কুতুবউদ্দিন আইবক (১২০৬-১২১০ খ্রিঃ):
তুর্কিস্থানের এক আইবক’ উপজাতি পরিবারে কুতুবউদ্দিনের জন্ম হয়। বাল্যকালেই তিনি নিশাপুরের কাজি ফব্রুদ্দিন আব্দুল আজিজ কুফি’র কাছে দাস হিসেবে বিক্রীত হন। ধর্মপ্রাণ ও জ্ঞানী আব্দুল আজিজ কুতুবউদ্দিনকে নানা শিক্ষায় পারদর্শী করে তোলেন। অশ্বারোহণ ও তিরন্দাজিতে তিনি বিশেষ পটুত্ব অর্জন করেন। কাজির মৃত্যুর পর তাঁর পুত্ররা কুতুবকে মহম্মদ ঘুরির কাছে বিক্রি করে দেন। নিজের শৌর্যবীর্য, নম্রতা, প্রভুভক্তি এবং সেবার দ্বারা কুতুব খুব সহজেই ঘুরির মন জয় করে নেন এবং দ্রুত পদোন্নতির ফলে একসময় মহম্মদ ঘুরির অন্যতম প্রধান ও বিশ্বস্ত সেনাপতিতে পরিণত হন। ঘুরির ভারত অভিযানের সময় কুতুবউদ্দিন যে দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন, তার বিনিময়ে ঘুরি তাঁকে ভারতীয় ভূখণ্ডের শাসক-পদে মনোনীত করেন। মহম্মদ ঘুরি যখন মধ্য-এশিয়ার রাজনীতিতে ব্যস্ত, তখন কুতুবউদ্দিন একান্ত অনুগত প্রতিনিধি হিসেবে ভারতে ঘুররাজ্য রক্ষা করার সঙ্গে সঙ্গে তুর্কি-অধিকারের সীমানাও বৃদ্ধি করে যান। আজমির ও মীরাটের বিদ্রোহ তিনি কঠোর হাতে দমন করেন এবং মিরাট, হাসি, দিল্লি, রণথম্ভোর, কিউল প্রভৃতি অঞ্চলে তুর্কি অধিকার সম্প্রসারিত করেন। রাজা জয়চাদকে পরাজিত করে তিনি কনৌজ দখল করেন এবং চান্দেল্ল রাজা পরমার্দিদেবকে পরাজিত করে কালিঞ্জর, মাহোবা এবং খাজুরাহোর ওপর তুর্কি-শাসন সম্প্রসারিত করেন। মহম্মদ ঘুরির মৃত্যুর সময় দিল্লি থেকে কালিঞ্জর এবং গুজরাট ও লাহোর থেকে লক্ষ্মণাবতী পর্যন্ত ভূখণ্ডে তুর্কি-আধিপত্য কায়েম হয়ে যায়।
মহম্মদ ঘুরির কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। দাসদের তিনি পুত্রবৎ দেখতেন এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করেছিলেন। মৃত্যুর প্রাক্কালে তিনি কুতুবউদ্দিনকে ‘মালিক’ উপাধি সহ প্রভূত ক্ষমতা অর্পণ করে যান। তাই ঘুরির মৃত্যুর পর লাহোরের অভিজাতদের অনুরোধে কুতুবউদ্দিন দিল্লি থেকে লাহোরে এসে শাসনকর্তৃত্ব গ্রহণ করেন (২৪ জুন, ১২০৬ খ্রিঃ)। ঘুর রাজ্যের শাসক গিয়াসউদ্দিন মামুদ তাঁকে ‘সুলতান’ উপাধি রাজদণ্ড পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু আইনত তিনি তখনও দাসত্বমুক্ত হয়নি। তাই তাঁর উপাধি হিসেবে কেবল ‘মালিক’ ও ‘সিপাহশালার’ ব্যবহার করতেন। ১২০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি আইনগতভাবে দাসত্ব মুক্ত হন।
যাইহোক মহম্মদ ঘুরির আকস্মিক মৃত্যু গজনির রাজনৈতিক অস্থিরতার সাথে ভারতের ঘুররাজ্যকেও জড়িয়ে ফেলে। কুতুবউদ্দিন মুখোমুখি হন নানামুখী সমস্যার। কারণ কুতুবউদ্দিন এখানে নিজেকে শাসক হিসেবে ঘোষণা করলেও, তার কোনো সরকারি অনুমোদন ছিল না। বিশেষত একজন ক্রীতদাস হিসেবে সিংহাসনে তাঁর অধিকারের বৈধতা ইসলামে স্বীকৃত ছিল না। পরস্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষী অন্যান্য তুর্কি-ক্রীতদাসরা, যারা মহম্মদ ঘুরির খুব বিশ্বস্ত ও স্নেহভাজন ছিলেন, তাঁরাও ভারত-ভূখণ্ডে কুতুবউদ্দিনের কর্তৃত্ব মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এই ধরনের দুজন বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তাঁর শশুর তাজউদ্দিন ইলদুজ এবং উচের শাসনকর্তা নাসিরউদ্দিন কুবাচা। ইলদুজ ঘুরির