“ওরা যদি গোড়া বেঁধে খেলতে শিখত, তাহলে এ-অবস্থা নিশ্চই হত না”- ‘ওরা’ কারা? ‘গোড়া বেঁধে’ খেলতে শেখার অর্থ কী? উক্তিটি ব্যাখ্যা করো।
এখানে ‘ওরা’ বলতে ইউবোপীয় শিল্পীদের কথা বলা হয়েছে।
ইউরোপীয় শিল্পীরা বিশেষ করে শিল্প ও সংস্কৃত শিল্পীরা ছবিকে পালিশ করার দিকে বেশি নজর দিয়েছে। ছবির সংস্কার কর্ম বলতে বোঝায় এই ‘পালিশ করা’ বা ‘চাকচিক্য সৃষ্টি করা। একেই সমালোচনা শাস্ত্রে বলে “Ornamentalism”। ছবিকে নিখুঁত করার প্রেরণা এই শিল্পীরা পেয়েছিল। যে-কোনো শিল্পকর্মকে নিখুঁত করার নেশা শিল্পীকে পেয়ে বসে। H. Caudwell বলেছেন: The desire for worthiness in the artist’s mind depends on the conception of ideal forms which if not attainable, are at least conceivable. The belief in a conceivable perfection of expression is at the root of all artistic effort” এই ‘perfection of expression”-এর শৈল্পিক প্রয়োজনীয়তা যথেষ্ট। কিন্তু ‘perfection’-এর দ্বারা মায়াবদ্ধ হলে শিল্পকে পথভ্রষ্ট হতে হবে। এই অভ্যাসের আধিক্য শিল্পীকে সত্যভ্রষ্ট করে দেয়। এই শিল্পীর কাজ ভাবসৃষ্টি, রসসৃষ্টি। ছবির মধ্যে ভাব ও রসসৃষ্টি শিল্পীর প্রধান কাজ। তার বদলে শিল্পী যদি কেবল আঙ্গিকের সন্ধান করেন, শিল্পের রূপগত দিক নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে শিল্পসৃষ্টি ব্যর্থ হতে বাধ্য, শিল্পসত্য ক্ষুণ্ণ হতে বাধ্য। এই ভুলের ফাঁদে শিল্পী যদি জড়িয়ে পড়েন, তাহলে শিল্প আর এগোতে পারে না। একটা সময় দেখা যায় সুমুখের পথ বন্ধ। এদের পটুয়া শিল্প যেমন পুরাণের বিশ্বাস-নির্ভর হয়ে পুষ্ট হয়েছে। তেমনি য়ুরোপীয় শিল্পীরাও খ্রিস্টীয় পুরাণে বিশ্বাস করে সৃষ্টিশীল হয়েছে। ইউরোপীয় শিল্পের মধ্যে দেখা গেল রেমব্রান্টের পর থেকে এই খ্রিস্টীয় বিশ্বাস কমে আসছিল। ফলে শিল্পক্ষেত্রে অশান্তি বা সমস্যা দেখা দিয়েছিল।
ইউরোপীয় শিল্পের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে পুরাণে বিশ্বাস শিল্পীদের ভিত্তি রচনা করে থাকে। এইটেই শিল্পের গোড়ার কথা। শিল্পীকে গোড়া বেঁধে খেলতে বলার অর্থ এই ভাবনিষ্ঠা বা পুরাণনির্ভরতাকে শিল্পের ক্ষেত্রে বিশদীকৃত করা। অর্থাৎ পটুয়া শিল্প বা ইউরোপীয় শিল্পের প্রাক-রেমব্রান্ট পর্বের শিল্পীরা পুরাণের ওপর নির্ভর করত। এই নির্ভরতা একটা দৃঢ়মূল বিশ্বাসের মতো শিল্পের গোড়াকে শক্ত করেছে, শিল্পের ভাববৈচিত্র্যকে সৃষ্টি করেছে। এই ভাবনিষ্ঠা মন্দীভূত হয় যখন শিল্প-সৃষ্টিতে আঙ্গিক প্রধান হয়ে ওঠে। শিল্পে পালিশ বা আড়ম্বর যদি বাড়ে, তাহলে শিল্পীর ভেতরের ব্যাপারটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই “Perfection of expression” (Caudwell) কিন্তু নেশার মতো শিল্পীকে পথভ্রষ্ট করে দেয়। ইউরোপীয় শিল্প আলোচনা প্রসঙ্গে, লেখক এই ভাঙনের রূপটি প্রত্যক্ষ করেছেন। লেখকের ধারণা আধুনিক ইউরোপীয় শিল্পীরা যদি গোড়া বেঁধে খেলত, তাহলে আর তাদের এই বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হত না। শিল্পকে চক্চকে ও পালিশে ঝকঝকে করে তোলার পেছনে শিল্পীদের সংস্কার করার নেশা থাকে। লেখক এই নেশাকে দাবা খেলার সঙ্গে তুলনা করেছেন। লেখকের ভাষায় “অনেকটা দাবা খেলার মতো। যতক্ষণ খেলবার নেশা ছিল ততক্ষণ আলাদা কথা, কিন্তু হঠাৎ এমন জায়গায় এসে পড়েছে যে পথ আর নেই। যে পথেই যেতে যায় মাত হয়ে যায়। এদিকে খ্রিস্টের পুরাণে বিশ্বাসও ক্ষয়ে গেছে এবং আর কোনো পুরাণও খুঁজে পাচ্ছে না। ওরা তাই সমস্ত খেলার ছক লন্ডভন্ড করতে চায়। যে চাল এতদিন দিয়ে এসেছে সে সমস্ত চাল ফিরিয়ে নিতে চায়।” এই তুলনার মধ্য দিয়ে শিল্পীদের ভুলের ফলশ্রুতিকে বোঝানো হয়েছে। একেই লেখক ‘গোড়া বেঁধে খেলার’ কথা বলেছেন। অর্থাৎ মূলে যদি বিশ্বাসের শক্তি থাকে, তাহলে শিল্প শেষ পর্যন্ত আর অগ্রগতির পথে অন্ধগলিতে হারিয়ে যায় না। এখানে গোড়া বেঁধে খেলতে বলার মধ্যে সেই পুরাণ বিশ্বাসের দৃঢ়তার কথা সমালোচক বলেছেন।
