“সংসারটা হয়ে গেল ছেঁড়া কানির মত। এদিকে সিয়াই, ওদিকে ছেঁড়ে। সব জুড়ে কোনদিন জুড়তে পারব না।”—উক্তিটি কার? উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
এই উক্তিটি বিরসার মা করুমির।
করমি দারিদ্র্যের দুঃখকে জানে। সব মুণ্ডার জীবনেই অসহ্য দারিদ্র্য। ভাতের স্বপ্ন একটা বড় স্বপ্ন। তারা ঘাটো খায়। লবণ দিয়ে ঘাটো খেতে পায় না তারা। এতই তাদের আর্থিক কষ্ট যে ভাত তাদের স্বপ্নের অতীত। সংসারটা ছেঁড়া ন্যাকড়ার মত হয়ে গেল। ছেঁড়া ন্যাকড়া যেমন সেলাই করে শেষ করা যায় না, এদিক সেলাই পড়ে ত ওদিক ছেঁড়ে। শতচ্ছিন্ন ছেঁড়া কাপড় কিছুতেই ঠিক করা যায় না। তাই মুণ্ডাদের দারিদ্র্য কিছুতেই ঘোচে না। ‘দিকুরা’ মুণ্ডাদের সব জমি দখল করে নেয়, তাতে মুণ্ডারা নিঃস্ব হয়ে পড়ে। তারা ‘বেঠবেগারী’ করে। তারা দিকু’দের কাছে ‘সেবকপাট্টা’ লেখে। তারা দিকুদের সেবা করে, দিকুদের হয়ে তারা কর দেয়। জেলে বসে ধানী এই খবর দিয়েছে। দিকু যা চায় সব দেবে মুণ্ডা। তা না হলে জোর করে টাকা ধার করাবে মুণ্ডাকে। নইলে উচ্ছেদ করে দেবে। আড়কাঠিরা এসে বোকা মুণ্ডাদের কুলি করে নিয়ে যাবে। সুগানা মুণ্ডা ছোটনাগপুরের প্রতিষ্ঠাতার বংশধর। তবু ভিখিরিটার মত ঘুরছিল। আকালের দিনে মুণ্ডাদের মোযগুলো সবুজ ঘাস খোঁজে। সেই সুগানা মুণ্ডার স্ত্রী করুমি। করুমির উক্তিতে তাই শতচ্ছিন্ন দারিদ্র্যের বর্ণনা যা মুণ্ডা জীবনের নিয়তি। যুগযুগ সঞ্চিত এই অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্যই উলগুলান, উলগুলান ‘দিকু’-দের বিরুদ্ধে। ‘উলগুলান’ মহাজনদের বিরুদ্ধে। কালান্তক দারিদ্র্যের গ্রামে এই হতমান, দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষরা যান নিঃশেষ হবার পথে, তখনই তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠল।
“কিন্তু এখন ছেলের চোখের দিকে চেয়ে সুগানা বুঝল আরেক রকম পৃথিবী আছে, যে পৃথিবীর সীমানা নেই, সেই বিশাল, অজানা পৃথিবীর ডাক ছেলে শুনেছে।”—উক্তিটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
সুগানার অনুভূতিতে বীরসাকে পরিবর্তিত রূপে দেখা গেল। কুণ্ডী বরতোলিতে পৌঁছে বীরসার সঙ্গে সুগানার কথা হয়, আলাপ হয়। কিন্তু সুগানা বোঝে যে বীরসা অন্য ধাতুতে গড়া। বীরসা উদ্যমী। সে চায় শিক্ষার আলো। ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে সে বলেছে যে তার ইচ্ছা ‘লিখাই পড়াই’ করি। বীরসা বুঝেছিল ভাগ্য ওকে বাইরের জগতে টানছে। মিশনের জীবনে এসে বীরসার জীবনের ধারা পাল্টে গেল। মিশনের পরিচ্ছন্ন, নিয়ম বাঁধা জগৎ বীরসার কাছে নতুন। বীরসা লেখাপড়ার জগতের মধ্যে এক অন্য জগতের স্বাদ পায়। গ্রন্থের এক একটা শব্দ পড়তে পারা, বুঝতে পারার মধ্য দিয়ে সে এক একটা বৃহৎ জগৎ আবিষ্কার করে। জ্ঞানের আনন্দ আর উচ্ছ্বাস তার রক্তে রক্তে দোলা দেয়। ইংরেজী পড়ে বীরসা কেঁদে ফেলে। বীরসার কাছে এ-এক বিরাট জয়। বীরসার ভাগ্য ছিল অন্য জীবনে বাঁধা। যে কোন শক্তিমান পুরুষের মতই নিয়তির নির্দেশকে বীরসা অমোঘ বলে মনে করে না। বীরসা