উত্তরাধিকারী গিয়াসুদ্দিন মামুদ কর্তৃক ক্রীতদাসত্ব থেকে মুক্তি এবং গজনি শাসনের স্বীকৃতিলাভ করার পরেই দিল্লির ওপর কর্তৃত্ব দাবি করেন। এই দাবি খুব একটা অযৌক্তিক ছিল না। কারণ দিল্লি গজনি রাজ্যের অংশ হিসেবেই অধিকৃত হয়েছিল। নাসিরউদ্দিন কুবাচাও দিল্লির সিংহাসন দখলের জন্য লালায়িত ছিলেন। এদিকে খারিজমের শাহ আলাউদ্দিন মহম্মদও গজনি এবং দিল্লি অধিকারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তা ছাড়া, তুর্কিদের ভারতীয় প্রতিপক্ষ রাজপুতগণও নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে হৃত রাজ্যসমূহ পুনর্দখলের জন্য গোপন প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন।
কুতুবউদ্দিন যথেষ্ট দক্ষতার সাথে এই সকল সমস্যার মুখোমুখি হন। তিনি দৃঢ়তার সাথে ইলদুজের দাবিকে অস্বীকার করেন এবং দিল্লি-দখলে অগ্রণী ইলদুজ-এর বাহিনীকে পাঞ্জাবে পরাজিত করে গজনি দখল করে নেন। ইলদুজ কুহিস্তানে পালিয়ে আত্মগোপন করেন। কিন্তু কুতুবউদ্দিনের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে গজনির জনগণ ইলদুজকে ফিরে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। এমতাবস্থায় কুতুবউদ্দিন ভারতে ফিরে আসেন এবং সামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে লাহোরে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। তুর্কি অভিজাতদের সমর্থনলাভের জন্য তিনি বৈবাহিক সম্পর্কের জাল বিস্তার করেন। কুবাচার সাথে নিজ ভগিনীর বিবাহ দেন এবং তাঁর জনৈক দক্ষ ক্রীতদাস ইলতুৎমিসের হাতে নিজকন্যাকে সমর্পণ করেন।
বাংলা-বিহারের অভ্যন্তরীণ সংকট কুতুবউদ্দিনকে সাময়িকভাবে বিব্রত করেছিল। বাংলা-বিহার বিজেতা বখতিয়ার খলজিকে হত্যা করে আলিমর্দান সেখানকার ক্ষমতা দখল করেছিলেন। কিন্তু আলিমর্দানের আচরণে অসন্তুষ্ট খলজি মালিকরা মহম্মদ শিরানের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়ে আলিমর্দানকে পদচ্যুত ও বন্দি করেন। আলিমর্দান কোনোক্রমে মুক্ত হয়ে কুতুবউদ্দিনের সাহায্যপ্রার্থী হন। কুতুব আলিমর্দানের সাহায্যে অযোধ্যার শাসক কোয়াজ রুমি’কে অগ্রসর হবার নির্দেশ দেন। রুমি খান কূটকৌশল ও শক্তিপ্রদর্শন করে খলজি মালিকদের বশীভূত করেন এবং আলিমর্দানকে বাংলার শাসনকর্তৃত্বে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন।
কুতুবউদ্দিন মাত্র চার বছর শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দের পর অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করা ছাড়া নতুন রাজ্যদখলের কোনো ইচ্ছা তাঁর ছিল না। কারণ নতুন রাজ্যদখলের পরিবর্তে দখলিকৃত রাজ্যে আইন ও প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা তাঁর কাছে জরুরি মনে হয়েছিল। এ কাজে তাঁর সাফল্য নির্ভর করছিল তাঁর ওপর তুর্কি অভিজাতদের আস্থা ও বিশ্বস্ততা স্থাপনের ওপর। কিন্তু সেই কাজ সম্পন্ন করার আগেই চুঘান খেলার সময় ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে তিনি মৃত্যবরণ করেন (১২১০ খ্রিঃ)।
কুতুবউদ্দিন আইবকের কৃতিত্বের মূল্যায়ন :
