রামায়ণ ভারতবর্ষের জাতীয় মহাকাব্য। এই রামায়ণ মহাকাব্য শুধু ভারতবর্ষে নয়, ভারতের বাইরেও বিশেষ ভাবে সমাদৃত। গত পাঁচশ বছর ধরে বাংলাদেশে রাজমহল থেকে চট্টগ্রাম এবং ওাড়ষার উপকূল থেকে কামরূপ পর্যন্ত ভূভাগে বাংলা ভাষায় অনূদিত রামায়ণ পাঁচালী অদ্ভুত প্রভাব বিস্তার করেছে। যিনি প্রথম এবং প্রধান রামায়ণকার তিনি হলেন কৃত্তিবাস ওঝা। কৃত্তিবাসের এই রামায়ণ মহাকাব্য আপামর জনসাধারণের নিকট মহান ধর্ম গ্রন্থ তথা জাতীয় মহাকাব্য। কথিত আছে, বৈক্ষ্ণব পদাবলী বাঙালির মর্তচেতনাকে ভাবস্বর্গের তুরীয়লোকে নিয়ে গেছে, মঙ্গলকাব্য তাকে কঠিন মৃত্তিকা তলে টেনে এনেছে। আর কৃত্তিবাসের রামায়ণ পাঁচালী তাঁর গৃহজীবনের পরিচিত আদর্শকে মহত্তর মূল্য দিয়েছে।

কৃত্তিবাসের পরিচয় :

বড়ু চন্ডীদাসকে ছেড়ে দিলে এ পর্যন্ত মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য নিয়ে যত বিতর্ক হয়েছে, তার মধ্যে কৃত্তিবাসী রামায়ণের আলোচনাই জটিলতর এবং মতানৈক্যের কণ্টকে আবৃত। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে কৃত্তিবাস সংক্রান্ত বিশেষ কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। প্রসিদ্ধ কুলাচার্য ধ্রুবানন্দ মিশ্র রচিত ‘মহাবংশ’ গ্রন্থে কৃত্তিবাস সম্বন্ধে বলা হয়েছে—“কৃত্তিবাস : কবিধীমান সৌমঃ শান্ত জনপ্রিয়ঃ”। জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গলে আছে—

“রামায়ণ করিল বাল্মীকি মহাকবি।

পাঁচালী করিল কৃত্তিবাস অনুভবি।।”

—শুধু এই টুকু ছাড়া মধ্যযুগের কোনও সাহিত্যে কৃত্তিবাস সংক্রান্ত বিশেষ কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ইদানীন্তন কালে বিভিন্ন পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে সাহিত্য সমালোচকেরা কৃত্তিবাসের পরিচয় সম্বন্ধে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তা হল— কৃত্তিবাসের পুর্বপুরুষ পূর্ববঙ্গবাসী নারসিংহ ওঝা বেদানুজ রাজার মন্ত্রী ছিলেন। পূর্ববঙ্গে ওই অঞ্চলে মুসলমান আক্রমণের ফলে বিশৃংখলা দেখা দিলে নারসিংহ পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার ফুলিয়া গ্রামে নতুন বসতি স্থাপন করেন। তাঁর বংশধর মুরারি ওঝা, তাঁর পুত্র বনমালী। বনমালীর ছয়পুত্র এক কন্যা। জ্যেষ্ঠ পুত্র কৃত্তিবাস ওঝা বারোবছর বয়সে উত্তরবঙ্গে পদ্মাতীরে বিদ্যালাভের জন্য যাত্রা করেন। সেখানে গুরুগৃহে দশবার বছর অধ্যায়ন করে কাছে যান এব তাঁর গৌড়েশ্বরের নিকট সম্মান লাভ করেন। পিতামাতা ও গুরুর আদেশে রামায়ণ পাঁচালী রচনা করেন।

কৃত্তিবাসের আবির্ভাবকাল :

