রামায়ণে গার্হস্থ্য জীবন:
বাঙলা অনুবাদ সাহিত্যের ক্ষেত্রে সম্ভবতঃ সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছিল ‘রামায়ণ। রামায়ণের নিজস্ব গুরুত্ব এবং বাঙালী জীবনের সঙ্গে এর সহজ আত্মীয়তার জন্য অনুবাদ সাহিত্য রচনাকালে বাঙালী সম্ভবতঃ সর্বাগ্রে রমায়ণের প্রতিই আকৃষ্ট হয়েছিল। রামচন্দ্রের বনবাস এবং রাম রাবণের যুদ্ধ বর্ণিত হলেও রামায়ণ প্রকৃতপক্ষে গার্হস্থ্য জীবনের কাব্য। রবীন্দ্রনাথ বলেন, “রামায়ণের মহিমা রাম-রাবণের যুদ্ধকে আশ্রয় করিয়া নাই, সে যুদ্ধ ঘটনা রাম ও সীতার দাম্প্রত্য প্রীতিকেই উজ্জ্বল করিয়া দেখাইবার উপলক্ষ্য মাত্র।..আমাদের দেশে গার্হস্থ্য আশ্রমের যে অত্যন্ত উচ্চ স্থান ছিল, এই কাব্য তাহাই সপ্রমাণ করিতেছে।..গৃহাশ্রম ভারতবর্ষীয় আর্য সমাজের ভিত্তি। রামায়ণ সেই গৃহাশ্রমের কাব্য।” রামায়ণে গার্হস্থ্য-জীবনেরই পরিচয় বিধৃত রয়েছে বলেই মৌসুমি বায়ু ও পলিমাটির দেশ বাঙলায় এর এত আদর। “ইহাতে যে সৌভ্রাত্র, সত্যপরতা, যে পাতিব্রত্য, যে প্রভুভক্তি বর্ণিত হইয়াছে,” তা সহজেই বাঙালীর নিকট গ্রহণযােগ্য বিবেচিত হয়েছিল। হয়তাে এই কারণেই বাঙালীর মানস-জাগুতির উষালগ্নেই রামায়ণ অনুবাদক মহাকবি কৃত্তিবাসের আবির্ভাব ঘটেছিল।
কবি কৃত্তিবাস: কৃত্তিবাস বাঙলা ভাষায় আদি কবি না হলেও অনুবাদকদের মধ্যে আদি হতে পারেন। অসুবিধে এই—তার আবির্ভাব-কাল-বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা সম্ভবপর নয়। চৈতন্যদেবের জীবনীকার জয়ানন্দ তার চৈতন্যমঙ্গল’ গ্রন্থে তাঁর নাম উল্লেখ্য করলেও, চৈতন্যদেব জয়দেব-বিদ্যাপতি-চণ্ডীদাস এবং মালাধর বসুর কথা বললেও তার নিকটতম প্রতিবেশী ফুলিয়া নিবাসী কৃত্তিবাসের উল্লেখ না করায় পণ্ডিতমহলে কৃত্তিবাসের প্রাচীনত্ব নিয়ে যে সংশয় দেখা দিয়েছে, তার নিরসন আজও হয়নি।
কৃত্তিবাসের জীবনী:
কৃত্তিবাসের রচনার অজস্র পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেলেও মাত্র একটিতেই কৃত্তিবাসের আত্মজীবনীমূলক কিছুটা অংশ পাওয়া যায়। কোন কোন পণ্ডিত-সমালোচক কৃত্তিবাসের আত্মবিবরণীকে জাল বলে উল্লেখ করলেও অপর প্রায় সকলেই এটিকে মেনে নিয়েছেন এবং এটিকে ভিত্তি করেই কৃত্তিবাসের কাল নিরূপণ করে থাকেন। এই আত্মবিবরণীতে কৃত্তিবাস তাঁর পূর্বপুরুষের বিবরণ, তার পঠন-পাঠনের বিবরণ এবং গ্রন্থ উৎপত্তির সূত্রও নির্দেশ করেছেন। বিবরণটি সংক্ষেপে এই-কৃত্তিবাসের পূর্বপুরুষ নরসিংহ ওঝা (নারসিংহ ওঝা) বেদানুজ বা দনুজ নামক-রাজার পাত্র (মতান্তরে পুত্র) ছিলেন। পূর্ববঙ্গে এক সময় বিপর্যয় দেখা দিলে তিনি গঙ্গাতীরে ফুলিয়া গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন। এই বংশেই জন্ম গ্রহণ করেন কৃত্তিবাসের পিতা বনমালী, মাতা মালিনী