১১৯২ খ্রিস্টাব্দে তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে অংশগ্রহণ আমৃত্যু (১২১০ খ্রিঃ) ভারতীয় রাজনীতির অঙ্গনে কুতুবউদ্দিন আইবকের পদচারণা ঘটেছে। মহম্মদ ঘুরির সহকর্মী হিসেবে রণক্ষেত্রে তিনি যেমন দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন, তেমনি ঘুর-অধিকৃত ভারত-ভূখণ্ডের উপশাসক হিসেবেও যথেষ্ট কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। অর্থাৎ ভারতে তাঁর কর্মকাণ্ডের প্রথম পর্বে ১১৯২ থেকে ১২০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে, তিনি একান্ত অনুগত শাসক এবং সমরকুশলী সৈনিক হিসেবে কৃতিত্বের দাবিদার। ১২০৬ থেকে ১২০৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে তিনি দিল্লিকে কেন্দ্র করে আধা-স্বাধীন শাসনের সূচনা করেন। অতঃপর গজনির বৈধ-আধিকারিক কর্তৃক তিনি দাসত্বমুক্ত হন এবং এদেশে স্বাধীন শাসনের সূচনা করেন। এই তৃতীয় বা শেষ পর্বের বিস্তৃতি ১২০৮ থেকে ১২১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। প্রথম পর্বে তিনি ছিলেন দক্ষ যোদ্ধা, দ্বিতীয় পর্বে তিনি একজন কূটনীতিবিদ এবং শেষ পর্বে তিনি ছিলেন এক নতুন সাম্রাজ্যের সংগঠক।
কুতুবউদ্দিনের কৃতিত্ব প্রসঙ্গে অধিকাংশ ঐতিহাসিকই একমত হয়ে তাঁকে ভারতে এক নতুন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকার করেছেন। ড. শৰ্মা (S. R. Sharma) কুতুবউদ্দিনকে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের সাথে তুলনা করে বলেছেনঃ “Some of his successors might have added more glory to the empire as a whole, but the groundwork and examples were Aibak’s.” ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ তাঁকে ‘ভারতবর্ষে মুসলিম বিজয়ের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
বস্তুত সামান্য ক্রীতদাস রূপে জীবন শুরু করে কুতুবউদ্দিন নতুন ভারত-রাজ্যের অধীশ্বরের আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে অনন্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর কোনো রাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য ছিল না, দেশে-বিদেশে তাঁর শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাবও ছিল না; তথাপি তিনি বিচলিত না হয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে মহম্মদ ঘুরির রাজ্যখণ্ডকে নিজ অধিকারে রাখতে এবং শেষ পর্যন্ত সেখানে স্বাধীনভাবে শাসনের বৈধ অধিকার অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ কৃতিত্ব কম নয়। কুতুবউদ্দিনের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব ছিল না। তিনি গজনির সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক উত্থান-পতনের স্রোত থেকে ভারতকে মুক্ত করতে সক্ষম হন। এর ফলে খারিজম শাহের শত্রুতা থেকে মুক্ত হয়ে তিনি ভারতবর্ষের রাজনীতিতে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করতে পারেন।
অধ্যাপক সতীশচন্দ্রের মতে: “এ ব্যবস্থা ভারতের পক্ষে মঙ্গলজনক ছিল, কারণ এর ফলে ভারতকে মধ্য-এশিয়ার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়তে হল না। তা ছাড়া, এর দ্বারা বিদেশের ওপর নির্ভর না করে স্বাধীনভাবে দিল্লি-সুলতানির বিকাশের সুযোগ আসে।” ভারতের তুর্কি অভিজাতদের আনুগত্যলাভের ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট সংযম ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেন। ইলদুজ এবং কুবাচারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন এবং বিচক্ষণতার সাথে বাংলাদেশের বিদ্রোহী খলজিদের শান্ত করে আলিমর্দানকে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার ঘটনা কুতুবউদ্দিনের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
