“কিন্তু বিষয়টা এমন যে তামাক টানিতে টানিতে এ সম্বন্ধে ঘণ্টাখানেক দেড়েক অনর্গল শখের দুঃখ করা যাইতে পারে”- বিষয়টা কী? শখের দুঃখ বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
‘একরাত্রি’ গল্পের নায়ক তথা কথক একদিন সুরবালার স্বামী রামলোচন রায়ের বাড়িতে গেলে, রামলোচনের সঙ্গে তার বর্তমান ভারতের দুরবস্থা সম্বন্ধে বিস্তর আলাপ আলোচনা হয়েছিল। এখানে সেই বিষয়টির কথাই বলা হয়েছে।
সুরবালার স্বামী তথা স্থানীয় উকিল রামলোচন, ‘একরাত্রি’ গল্পের নায়কের সঙ্গে এক ছুটির দিনে দেশের দুরবস্থা বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। এই আলোচনার সময় তিনি দেশ সম্বন্ধে নানা কথা, দুঃখের সঙ্গে ব্যক্ত করেছিলেন। সে দুঃখকেই গল্পকার ‘শখের দুঃখ’ বলেছেন।
বস্তুত সব কালেই দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি সংক্রান্ত আলোচনা যথেষ্ট মুখরোচক এবং সেই সঙ্গে সময় কাটানোর বিলাসী গল্প প্রসঙ্গও বটে। সাধারণ মানুষরা দেশের দুরবস্থার কথা আলোচনা করতে গিয়ে চোখের জলে বুক ভাসালেও দেশোদ্ধারের কাজে এক পা বাড়াতে তারা আগ্রহী হন না। রামলোচন সেই ধরনের লোক যিনি মুখেই বাজীমাৎ করতে ভালোবাসেন। কাজের বেলা নিজের পেশার বাইরে তাঁকে পাওয়া সম্ভব হয় না। তাই নায়কের সঙ্গে গল্প করতে গিয়ে তামাক টানতে টানতে অর্থাৎ ইন্দ্রিয় সুখে আসক্তিতে সম্পৃক্ত হয়ে ঘণ্টাখানেক, ঘণ্টা দেড়েক দেশের দুরবস্থার জন্যে যে দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন, তাকে শখের দুঃখ বলা হয়েছে। যে দুঃখ প্রকাশ করতে গেলে কোন মানসিক এবং পার্থিব ক্ষতির আশংকা নেই। যে দুঃখ প্রকাশ করতে নিজের জীবনের ধারাকে কণামাত্র বিচলিত করার প্রয়োজন হয় না তাকেই শখের দুঃখ বলা যেতে পারে।
“সে কথা সত্য। সুরবালা আমার কী না হইতে পারিত।”—সুরবালা কে? সুরবালার সঙ্গে নায়কের বিচ্ছেদের কারণ কী? নায়কের আক্ষেপোক্তির কারণ কী?
‘একরাত্রি’ গল্পে কথক তথা নায়কের বাল্যসঙ্গিনী হল সুরবালা। তার সঙ্গে নায়ক একত্রে স্কুলেও গেছে আবার ‘বউ বউ’ও খেলেছে।
ছোটবেলা থেকেই সুরবালার মা কথায় কথায় উভয়ের বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করতেন। কৈশোরকালে নায়ক লেখাপড়ার জন্যে যখন কলকাতায় পালিয়ে আসে তখন নতুন হুজুগের হাওয়ার দোলায় তার মধ্যে স্বদেশ হিতব্রতের ভাবনার উদয় হয়। লেখাপড়া যেমনই হোক, দেশোদ্ধারের জন্যে চাঁদা তোলা, বক্তৃতার বো পাতা ইত্যাদি কাজে সে মেতে ওঠে। ঠিক এমন সময় গ্রামের থেকে পিতার পত্র আসে। তাঁরা নায়কের সঙ্গে সুরবালার বিবাহের ব্যবস্থা করতে চান, নায়কের অনুমতির তারা অপেক্ষা করছেন। কিন্তু দেশোদ্ধারের কার্যে ব্রতী নায়ক সে সময় সে কথায় কোনও আমলই দিল না। ফলে উকিল রামলোচন রায়ের সঙ্গে একাদশবর্ষীয়া সুরবালার বিবাহ হয়ে গেল। এ সংবাদ পেয়েও নায়কের কোন ভাবান্তর হল না।
বিবাহের পর সুরবালা পরস্ত্রী। আগের মতো নায়কের অধিকারভুক্ত সে নয়। এই কথা মনে পড়ায় নায়ক ব্যথিত হয়েছিল এবং রামলোচনবাবুর সঙ্গে গল্প করার সময় পাশের ঘরে সুরবালার অস্তিত্ব অনুভব করে বিগত দিনের অবহেলার কথা স্মরণ করে নায়ক এই আক্ষেপোক্তি করেছিল।