কৃত্তিবাসের আরাে দুটি ভাই এবং একটি বােন ছিল। বার বৎসর বয়সে কৃত্তিবাস বড়গঙ্গা (পদ্মা) পার হয়ে উত্তর দেশে পড়তে গেলেন। ব্রহ্মাতুল্য গুরুর নিকট পাঠ সমাপন করে কৃত্তিবাস রাজপণ্ডিত হবার আশায় গৌড়ের রাজসভায় উপনীত হয়ে ‘সাত শ্লোকে ভেটিলাম রাজা গৌড়েশ্বরে। পাত্রমিত্ৰবেষ্টিত গৌড়েশ্বরের ইঙ্গিতে তিনি নানা ছন্দে নানা রসাল শ্লোক পাঠ করলে রাজা তুষ্ট হয়ে পট্ট উত্তরীয় উপহার দিলেন। পরে তারই আদেশে কৃত্তিবাস রামায়ণ রচনায় প্রবৃত্ত হন। সরস্বতীর বরে তিনি লােক বুঝানাের জন্য দেশীয় ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন।
কৃত্তিবাসের এই বিবরণীতে তাঁর জন্মমাস, তিথি, বার সবই উল্লেখ করেছেন, শুধু উল্লেখ করেন নি শকাব্দটি আবার গৌড়েশ্বরের রাজসভার পাত্র-মিত্র সভাসদদের বিস্তৃত পরিচয় দিলেও কৃত্তিবাস গৌড়েশ্বরের নাম উল্লেখ করেন নি। তার ফলে বিরাট সমস্যার সৃষ্টি হয়। আত্মবিবরণীতে কৃত্তিবাসের জন্ম-তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে-
আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পুণ্য (মতান্তরে পূর্ণ) মাঘ মাস।
তথি মধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস।।
কৃত্তিবাসের আবির্ভাব-কাল: এখানে শকাব্দের কোন উল্লেখ না থাকাতেই বিপত্তি ঘটেছে। মাঘ মাসের সংক্রান্তি, শ্রীপঞ্চমী তিথি ও রবিবার—এ রকম যােগাযােগ প্রতি শতাব্দীতেই কয়েকবার ঘটতে পারে। আর পূর্ণ- স্থলে পুণ্য’ ধরলে মাঘমাসের যে কোন তারিখ হতে পারে—এতে মাস-বার ও তিথির যােগাযােগ অনেক বেশী হয়। এই সমস্যার সমাধান হতে পারে, যদি গৌড়েশ্বরের নামটি পাওয়া যায়। এখানেও বিপত্তি-নামের উল্লেখ নেই। সভাসদদের সকলেরই হিন্দু নাম থেকে অনেকেই অনুমান করেন যে এই গৌড়েশ্বর অবশ্যই কোন হিন্দু নরপতি হবেন। ১৪১৫-১৮ খ্রীঃ পর্যন্ত রাজা গণেশই একমাত্র হিন্দু রাজা, যিনি সুদীর্ঘকালের মধ্যে গৌড়ের সিংহাসনে আসীন ছিলেন। এ প্রসঙ্গে কেউ কেউ গণেশ-পুত্র যদু বা জালালুদ্দিন এবং অপর কেউ তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণকেই কৃত্তিবাস-কথিত গৌড়াধিপতি বলে মনে করেন। গৌড়ের সুলতান হােসেন শাহ যখন দারােগা ছিলেন তখন তার উর্ধ্বতন কর্মচারী শহর কোতােয়াল ছিলেন সুবুদ্ধি রায়। ডঃ সুকুমার সেন মনে করেন যে কৃত্তিবাসের তালিকায় যে সব সভাসদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এদের অনেকেই প্রথম জীবনে সুবুদ্ধি রায়ের সভায় বর্তমান ছিলেন পরে তারা হােসেন শাহ সুলতান হলে তারা সেই নবাবের গৌড় দরবারে স্থানান্তরিত হয়েছিলেন। বস্তুতঃ এই মতারণ্য থেকে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা সহজ নয়। কৃত্তিবাস-প্রদত্ত সঙ্কেত-অনুসরণে আচার্য যােগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি যে সকল তারিখে বার মাস-তিথির যােগাযােগ সাধন করতে পেরেছে, তাদের মধ্যে ১৩২০ শকাব্দের (১৩৯৮-৯৯ খ্রীঃ) ১৬ই মাঘ রবিবার শ্রীপঞ্চমী তিথিটিকেই কৃত্তিবাসের জন্মদিন বলে অধিকাংশ পণ্ডিত মনে করে থাকেন। এই তারিখ গ্রহণ করলে রাজা গণেশের (১৪১৮ খ্রীঃ) দরবারে কৃত্তিবাসের উপস্থিতিকে মেনে নিতেও কোন অসুবিধে হয় না। ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন, ডঃ ভট্টশালী-আদি ঐতিহাসিক পণ্ডিতগণও এই তারিখের সপক্ষে মত। প্রকাশ করেছে। অপর কোন প্রবলতর প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত আমরা ১৩৯৯ খ্রীষ্টাব্দকেই কবি কৃত্তিবাসের জন্মতারিখ বলে গ্রহণ করবাে।
মূল রচনা: কৃত্তিবাসী রামায়ণের বহু পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেলেও দুর্ভাগ্যক্রমে প্রাচীন পাণ্ডুলিপির অভাবে কৃত্তিবাসের নিজস্ব রচনার সঙ্গে আমরা পরিচয় সাধন করে উঠতে পারিনি। পরবর্তীকালে কৃত্তিবাসের রচনায় এত বেশি প্রক্ষিপ্ত অংশ অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে এবং সম্পাদকগণও এত বেশি সংস্কার সাধন করেছেন যে এ সমস্ত গ্রন্থে আর কৃত্তিবাসের নিজস্ব রচনা কিছুই নেই বলেই সকলে আশঙ্কা করেন। এমন কি ডঃ ভট্টশালীও অতিশয় সতর্কভাবে যে সংস্করণ অংশতঃ প্রকাশ করেছিলেন সে-বিষয়েও ডঃ সুকুমার সেন বলেন, “ভট্টশালী মহাশয় যে প্রাচীনতর আদর্শ ঠিক করিয়াছেন, তাহাকে কাব্যের মূল রূপ বলা চলে না তাহা composite text মাত্র।” অতএব, ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ নামে যে গ্রন্থের সঙ্গে পরিচিত, তাতে কৃত্তিবাসের রচনার নিদর্শন নেই। তাই সঙ্গত করণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, যে প্রচলিত গ্রন্থের প্রামাণিকতা যখন সন্দেহাতীত নয় তখন এর আলােচনার সার্থকতা কোথায়? এর উত্তরে বলা যায়, প্রাচীন যে কোন রচনাতেই প্রচুর প্রক্ষেপ রয়েছে; তাছাড়া, এ জাতীয় জনসাহিত্য প্রকৃতিতে নৈর্ব্যক্তিক বলেই ব্যক্তিগত ধ্যান-ধারণা এতে খুব বেশি ছায়াপাত করতে পারে না। তাই প্রক্ষেপ-বাহুল্য সত্ত্বেও অন্যান্য সকল প্রাচীন গ্রন্থের মতই কৃত্তিবাসী রামায়ণকেও আলােচনার অন্তর্ভুক্ত রাখা সঙ্গত।
পাঁচালী: আমরা সাধারণভাবে মনে করে থাকি যে, কৃত্তিবাস মহাকবি বাল্মীকিকৃত রামায়ণকে বাংলা মহাকাব্যে রূপান্তরিত করেছেন। কিন্তু বস্তুতঃ এর ‘মহাকাব্য অভিধা এবং অনুবাদ’ পরিচয়-দু’টিই আপত্তিজনক। কৃত্তিবাস স্বয়ং তার গ্রন্থকে ‘মহাকাব্য’ বলে অভিহিত করেননি, তিনি একে ‘রামায়ণ পাঁচালী নামেই বারবার উল্লেখ করেছেন। কৃত্তিবাস সচেতনভাবেই রামায়ণ রচনা করতে গিয়ে বাল্মীকির অনুসরণ করেছিলেন। বাল্মীকির রামায়ণ মহাকাব্যরূপেই পরিচিত, কাজেই কৃত্তিবাস ইচ্ছা করলেই