কৃত্তিবাস তাঁর আত্মজীবনীর বিবরণে লিখে গেছেন—

আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পূর্ণ মাঘমাস।

তথি মধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস।।

বিভিন্ন জ্যোতিষ শাস্ত্রবিদ জ্যোতিষ গণনার মধ্যে দিয়ে উক্ত হেঁয়ালীরূপী ছত্র দুটি সম্পর্কে সঠিক কাল নির্ণয়ে আগ্রহী হলেও তাঁদের অধিকাংশের মধ্যে মতানৈক্য স্পষ্টত অনুধাবন করা যায়। অর্থাৎ কেউ-ই একটি মাত্র সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন নি। তবে সব মিলিয়ে এযাবৎ কৃত্তিবাসের আবির্ভাব কাল সম্পর্কে যে সিদ্ধান্তটি মেনে নেওয়া হয়েছে তা হল—১৩৯৮ খ্রীষ্টাব্দের মাঘমাসের রবিবার শ্রী পশমী তিথিতে তাঁর জন্ম। বিশবৎসর বয়সে অর্থাৎ ১৪১৮ খ্রীষ্টাব্দে গৌড়ের রাজা গণেশের রাজসভাতে তিনি যান, এই গৌড়রাজ গণেশ দনুজমর্দনদের নাম ধারণ করেন এবং এখানেই কৃত্তিবাসের রামায়ণ পাঁচালী রচিত হয়।

বাঙালি সমাজ জীবন: কৃত্তিবাসী রামায়ণের কাহিনি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, কবি আর্য রামায়ণের বিশাল বিশাল কাহিনির বেগশীলতাকে পরিহার করে মানবজীবনের প্রাত্যহিক সুখ দুঃখের বাস্তব চিত্রকে পরিস্ফুট করতে সচেষ্ট হয়েছেন। যুদ্ধ বিগ্রহ সত্ত্বেও এবই মধ্যে বাঙালি সমাজ স্বাদু জীবন রস খুঁজে পেয়েছে। বাল্মীকি রামায়ণ অবলম্বনে কৃত্তিবাস রামায়ণ পাঁচালী রচনা করলেও তাঁর কাব্যে বাঙালির সমাজজীবন মুখ্য হয়ে উঠেছে। তাঁর রামচন্দ্র প্রেমের দেবতা, ভক্তপ্রাণ, অশ্রুতে ব্যাকুল; লক্ষণ অপরিণাম দর্শী উদ্ধৃত যুবক ; স্ত্রৈণ দশরথ অসহায় ক্লীব; কৈকেয়ী মন্থরা নীচ স্বার্থ সন্ধানী; সীতা সর্বংসহা, ও বাঙালি গৃহবধুর মতো অস্থিহীন কোমল মূর্তি। তাই কৃত্তিবাসের রামায়ণের চরিত্রগুলি বাঙালির কুটির প্রাঙ্গনে অবতীর্ণ হয়েছিল।

সাহিত্য বিচারে সদাসর্বদা সমাজ মানসিকতা বা সমাজ বাস্তবতা খোঁজা নিরর্থক। বাংলার কোমল আর্দ্র মাটিতে সীতার মতো কল্যাণী গৃহবধূ, রামের মতো আদর্শ চরিত্র, লক্ষণের মতো অনুরাগী কনিষ্ঠ, রাবণের মত প্রচ্ছন্ন ভক্ত—এ তো বাংলার মাটির গুণ, গগনস্পর্শী উচ্চ আদর্শ ও প্রতিদিনের পরিচিত জীবনচিত্র, এই দুই রীতি কৃত্তিবাসের রচনায় মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এখানেই বাল্মীকির সঙ্গে কৃত্তিবাসের পার্থক্য। সমাজের মধ্যে বাস করে বড়ুপ্রধান কাব্যের কবি যতটুকু দেশকালের অধীন হয়ে পড়েন, কৃত্তিবাসের সৃষ্ট চরিত্রগুলিও প্রায় একই আদর্শ অনুসরণ করেছে। তাঁর কাব্যে সমসাময়িক কালের ছায়াপাত না হলেও মাঝে মাঝে মধ্যযুগীয় বাঙালির জীবনের প্রতিচ্ছবি যে ফুটে উঠেছে সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই।

কৃত্তিবাসের মৌলিকতা :