শাসক হিসেবে কুতুবউদ্দিন মৌলিকত্বের পরিচয় দিতে পারেননি। কোনোরূপ শাসনতান্ত্রিক পরিকাঠামো তিনি গঠন করেননি। তাঁর শাসনকালের স্বল্পায়ু এবং যুদ্ধবিগ্রহের প্রাবল্য সম্ভবত তাঁকে এ ব্যাপারে ভাবনাচিন্তার সময় দেয়নি। তবে দানশীলতা, শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ ও জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ইত্যাদি মানবিক গুণগুলি তাঁর মধ্যে ছিল। ‘তাজ-উল-মাসির’গ্রন্থের লেখক হাসান নিজামী তাঁর ন্যায়পরায়ণতার ও কর্তব্যবোধের প্রশংসা করে লিখেছেন : “He dispensed even handed justice to the people and exerted himself to promote the peace and prosperity of the realm. He was kind and generous to the people and practised charity liberally.” দানশীলতার জন্যই তিনি ‘লাখবক্স’ অর্থাৎ লক্ষদাতার খ্যাতি অর্জন করেন। সপ্তদশ শতকে ফিরিস্তার বিবরণেও দেখা যায় যে, দক্ষিণ ভারতে দানশীল ব্যক্তিকে ‘যুগের আইবক’ বলে আখ্যায়িত করা হত। সমকালীন প্রখ্যাত লেখক হাসান নিজামী, ফকরে মুদাবির প্রমুখ কুতুবউদ্দিনের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন। দিল্লি ও আজমিরে তিনি যথাক্রমে কোয়াত-উল-ইসলাম এবং দুই-দিন কা ঝোপড়া নামক দুটি মসজিদও নির্মাণ করেন। দিল্লির প্রখ্যাত কুতুবমিনারের নির্মাণকার্য তাঁর আমলেই শুরু হয়েছিল।
ব্যক্তিগতভাবে কুতুবউদ্দিন ছিলেন ধর্মপ্রাণ। তবে ধর্মীয় উদারতা তাঁর ছিল না। অনহিলবারা এবং কালিঞ্জর দখলের সময় তিনি বিনাদ্বিধায় বহু মন্দির ধ্বংস করে তার ওপর মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। দানের কাজে তিনি যেমন ‘লক্ষদাতার’ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন, তেমনি লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করতেও তিনি পিছপা হননি। অবশ্য কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে, কুতুবউদ্দিনের ধর্মান্ধতা বা নৃশংসতা কেবলমাত্র যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে লক্ষ্য করা যেত। শান্তির সময়ে তিনি অনর্থক রক্তপাতের তীব্র বিরোধী ছিলেন। ‘তারিখ-ই-মুবারকশাহিতে বলা হয়েছে যে, কুতুবউদ্দিনের সেনাবাহিনী তুর্কি, ঘুরি, খোরাসান, খলজি, হিন্দুস্তানি প্রভৃতি নানা জাতির মানুষ দ্বারা গঠিত ছিল। কুতুবউদ্দিনের কঠোর নির্দেশের ফলে তারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সামান্যতম জিনিসও সংগ্রহ করার সাহস দেখাত না। তাই আবুল ফজল গজনির সুলতান মামুদকে ‘নিরপরাধীর হত্যাকারী’ বলে অভিহিত করলেও কুতুবউদ্দিনকে ‘ভালো এবং মহৎ গুণের অধিকারী’ বলে উল্লেখ করেছেন।