যে এটিকে মহাকাব্যরূপে গড়ে তুলতে পারতেন, একথা বিশ্বাস করা চলে। কিন্তু তিনি ইচ্ছা করেই একে মহাকাব্যের রূপ না দিয়ে পাঁচালীর আকার দান করেছিলেন—এরূপ মনে করাই সঙ্গত। বাঙলা সাহিত্যের মধ্যযুগে কাহিনী কাব্য রচনার দুটি ধারা প্রচলিত ছিল। একটি ‘ধামালি’, অপরটি পাঁচালি। ধামালিতেও কাহিনী থাকতােতবে তা উক্তি-প্রত্যুক্তি-মাধ্যমে নৃত্যগীতাদিসহ অভিনীত হতাে বলেই মনে হয়। ধামালির আঙ্গিক ও বিষয় ছিল অপেক্ষাকৃত স্থূল, গ্রাম্য ও কুরুচিকর। বড়ু চণ্ডীদাস-রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ এরূপ ধামালি-জাতীয় রচনা। ধামালি ছাড়া অপর কাহিনী কাব্যগুলি ছিল পাঁচালি-জাতীয়’। পাঁচালিও ছিল দ্বিবিধ—’লৌকিক পাঁচালি’ ও ‘পৌরাণিক পাঁচালী। মঙ্গলকাব্যনাথ সাহিত্য আদি ছিল জনমনােরঞ্জক লৌকিক পাঁচালী। আর রামায়ণ-মহাভারতাদি মহাকাব্য ও বিভিন্ন পুরাণের অনুবাদ এবং চৈতন্যজীবনী-আদি গম্ভীর গ্রন্থগুলি পৌরাণিক পাঁচালী’- রূপেই পরিচিত। কৃত্তিবাসের রামায়ণও এ জাতীয়-এক পৌরাণিক পাঁচালী।
মৌলিকত্ব ও বৈশিষ্ট্য: এবার অনুবাদের প্রসঙ্গ। সােজা কথায় বলা চলে, কৃত্তিবাস মহাকবি ছিলেন, তিনি অনুবাদক মাত্র নন। বাল্মীকি রামায়ণকে তিনি অনুসরণ করেছেন, রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ করেন নি। প্রয়ােজনমতাে তিনি গ্রহণ-বর্জন, সংযােজন ও সংস্কার করে অতি প্রাচীন কালের আর্যরামায়ণকে সমসাময়িক কালের উপযােগী বাঙলা রামায়ণে পরিণত করেছেন। কাহিনী-পরিকল্পনাতেও তিনি একান্তভাবে বাল্মীকির অনুসরণেই নিরত ছিলেন না, প্রয়ােজনমতাে তিনি মহাভারত’, জৈমিনি ভারত, অদ্ভুত রামায়ণ এবং বিভিন্ন পুরাণেরও দ্বারস্থ হয়েছেন। কবিমাত্রই সমাজ-জীবনের রূপকার কবি কৃত্তিবাসও সমাজের সৃষ্টি এবং সমাজের তথা যুগমানসের দিকে দৃষ্টি রেখেই রামায়ণের পুনর্গঠন কল্পনা করেছিলেন।
বাঙলাদেশের সমাজ জীবন কৃত্তিবাসের জীবৎকালে ছিল অমানিশার অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন, শিক্ষা-সংস্কৃতি, বিদ্যা-বৈদগ্ধ্য কোনদিক থেকেই আলাের প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়নি। স্বভাবতঃই প্রাচীন যুগের মহান আদর্শের প্রতি সমকালীন বাঙালীর দৃষ্টি আকর্ষণই ছিল কবির অভিপ্রেত। অথচ সমকালে তিনি কোথাও ক্ষত্রিয়বীর্য, ব্রাহ্মণ্যতেজ, নিষ্ঠুর প্রতিহিংসা বা অন্তর্গঢ় ভক্তির সন্ধান পান নি, তাই জাতিগতভাবে যা’ বাঙালীর বৈশিষ্ট্য, তারি মধ্যে তিনি সেই আদর্শকে প্রতিফলিত করতে চেষ্টা করেছেন। রামায়ণের গার্হস্থ্য জীবনের খুঁটিনাটি রামলক্ষ্মণাদির চরিত্র, পিতৃভক্তি, পত্নী-প্রেম, ভ্রাতৃষ্নেহ-আদি মনের কোমলবৃত্তিগুলিরই আদর্শরূপ ফুটিয়ে তুলে তিনি বাঙালীকে আত্মজাগরণে উদ্বুদ্ধ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। অর্থাৎ, মূলের