মধ্যযুগের ভারতীয় ভাষার কোনও কবিই প্রাদেশিক ভাষায় রামায়ণ মহাভারতাদি অনুবাদ করার সময়ে মূলের আক্ষরিক অনুসরণ করেন নি। নিজ নিজ অঞ্চলের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে তাঁরা মূল কাব্যকে প্রয়োজন মতো অদলবদল করে নিতেন। অর্থাৎ সেকালে আক্ষরিক অনুবাদের চেয়ে ভাবানুবাদের দিকে তাঁদের অধিকতর দৃষ্টি ছিল। কৃত্তিবাসের পাঁচালী কাব্যও মূলের অবিকাল অনুসরণ নয়, আক্ষরিক অনুবাদ তো নয়ই। তাই তাঁর কাব্যে ব্যাপকভাবে মৌলিক রচনা সন্নিবিষ্ট হয়েছে। অবশ্য তিনি বাল্মীকির কোনও কোনও কাহিনি বা প্রসঙ্গ বর্জন করেছেন, কোথাও মূল কাহিনিকে কিছু পরিবর্তন করে নিয়েছেন, কোথাও বা নিজ কল্পনা থেকে তৈরি করে নিয়েছেন। বাল্মীকির অনেক কাহিনী তিনি পরিত্যাগ করেছেন, যেমন—কার্তিকের জন্ম, বশিষ্ট বিশ্বামিত্র বিরোধ, বিশ্বামিত্র কথা, অম্বরীষ যজ্ঞ, রামচন্দ্র কর্তৃক আদিত্য-হৃদয় স্তব পাঠ।

আবার নিজ কল্পনা থেকে তিনি যে কাহিনি গুলি নির্মাণ করে মৌলিকতার দাবী রেখেছেন তা হল—দিলীপ-রঘুর কাহিনি; দশরথের রাজ্যে শনির দৃষ্টি ; গণেশের জন্ম ; সম্বরাসুর বধ ; কৈকেয়ীর বরলাভ গুহকের সঙ্গে মিতালি ; হনুমান কর্তৃক সূর্য্যকে বক্ষতলে ধারণ; বীরবাহুর যুদ্ধ ; তরণী সেন মহিরাবণ-অহিরাবণ কাহিনি; রাবণ বধের জন্ম, রামচন্দ্র কর্তৃক দেবী চম্ভিকার অকালবোধন ১০৮টি নীল পদ্মের কাহিনি; গণকের ছদ্মবেশে হনুমান কর্তৃক মন্দোদরীর নিকট থেকে রাবণের মৃত্যুবাণ হরণ; মুমূর্য রাবণের নিকট রামচন্দ্রের রাজনীতি শিক্ষা ; দেবরবধূদের অনুরোধে সীতা কর্তৃক খড়ির দ্বারা রাবণের মূর্তি অঙ্কন, তা দেখে রামের মনে সীতা সম্বন্ধে সংশয় ; লব-কুশের যুদ্ধ।

অবশ্য সূক্ষ্ম বিচার করে দেখলে মনে হবে, কৃত্তিবাস বাল্মীকির কোনও কোনও কাহিনি ইচ্ছামত রদবদল করে নিয়েছেন। কোথাও বা অন্য পুরাণ থেকে গল্প সংগ্রহ করেছেন। যেমন—আদিকাণ্ডে দস্যু রত্নাকর ‘মরা’ ‘মরা’ বলে পাপমুক্ত হয়েছিল এ কাহিনি অধ্যাত্ম রামায়ণ থেকে নেওয়া। হরিশচন্দ্রের উপাখ্যান দেবী ভাগবত ও মার্কণ্ডেয় পুরাণ থেকে নেওয়া ভগীরথের জন্ম বৃত্তান্ত পথ পুরাণে ও যোগবশিষ্ট রামায়ণে এ উৎস পাওয়া যাবে। এছাড়া—কাণ্ডার মুনি, অকাল বোধন, কুম্ভকর্ণ হত্যা ইত্যাদি কাহিনি বিভিন্ন পুরাণ গ্রন্থ থেকে তিনি সংগ্রহ করেন।

ছোটবড়ো ঘটনা বাদ দিলেও কৃত্তিবাসের রচনায় যে ভক্তির স্পষ্ট প্রভাব আছে, তা হচ্ছে তাঁর মৌলিক অবদান। বাস্তবিক কৃত্তিবাসের ভক্তিবাদ বাল্মীকি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ব্যাপার।