“কি বিপুল অপচয় এই প্রয়াসের”—কোন্ প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে? এই উক্তির তাৎপর্য বিচার করো।
ভারতবর্ষ থেকে বিভিন্ন দেশে বা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে, কারখানা বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলিতে বছর বছর ছাত্র পাঠানো হয়। এরা বিদেশ যায় মেকানিক্যাল ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার নানা শাখায় জ্ঞান লাভের জন্য। সেখানে তাদের ব্যর্থতা লেখকের কাছে ‘বিপুল অপচয়’ বলে মনে হয়েছে। এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগুলির ফলাফল বিশ্লেষণ করলে আনুপাতিক ব্যর্থতার কথা প্রসঙ্গে এই উক্তি করা হয়েছে।
বিদেশে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষা অর্জন করতে গিয়ে যে সমস্যার মুখোমুখি হয়, তাহল প্রাথমিক প্রস্তুতির অভাব। প্রাথমিক প্রস্তুতি বা বিধিনিয়ম আয়ত্তে না থাকলে জ্ঞানের উচ্চস্তরে আরোহণ করা যায় না। লেখক মনে করেন ছাত্রসমাজের মধ্যে মেধা বা উপকরণের অভাব নেই। তার উৎকর্ষের অভাব এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী নয়। কিন্তু শিক্ষকদের পরিচালনার ক্ষেত্রে যদি আন্তরিকতা বা কৃতিত্ব না থাকে তাহলে ছাত্রদের মধ্যে এই উৎকর্ষের শ্রীবৃদ্ধি হয় না। এই মৌলিক ত্রুটির জন্য ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্র পরীক্ষায় ঈপ্সিত ফললাভে ব্যর্থকাম হয় এবং মানবশক্তির অপচয় ঘটে। দেশের ছাত্রসমাজ দেশের প্রাণশক্তি। এই যুবশক্তিরূপ প্রাণশক্তি যদি জীবনের প্রথম পর্বেই মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, তবে জীবনীশক্তির অপচয় অনিবার্য। পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ছাত্ররা যে জীবনযুদ্ধে সাফল্যলাভ করবে এ-বিষয়ে কোনো আশাভরসা ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে নেই। মানবজীবনে ছাত্রজীবনের গুরুত্ব অসাধারণ। এই সময় যে কর্মশক্তি জাগ্রত থাকে তা পরবর্তীকালে আর থাকে না। এই কারণে এই সময় শিক্ষকদের পরিচালনার গুরুত্ব অপরিহার্য। প্রাথমিক কর্মপদ্ধতি আয়ত্ত না হলে শিক্ষার্থীরা কখনও পরীক্ষায় সাফল্যলাভ করতে পারবে না। এই পদ্ধতির আয়ত্তের অভাবে ছাত্ররা ত্রস্ত বোধ করে। তার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় ব্যর্থতার ফলে ছাত্রশক্তির নিদারুণ অপচয় ঘটে। এই অপচয় নিবারণ করার জন্য চিন্তাশীল বৈজ্ঞানিক লেখক কয়েকটি প্রস্তাব নিবেদন করেছেন। তার মধ্যে প্রথম প্রস্তাব মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ। এই পদ্ধতি প্রচলিত না হলে ছাত্ররা কখনও বিষয়ের প্রতি একাগ্রতা ও অধিকার লাভ করতে পারবে না। বিষয়কে সঠিকভাবে না জানার ফলে ছাত্রদের শিক্ষা অপরিণত থেকে যায়। তার ফলে গোড়ায় গলদের জন্যই ছাত্ররা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়। বছর বছর এই অকৃতকার্যতার ঘটনা ঘটলে কোনো জাতি উন্নতির শীর্ষে আরোহণ করতে পারে না। এই কারণে লেখক একে ‘অপচয়’ বলে বর্ণনা করেছেন। এই অপচয় সমগ্র জাতিকে পথভ্রষ্ট করে বলে লেখক একে জাতীয় প্রয়াসের অপচয় বলেছেন। লেখক তাই বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন “কি বিপুল অপচয় এই প্রয়াসের।” এই উক্তির মধ্যে লেখকের শিক্ষাচিন্তার এক গূঢ় তাৎপর্যই ফুটে উঠেছে।
Leave a comment