আক্ষরিক অনুবাদ না করে কৃত্তিবাস বস্তুত রামায়ণের বঙ্গীকরণেই সচেষ্ট হয়েছিলেন। রামায়ণের দার্শনিক তত্ত্ব কিংবা তাত্ত্বিক বাদ-বিতণ্ডাকে এড়িয়ে তিনি জনসাধারণের অঙ্গে একাত্ম হয়ে তাদের পক্ষে সহজবােধগম্য সরল, প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষায় রামায়ণ-কাহিনী পরিবেশন করেছেন। অথচ তিনি রামায়ণের মূল সৌন্দর্য অক্ষুন্ন রেখেই কাহিনীকে মূলানুগভাবে পরিবেষণ করতে সক্ষম ছিলেন তার প্রমাণ গ্রন্থমধ্যে সর্বত্র বিদ্যমান। ডঃ তারাপদ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন, “কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙ্গালী জাতির স্বরূপ দেখিবার দর্পণ-সদৃশ। ইহা যে যুগজয়ী হইয়াছে এবং রাজসভা ও চতুষ্পাঠী হইতে আরম্ভ করিয়া দরিদ্র পল্লীর মুদীর দোকানে পর্যন্ত স্থান পাইয়াছে, তাহার আসল কারণ এই বঙ্গীয় বৈশিষ্ট্য বা সঙ্কীর্ণতার জন্যই কবি ইহাকে মহাকাব্য বলিতে সাহস করেন নাই, পাঁচালী বলিয়া প্রচার করিয়াছেন।”
নব-সংযােজন: আমরা তার বিচারে যাবাে না। কিন্তু যুগের প্রয়ােজনে বিভিন্ন সূত্র থেকে কৃত্তিবাস তাঁর নিজস্ব রামায়ণ-পাঁচালীতে যে সকল বিষয় সংযােজন করেছেন, তাদের প্রধান কটি বিষয়ের নির্দেশ প্রয়ােজন। এদের মধ্যে আছে—দস্যু রত্নাকরের কাহিনী, হরিশ্চন্দ্র উপাখ্যান, দিলীপের অশ্বমেধ যজ্ঞ, রঘুর দিগ্বিজয়, তরুণীসেনের কাহিনী, অহিরাবণ-মহীরাবণ কাহিনী, রাবণের, চণ্ডীপাঠ, রামচন্দ্রের অকালবােধন ও দুর্গাপূজা, লবকুশের কাহিনী প্রভৃতি। বস্তুতঃ বাঙালী-চরিত্রের সাধারণ দোষ-গুণ, তাদের আচরণ ও জীবনযাত্রার বৈশিষ্ট্য সমুদয় ফুটিয়ে তোলার জন্য কবি যে সকল উপাদান প্রয়ােজনীয় বােধ করেছেন সে সমস্ত কিছুরই সমাহার ঘটিয়েছেন তার কাব্যে। বিশেষ করে রামায়ণের আদিম প্রকৃতির মধ্যে কৃত্তিবাস বাঙালী-জনােচিত ভক্তিরসকে সঞ্চারিত করে দিতে পেরেছিলেন। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের উক্তি স্মরণীয় : “মূল রামায়ণকে অবলম্বন করিয়া বাঙ্গালীর হাতে রামায়ণ স্বতন্ত্র মহাকাব্য হইয়া উঠিয়াছে। এই বাংলা মহাকাব্যে বাল্মীকির সময়ের সামাজিক আদর্শ রক্ষিত হয় নাই। ইহার মধ্যে প্রাচীন বাঙ্গালী সমাজেই আপনাকে ব্যক্ত করিয়াছে।”
জনপ্রিয়তার কারণ: মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে তিনখানি মাত্র ধ্রুপদী সংস্কৃত কাব্য অনূদিত হয়ে বাঙালীর হৃদয়-মন হরণ করেছিল, এদের মধ্যে নিঃসন্দেহে কৃত্তিবাস-রচিত ‘রামায়ণ পাঁচালী’র স্থান সর্বোচ্চ। অপর দু’খানি গ্রন্থ কাশীরাম দাসের ‘মহাভারত’ বা ‘ভারত পাঁচালী এবং মালাধর বসু কর্তৃক রচিত ভাগবতপুরাণের অনুবাদ শ্রীকৃষ্ণবিজয়’। বাঙলা সাহিত্যের আদিমধ্যযুগেই অথবা বাঙলা সাহিত্য গড়ে