কৃত্তিবাসের কবিকৃতি :

কৃত্তিবাস যে যথার্থই প্রতিভাধর কবি ছিলেন, পাঁচশত বৎসর ধরে বাঙালি তার প্রমাণ দিয়েছে। কৃত্তিবাসের অমর মহাকাব্য আকারে প্রকারে পাঁচালী হলেও বাঙালির সমগ্র চেতানাকেই আবিষ্ট করেছে। বাঙালির জীবন ও সাধনার আধখানি কৃত্তিবাস অধিকার করে রেখেছেন। তবে একালের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত বাদ দিয়ে যদি কৃত্তিবাসকে বিচার বিশ্লেষণ করতে হয় তা হলেই তাঁর কবিত্বের যথার্থ মূল্যায়ন হতে পারে।

ছন্দ : কৃত্তিবাসী রামায়ণের প্রাচীন পুঁথিতে ভাষা ও ছন্দের ত্রুটি থাকলেও বর্ণনা সহজ, সরল ও সরস। যেমন—

রাম বলেন সীতা নাইরে লক্ষণ।

তোমার দোষ নাহি মোর দৈব ঘটন৷৷

ত্রিপদী অর্থাৎ লাচাড়ি ছন্দের মধ্যে কিছু ছান্দসিক নিপুণতা লক্ষ্য করা যায় :

শুন মহাশয়     জানুনু নিশ্চয়

তুমি ত্রিদিবের নাথ।

লঙ্কার ঈশ্বরী       নাম মন্দোদরী

করিহ জোড় করি হাথ।।

“রায়বার’ নাম অংশে ছড়ার ছন্দ বা শ্বাসাঘাত ছন্দে কিছু বৈচিত্র লক্ষ্য করা যাবে—

‘আত্মছিদ্র না জানিস পরকে দিস খোঁটা।

বারে বারে কহিস কথা মর রে পাজি বেটা।।

রামায়ণের করুণ রসের মধ্যে এ ধরনের বঙ্গকৌতুক মন্দ লাগে না।

অলংকার : কৃত্তিবাস অলঙ্কার ব্যবহারেও কিছু নূতনত্ব সৃষ্টি করেছেন। একই সঙ্গে সংস্কৃত অলঙ্কার এবং বাংলার পরিচিত শব্দ ব্যবহার করে তিনি বৈচিত্র সৃষ্টি করতে চেয়েছেন।

i) তার পৃষ্ঠে কুজ যেন ভরন্ত ডাবরী। 

ii) বুড়োর যুবতী নারী প্রাণ হৈতে বাড়া।

iii) কুমারের চাক যেন ঘুরাইয়া ফেলে। 

iv) জানুকী কাঁপেন যেন কলার বাগুড়ী।

এ সমস্ত দৃষ্টাস্ত এই কারণে উল্লেখ যোগ্য যে, এতে যেমন—আলঙ্কারিক নিপুণতা প্রকাশ পেয়েছে তেমনি এর তির্যক বাক ভঙ্গী বেশ উপাদেয় হয়েছে। তার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে বাঙালির দৈনন্দিন জীবন চিত্র। এরই জন্যে বোধ হয় কৃত্তিবাসী রামায়ণ অধিকতর জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

পরিশেষে বলা যায়, মহাকাব্য রচনার পিছনে থাকে একটা বিশাল দেশকাল, ভাষা ভঙ্গীতে থাকে ঐশ্বর্যের দ্যুতি, কল্পনায় চাই দ্যুলোক ভূলোক স্যারী প্রতিভা—বাল্মীকি ব্যাস ও হোমারের মহাকাব্যে যার বিচিত্র প্রকাশ দেখা যায়। কিন্তু কৃত্তিবাস সে প্রতিভার অধিকারী ছিলেন না, তিনি মহাকাব্যের বদলে বাঙালির উপযোগী পাঁচালী কাব্য লিখেছেন। তবু সুস্থ, স্বাভাবিক গ্রামীণ জীবনের প্রভাব পড়েছে বলে, “কৃত্তিবাস এ বঙ্গের অলঙ্কার।