“ভাবিতাম মনুষ্য সমাজ একটি ভ্রমের জাল”— এ ভাবনার উদয় কার মনে হয়েছিল? গল্পের প্রেক্ষিতে ভাবনাটির তাৎপর্য বর্ণনা করো।
এই ভাবনার উদয় বিক্ষুদ্ধ নায়ক চিত্তে উদ্ভাসিত হয়েছিল।
‘একরাত্রি’ গল্পের নায়ক বা কথকের শৈশব থেকেই উচ্চাশা ছিল প্রবল। নায়কের পিতা নায়ককে জমিদারি সেরেস্তার নায়েব করতে চেয়েছিল। কিন্তু নায়ক ওই ছোট কাজ করতে আগ্রহী ছিল না। তার লক্ষ্য ছিল গ্রামের ছেলে নীলরতনের মতো কলকাতায় গিয়ে উচ্চবিদ্যা লাভ করে কালেক্টর সাহেবের নাজির হওয়ার। অবশেষে নায়ক একদিন কলকাতায় এসে পড়াশোনা করতে লাগল। সে সময় কলকাতায় চলছিল স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ। নায়কের তাজা তরুণ রক্ত সেই আন্দোলনে উদ্বেল হয়ে ওঠায় স্বদেশহিত ব্রতে সে আগ্রহী হয়ে ওঠে এবং স্বদেশের হিতে জীবন উৎসর্গ করবে বলে মনস্থ করে। এই সময় নায়কের বাড়ি থেকে তার অভিভাবকরা, সুরবালার সঙ্গে নায়কের বিবাহের স্থির করলে, নায়ক বিবাহে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। ফলে সুরবালার বিবাহ হয়ে যায় রামলোচন রায় নামে এক সরকারি উকিলের সঙ্গে।
কিছুদিন পরে নায়কের পিতার মৃত্যু হলে তাকে পড়াশোনা ও স্বদেশ ব্রত ত্যাগ করে নোয়াখালি বিভাগের একটি ছোট শহরের এনট্রেন্স স্কুলে সেকেণ্ড মাস্টারির কাজ নিতে হয়। এখানে এসে রামলোচনের স্ত্রী হিসেবে সুরবালার অস্তিত্ব কল্পনা করে, নায়ক ব্যথিত চিত্তে স্মরণ করে যে সে ইচ্ছা করলেই এই সুরবালার সর্বস্ব হতে পারত, কিন্তু আজ সে নিজের ভুলেই সুরবালার পরপুরুষে পরিণত হয়েছে। এই প্রেক্ষিতেই নায়ক ওই মন্তব্য করেছে।
“কিছুতেই মনস্থির করিয়া উঠিতে পারিলাম না”—কোন্ বিষয়ে নায়ক মনস্থির করতে পারেনি? নায়কের মনস্থির করতে না পারার কারণ কী?
দুর্যোগের রাত্রে সুরবালাকে নিজের কাছে স্কুল বাড়িতে ডেকে আনবে কি না, সে বিষয়ে নায়ক মনস্থির করতে পারে নি।
নায়কের মনস্থির করতে না পারার প্রধান কারণ সামাজিক অনুশাসন। সুরবালা এক সময় নায়কের বাল্যসঙ্গী ছিল। সে সময় নায়ক তার সঙ্গে একত্রে বৌ-বৌ খেলেছে, পাঠশালায় গেছে। কিন্তু এখন নায়ক যেমন যুবক হয়েছে সুরবালাও তেমনি পরস্ত্রী সরকারী উকিল রামলোচন রায়ের সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছিল। বিবাহের পর, নায়ক একদা বাল্যসঙ্গী হলেও, পরপুরুষে পরিণত হওয়ার ফলে সামাজিক অনুশাসনে তার সঙ্গে সুরবালার দেখাসাক্ষাৎ, বাক্যালাপ একপ্রকার নিষিদ্ধ বিশেষ করে নায়ক যখন রামলোচনবাবুর কাছে সুরবালার সঙ্গে তার আবালা পরিচিতির কথা গোপন রেখেছিল। এমত অবস্থায় দুর্যোগের দিনে, নায়ক যখন জানে রামলোচনবাবু একটা বড়ো মোকদ্দমায় অন্যত্র গেছেন এবং সুরবালা সেই রাত্রে বাড়িতে একা রয়েছে সেই অবস্থায় নায়ক সুরবালার নিরাপত্তার কথা ভেবে তাকে নিজের কাছে স্কুল বাড়িতে ডেকে আনবে, না কি সমাজের অনুশাসনে সে চিন্তা থেকে বিরত থাকবে তারই মনস্থির করতে পারছিল না। কেননা সুরবালাকে এই নির্জনে ডেকে আনলে সামাজিক সংস্কারবশতঃ সুরবালার পতিতা হবার আশংকা। এই কালিমামণ্ডিত ভাবনার ফলেই নায়ক কোনোরূপ মনস্থির করতে পারছিল না।
Leave a comment