উঠবার মুখে কৃত্তিবাসই সম্ভবতঃ সর্বপ্রথম অনুবাদ কার্যে ব্রতী হয়ে পথ প্রদর্শকের মান্যতাই শুধু লাভ করেন নি, তিনি এমন একটি বিষয়কে এমনভাবে বাঙালী পাঠকের সামনে উপস্থাপিত করেছিলেন, যাকে তারা অসংশয়ে প্রাণের জিনিয বলে বরণ করে নিতে পেরেছিলেন। কৃত্তিবাসের জনপ্রিয়তার কারণ বিশ্লেষণ করে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য তার সমগ্র বাঙলা সাহিত্যের পরিচয়’ গ্রন্থে লিখেছেনঃ “মহাদেবের জটাজাল থেকে গঙ্গাকে মুক্ত করে তাকে পৃথিবীর বুকে বইয়ে দিয়ে ভগীরথ যেমন সমতলবাসীদের পিপাসা নিবৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন, মহাকবি কৃত্তিবাসও তেমনি সংস্কৃত ভাষার কঠোর শৃঙ্খলে আবদ্ধ অমৃতােপম রাম-কাহিনীকে স্বচ্ছন্দ মাতৃভাষায় বইয়ে দিয়ে কোটি কোটি বাঙালীর রসপিপাসাকে তৃপ্ত করেছিলেন।..কৃত্তিবাস যে কালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন জাতির জীবনে সেই কালটি ছিল প্রায়ান্ধকার যুগ। … জাতির জীবনের এই সঙ্কটময় মুহূর্তে রামায়ণের পুণ্যপ্রদীপ হয়ে আবির্ভূত হলেন সত্যকবি কৃত্তিবাস। রামায়ণের পরম পবিত্র গার্হস্থ্য জীবনের কাহিনীতে বাঙালী আপন জীবনের প্রতিফলন দেখতে পেলাে। রামায়ণের রাম-লক্ষ্মণ-ভরত-সীতা-হনুমান প্রভৃতির চরিত্রে বাঙালী মহৎ জীবনের উচ্চ আদর্শের স্বরূপ দেখতে পেলাে। কাজেই অতি স্বাভাবিক কারণেই বাঙালী কৃত্তিবাসকে আপনজনরূপে গ্রহণ করে নিয়েছে।”
শুধু এইজন্যই নয়, কৃত্তিবাস যেভাবে সমকালীন সমাজ জীবনের প্রেক্ষাপটে বাঙালী জীবনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধান করে রামায়ণ-কাহিনীকে, রামায়ণের বিভিন্ন চরিত্রকে ঢেলে সাজিয়ে বাঙালী রূপে দান করেছেন, যেভাবে বিভিন্ন কাহিনীর গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে বাঙালী মানসের উপযােগী করে রামায়ণকে গড়ে তুলেছেন, তাতে এটি আর বাল্মীকির রামায়ণ থাকেনি, এটি যথার্থই বাঙালীর রামায়ণ হয়ে উঠেছে। ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এই সমস্ত উদাহরণে বাঙালীর দৈনন্দিন জীবনচিত্র মিশ্রিত হইয়া বক্তব্যকে তীব্রতর করিয়াছে।…কৃত্তিবাসেরই অলঙ্কার সন্নিবেশে শুধু কৃত্রিম গতানুগতিক চিত্র গৃহীত হয় নাই, বাঙলাদেশের দৈনন্দিন জীবনও কাব্যে স্থান পাইয়াছিল। এইজন্যই কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙলাদেশে এত অধিক জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছে।”
কৃত্তিবাসের কাব্যে পাণ্ডিত্য, সরসতা, অলঙ্কারাদির সার্থক ব্যবহার, স্থানকালােপযােগী ভাষা ব্যবহার, বজ্রগর্ভ ভাষা প্রভৃতির সমাহার তার রামায়ণকে বাঙালীর শ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় সাহিত্যে রূপান্তরিত করেছে।
Leave a comment