অধ্যাপক হবিবউল্লাহ কুতুবউদ্দিনের চরিত্রে তুর্কি ও পারসিক ধারার সমন্বয় ঘটেছে বলে মনে করেন। তিনি লিখেছেন: “A military of great energy and high merit, he combined the intrepidity of the Turk with the refined taste and genorosity of the Persiam.” বস্তুত, তুর্কিজাতির নির্ভীকতা এবং পারসিকদের উদারতার সমন্বয়ে কুতুবউদ্দিন যে শক্তি ও মনের অধিকারী হয়েছিলেন, তা তাঁকে ভারতবর্ষে নতুন সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপনের কাজে যথাযথভাবে পরিচালিত করেছিল। মধ্যযুগীয় শাসকদের সীমাবদ্ধতা তাঁর মধ্যেও ছিল। তবে সমকালীন অন্যান্য সামরিক নেতাদের তুলনায় তিনি ছিলেন মহত্তর গুণাবলির ধারক।
কুতুবউদ্দিন দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করলেও, তাঁকে সার্বভৌম নরপতির মর্যাদা দেবার প্রশ্নে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ, ড. কালীকিঙ্কর দত্ত প্রমুখ কুতুবউদ্দিনকে ‘ভারতীয় সুলতান’ বা ‘সুলতানি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা’ ইত্যাদি অভিধা দিলেও তিনি খলিফা কিংবা গজনি সাম্রাজ্যের সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত একজন স্বাধীন শাসক ছিলেন কিনা, সে বিতর্কের গভীরে যাননি। কুতুবউদ্দিনের আমলের মাত্র চারটি তাম্রমুদ্রা পাওয়া গেছে। ‘কুতবি’ নামাঙ্কিত এই মুদ্রাগুলি কুমরান থেকে প্রচারিত হয়েছিল বলে নেল্সন রাইট (Nelson Right) মন্তব্য করেছেন। ১২০৬ থেকে ১২০৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তীকালে তিনি যে নিজনামাঙ্কিত কোনো মুদ্রা চালু করেননি, একথা অনেকেই স্বীকার করেন। ইলদুজ মনে করতেন, ভারতে কুতুবউদ্দিন-অধিকৃত ভূখণ্ড আইনত গজনির রাজ্যাংশ। এই কারণেই তিনি একাধিকবার ভারত-ভূখণ্ড দখল করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের খলজি অভিজাতদের ওপর কুতুবউদ্দিনের কোনো আইনগত কর্তৃত্ব ছিল না। ইতিয়ারউদ্দিনের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও দক্ষ সেনাপতি বেঁচে থাকলে কুতুবউদ্দিনের ভাগ্যের কী পরিণতি ঘটত, তা বলা বেশ কঠিন। কারণ এঁদের দুজনের মধ্যে মর্যাদাগত কোনো প্রভেদ ছিল না। এমনকি আলিমর্দান নিজের হৃতরাজ্য ফিরে পাবার জন্য কুতুবের সাহায্যপ্রার্থী হলেও, পূর্বাঞ্চলীয় ভূখণ্ডের ওপর কুতুবউদ্দিনের অধিকার তিনি স্বীকার করেননি। এমনকি পরবর্তীকালে সুলতান ফিরোজ তুঘলক জুম্মাবারের খুৎবায় পাঠ করার জন্য দিল্লির পূর্ববর্তী সুলতানের নামের যে তালিকা প্রকাশ করেছিলেন, তাতে কুতুবউদ্দিনের নাম ছিল না।
ড. ত্রিপাঠী (R. P. Tripathy) লিখেছেন: “It is however not correct to regard Qutubuddin as the sovereign ruler of Muslim India, or Delhi, as yet the capital of the Indian Empire.” অবশ্য ড. ত্রিপাঠী এটা স্বীকার করেছেন যে, ভারতে বহির্দেশীয় প্রভাব থেকে মুক্ত স্বাধীন সুলতানি প্রতিষ্ঠার পথ কুতুবউদ্দিনই প্রশস্ত করে গিয়েছিলেন। ড. হবিবউল্লাহও স্বীকার করেছেন যে, দিল্লি রাজ্যের প্রধান স্থপতি ছিলেন কুতুবউদ্দিন। তিনি লিখেছেন : “Muizziudin merely supplied the motive power; Aibak was responsible for the detailed planning and initiation of the Delhi state.” তাই বলা যেতে পারে, কুতুবউদ্দিন আক্ষরিক অর্থে হয়তো সার্বভৌম শাসক হিসেবে স্বীকৃত ছিলেন না, তবে তাঁর ক্ষমতা ভোগদখলের মধ্যে বহিঃশক্তির ওপর নির্ভরশীলতাও ছিল না। তিনি হয়তো সার্বভৌমত্ব পাননি, তবে সার্বভৌম দিল্লির সুলতানির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনিই।
Leave a comment