান্ত করেছেন। আবার অন্যান্য সমালোচকগণ (ডঃ সুকুমার সেন ও ডঃ ভূদেব চৌধুরী প্রমুখ) ১৩৯৯ খ্রীষ্টাব্দ কে কৃত্তিবাসের জন্মসন বলে গ্রহণ করতে ইচ্ছুক।


নদিয়া জেলার ফুলিয়া গ্রাম কবির শৈশব কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত জন্মভূমি। কবির পূর্বপুরুষ নরসিংহ ওঝা পূর্ববঙ্গ থেকে এখানে এসে স্থিতিলাভ করেছিলেন। তাঁরই প্রপৌত্র বনমালী কৃত্তিবাসের পিতা। মাতা মালিনীর গর্ভে ছয় পুত্রের জন্ম হয়—

মালিনী নামেতে মাতা বাবা বনমালী। 

ছয় ভাই উপজিল সংসারে গুণশালী।। 


বারো বছর বয়েসে পদ্মা নদী অতিক্রম করে কৃত্তিবাস চতুষ্পাষ্ঠিতে উপনীত হন। রাজপন্ডিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য যৌবনে তিনি গৌড়েশ্বরের‌ সভায় উপস্থিত হন

রাজপণ্ডিত হব মনে আশা করে। 

পঞ্চশ্লোক ভেটিলাম রাজ গৌড়েশ্বরে।।

নিজের পান্ডিত্য ও কবিত্ব শক্তিতে রাজাকে মুগ্ধ করে তিনি রাজ অনুগ্রহ ও পুরস্কার লাভে সক্ষম হন। এইভাবে রাজ-কবির আসন অলংকৃত করে তিনি ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ শেষ করেন।

কৃত্তিবাস সে প্রখ্যাত পন্ডিত একথা তাঁর আত্ম-বিবরণীতে একাধিকবার উল্লিখিত হয়েছে।

কৃত্তিবাস পন্ডিত মুরারি ওঝার নাতি। 

যার কণ্ঠে সদা কেলি করেন ভারতী।।

রাজদ্বারে স্থায়ী আসন লাভের পর তাঁর কবিত্ব ও পাণ্ডিত্য কীভাবে সমাদৃত হয়েছিল তার বিশ্বস্ত আলেখ্য অত্মজীবনীতে সুপরিস্ফুট—

চন্দনে ভূষিত আমি লোক অনিন্দিত।

যবে বলে ধন্য ধন্য ফুলিয়া পণ্ডিত৷৷

মুনি বলে বাথানি বাল্মীকি মহামুনি। 

পন্ডিতের মধ্যে কৃত্তিবাস গুণী।।

এই ‘আত্মবিবরণ’ অংশ পাঠ করে মনে হওয়া স্বাভাবিক—মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে সম্ভবতঃ কৃত্তিবাসের মধ্যেই প্রথম এই ‘আত্মগৌরব বোধ দেখা দিয়েছিল—

‘কারো কিছু নাহি লয় করি পরিহার। 

যথা যাই তথায় গৌরব মাত্র সার।।


কৃত্তিবাস যে গৌড়েশ্বরের সভায় দেখা দেন তার পরিবেশ ও পাত্র মিত্রাদির বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয়, এই গৌড়েশ্বর হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। ইতিহাস বলে, তুর্কী বিজয়ের পর বাংলাদেশে যে একমাত্র হিন্দু রাজা গৌড়েশ্বরের মর্যাদায় ছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত, তিনি হিন্দুরাজা গণেশ। ১৪১৪ থেকে ১৪১৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ছিল তাঁর রাজত্বকাল। এছাড়া কৃত্তিবাসী রামায়ণের ‘উত্তরা খণ্ডের একটি পুঁথি লিপির সমাপ্তিকাল ১৫০২ শকাব্দ। তা দেখে ড. সুকুমার সেনের অনুমান যে, কৃত্তিবাসের মূল গ্রন্থটি ওই সময়ের পূর্বে রচিত। কৃত্তিবাস প্রাচীন কবি, তার নিঃসংশয় নিদর্শন— জয়ানন্দের ‘চৈতন্য মঙ্গলকাব্য’। সেখানে কৃত্তিবাস, চন্ডীদাস ও গুণরাজ খান—এই তিন কবির নামোল্লেখ বিদ্যমান। জয়ানন্দ ষোড়শ শতকের মধ্যভাগের কবি। সুতরাং ওই কবিতায় যে অন্ততঃ পঞ্চাশ বছর পূর্বের সে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। কৃত্তিবাস চৈতন্য পূর্ব না চৈতন্য পরবর্তী সে সম্বন্ধে তর্ক জাল আজও বিস্তৃত। তবুও অধিকাংশ গবেষকের সুচিন্তিত অভিমত কৃত্তিবাস চৈতন্য পূর্ববর্তী কবি।


কৃত্তিবাসের পূর্বপুরুষ পূর্ববঙ্গবাসী নারসিংহ ওঝা বেদানুজ রাজার পাত্র (মন্ত্রী) ছিলেন। পূর্ববঙ্গের ওই অঞ্চলে বিশৃংখলা দেখা দিলে নারসিংহ পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে নদীয়া জেলার ফুলিয়ায় বসতি স্থাপন করেন। তাঁর বংশধর মুরারি ওঝা, তাঁর পুত্র বনমালী, বনমালীর সাত পুত্র কন্যার মধ্যে জ্যেষ্ঠ পুত্র কৃত্তিবাস মাঘমাসের রবিবার শ্রীপণামী তিথিতে জন্মলাভ করেন এবং বারো বছর বয়সে উত্তরবঙ্গে পদ্মাতীরে বিদ্যালাভের জন্য যাত্রা করেন। সেখানে গুরুগৃহে দশ বারো বছর অধ্যায়ন করে গৌড়েশ্বরের সভায় যান এবং গৌড়েশ্বরের নিকট সম্মান লাভ করেন এবং পিতামাতা ও গুরুর আদেশে রামায়ণ পাঁচালী রচনা করে অমরত্ব লাভ করেন।