“সাধারণ লোকে কাজকর্ম করে চলে ফেরে; তিনি কাজ না করিবার ও না-চলিবার বিপুল আয়োজনটির কেন্দ্রস্থলে ধ্রুব হইয়া বিরাজ করেন।”- কার সম্বন্ধে এই মন্তব্য করা হয়েছে এবং কেন?

আলোচ্য মন্তব্যটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হালদারগোষ্ঠী’ গল্পের পরিবারের কর্তা মনোহার হালদার সম্বন্ধে করা হয়েছে।

হালদার বাড়ির কর্তা মনোহরলাল ছিলেন সাবেককালের বড়োমানুষি চালে অভ্যস্ত মানুষ। নিজে বিষয় সম্পত্তি কিছুই দেখতেন না। এমনকি হাতের কাছের ছোটোখাটো কাজও করতেন না। বিষয় সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তিনি সঁপে দিয়েছিলেন বাড়ির আমলা নীলকণ্ঠের হাতে। কোনো নালিশ তাঁর কাছে এলে তিনি বিরক্ত হয়ে উঠতেন—বিষয়কর্মের বিরক্তিই যদি তাঁকে পোহাতে হয়, তবে বিষয় ভোগ করে তাঁর সুখ কি? তাই তাঁর কাছে কোনো আপিল পৌঁছাত না। যা কিছু ব্যবস্থা নীলকণ্ঠই করতো। আর দৈনন্দিন কাজ কর্মের জন্যে নিযুক্ত ছিল তাঁর আর এক অনুচর রামচরণ। মনোহরের হাত গুড়গুড়ির নলটা পর্যন্ত পড়ে গেলে তিনি নিজে হাতে তা তুলতে পারেন না, রামচরণের ডাক পড়ে সেটি তুলে দেবার জন্যে। অথচ তিনি বাড়ির কর্তা এবং সমাজেরও শিরোভূষণ। নিজে কোনো দৈহিক শ্রম না করে, অন্যকে দিয়ে নিজের সমস্ত কাজ করিয়ে নিশ্চল হয়ে মহিমাময় আসনটি অধিকার করে রাখার প্রবণতাকে উক্ত মন্তব্য দ্বারা বর্ণনা করা হয়েছে।


“সন্তোষগুণটি মানুষের মহৎ গুণ। কিন্তু স্ত্রীর স্বভাবে এই মহৎ গুণটি তাহাকে পীড়া দেয়।” —কার সম্বন্ধে এই কথা বলা হয়েছে? কেন বলা হয়েছে?

আলোচ্য কথাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হালদারগোষ্ঠী’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বনোয়ারিলালের স্ত্রী কিরণ সম্বন্ধে বলা হয়েছে।

স্ত্রী কিরণকে সে অত্যন্ত ভালোবাসতো। স্ত্রীকে খুশি করার জন্যে নানা উপায় উদ্ভাবন করে, দুর্মূল্য দ্রব্যাদি উপহার দিয়ে সে কিরণের মন অধিকার করতে চাইত। কিন্তু কোনো উপহারেই কিরণ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত না বলে বনোয়ারি মনে করতো উপহারটি তার স্ত্রীর পক্ষে মানানসই হয়নি। ফলে বনোয়ারির স্ত্রীকে খুশি করার উপায় অন্বেষণের স্পৃহা আরো বেড়ে যেত। বনোয়ারি সবচেয়ে সুখি হতো যদি স্ত্রীর কাছে নিজের ধনশক্তির নিদর্শন দেখাতে পারত। কিন্তু কর্তার ব্যবস্থাপনায় তা অসম্ভব। সে সম্পত্তি একদিন তার হাতে আসবে, আজ তার থেকে অংশ বিশেষ নিতে হলেও বাড়ির বেতনভুক আমলা নীলকন্ঠের দাক্ষিণ্যের অপেক্ষায় থাকতে হয়। কিরণ যদি নিজে মুখে কিছু চাইতো তা হলে বনোয়ারির পক্ষে সুবিধা হতো। কিন্তু সে নিজে কিছু চায় না, উপরন্তু কোনো বস্তু এনে দিলে সে যে কতটা খুশি হয়েছে তা বোঝার উপায় থাকতো না। কিরণের এই সম্বৃত উচ্ছ্বাস, নীরবে উপহার গ্রহণ, নবযৌবনের নবজাগ্রত প্রেমের নির্জন সাধনায় প্রয়োজন বোধের অভাব—এই সমস্তই বনোয়ারিকে অতৃপ্ত করে তুলতো। সমস্ত কিছুর মধ্যে কিরণের এই সন্তুষ্টি মনোভাব দেখেই সে মনে মনে পীড়িত হয়েছিল।


“কিরণ করুণকণ্ঠে যে বার বার করিয়া বলিতেছিল যে তাহারা ইহার কোনো প্রতিকার করিতে অক্ষম, সেটা বনোয়ারির বুকে শেলের মতো বিধিল।”—উৎস নির্দেশ করো। কিরণের কথাগুলি বনোয়ারির বুকে শেলের মতো বিধল কেন?

আলোচ্য মন্তব্যটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘হালদারগোষ্ঠী’ গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে।

বনোয়ারি তার স্ত্রী কিরণকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতো। স্ত্রীকে খুশি করানোর জন্যে সে রকমারি পরিকল্পনা করতো, উপহার দিত। কিন্তু কোনো উপহারেই কিরণ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত না বলে বনোয়ারি মনে করতো উপহারটি তার স্ত্রীর পক্ষে মানানসই হয়নি। স্ত্রীর প্রতি তার এই রকম ভালোবাসার কথা ঘরে বাইরে কারো অজ্ঞাত ছিল না। ভিটে বাড়ির প্রজা মধুকৈবর্তও বনোয়ারির এই ভালোবাসাকে পুঁজি করে ঋণ মকুবের দরবার করতে তার স্ত্রী সুখদাকে কিরণের কাছে পাঠিয়েছিল। কিন্তু কিরণ, সংসারে নীলকণ্ঠের ব্যবস্থাপনায় যে কেউ আঁচড়টুকুও কাটতে পারে না সে কথা জানিয়ে সুখদাকে ফিরিয়ে দেবার উদ্যোগ করেছিল। তাদের এই বাক্যালাপ আড়াল থেকে বনোয়ারি শুনতে পেল। এবং কিরণ যে প্রতিকার করতে অক্ষম এই কথা তার বুকে শেলের মতো বিধল। সে ভাবল এই বিপদ থেকে মধুকৈবর্তকে উদ্ধার করতে পারলে তবেই কিরণকে যোগ্য উপহার প্রদান করা যায়। কেন না, সব স্ত্রীরাই স্বামীর ক্ষমতা ও পৌরুষ দেখতে আগ্রহী। অথচ, কর্তার ব্যবস্থাপনায় এই পরিবারের সে বড়োবাবু হলেও নীলকন্ঠের তুল্য ক্ষমতা তার নেই। তার স্ত্রী কিরণকে অসহায়ের মতো বলতে হয় তারা কোনো প্রতিকারে অক্ষম। সামান্য এক ভিটে বাড়ির প্রজার কাছে কিরণের এই দীনতাই তাকে অশান্ত করে তুলেছিল।