আত্মশক্তিতে বিশ্বাস করে। বীরসা বাবাকে বলে যে সে চাইবাসা যাবে, আরো পড়বে। জয়পাল নাগের পাঠশালা বা বুরজুর মিশন স্কুলে যেখানেই হোক, পাঠ নিলে মনে হয় পৃথিবীটা অনেক বড়। করমি-সুগানার ‘অরান্দির’ সময়ে তাদের পৃথিবী ছিল সীমা বাঁধা। সে পৃথিবীতে নিত্য দুঃখ, নিত্য দারিদ্র্য ও দুবেলা ঘাটো, বছরে চারখানা পরা কাপড়, শীতে তুষের বস্তার ওম, বনের শেকড় আর মধু, বনের হরিণ, খরগোশ, পাখির মাংস, এসব পেলেই রাজকীয় আনন্দ তারা পেত। কিন্তু বীরসা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে নতুন পৃথিবীর বিরাট পৃথিবীর ডাক শুনেছে। এ কথা সুগানা বুঝেছে। সে বুঝেছে যে সীমাবদ্ধ পৃথিবী তার নয়। তার পৃথিবী অনেক, অনেক বড়। সুগানা এই পৃথিবীকে বোঝে না। কিন্তু বীরসাকে দেখে বুঝতে পারে সে এই পৃথিবী থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে।
‘অরণ্যের অধিকার কৃভারতের আদি অধিকার।’— ব্যাখ্যা করো।
অরণ্য মুণ্ডাদের জননী। অরণ্যের অধিকার তাদের প্রথম অধিকার। মুণ্ডাদের ইতিহাস পাঠে জানা যায় যে প্রাচীন যুগ থেকে তারা অরণ্যকে নিজের করে পেয়েছিল। কিন্তু ‘দিকু’রা এসে তাদের উচ্ছেদ করেছে। আদিবাসীরা চির-অবহেলিত, চির-নিগৃহীত সম্প্রদায়। বিদেশী শাসক, দিকু, মহাজন, জায়গীরদার আর জমিদাররা তাদের বৈধ অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের উচ্ছেদ করতে চায়। ফলে এই দরিদ্র্য, দুঃখী মানুষেরা হৃতসর্বস্ব হয়ে পড়ে। দারিদ্র তাদের ঠেলে নিয়ে যায় ‘দিকু’দের ‘বেঠবেগারি’তে। তারা তখন জমি হারিয়ে ভিখারীর মত ঘুরে বেড়ায়। অথচ আদিবাসী সমাজ অর্থাৎ অনার্য সম্প্রদায়ের উত্তরাধিকারী বলে জমিতে তাদের অধিকার ন্যায্য ও সহজাত। মুণ্ডারা আদিকালে ছোটনাগপুর-সিংভূম-পালামৌর জঙ্গল হাসিল করে। ছোটনাগপুর রাঁচি পালামৌ এলাকার বিস্তীর্ণ ভূমিই আদিবাসী অধ্যুষিত কৃষ্ণভারত। এখানে মুণ্ডা-কোল-হো-সাঁওতাল প্রভৃতি কৃষ্ণভারতের বাসিন্দা। এরা জমি আবাদ করে, বসতি পত্তন করে। এর পর তারা খুটকাটি গ্রাম পত্তন করেছিল। জমি চাষ, পশুপালন করে তাদের জীবনযাত্রা চলে যেত। “কিন্তু রাজা হল অন্যে।” মহাজন-ভূস্বামী এসে, দিকুরা এসে তাদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিল। দিকুতে দিকুতে দেশ ছেয়ে গেল। এক অসম শ্রেণি ব্যবস্থার জন্ম হল। কৃষ্ণভারতের আদি অধিকার যাদের তারাই হয়ে গেল ভিখিরি। আর ‘দিকু’রা সম্পন্ন অর্থনৈতিক অবস্থার আস্বাদ পেল। মুণ্ডারা জনমজুরি খেটে, মালিগিরি করে, ভিক্ষা করে কোন রকমে বেঁচে রইল। অন্যের জমিতে গাই চরানোর জন্য ওদের জরিমানা হল। জঙ্গল থেকে পাতা কাঠ কুড়িয়ে আনত, জঙ্গলে ঢুকে কুল, বেল, আমলকী, কচু-কন্দ শাক-বরা-সজারু যা পেত, তাই এনে বাড়ীর সকলকে খাওয়াত। আদি অধিকার ছেড়ে ওরা শেষ পর্যন্ত দুর্দিনের মধ্যে পড়ে গেল। এই অসহনীয় অবস্থার বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ওরা বিদ্রোহ করল। এই বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত দাঁড়াল ‘উলগুলানে’।
“এত মানুষ পূজে যারে, তার ডর বড়। মানুষ বড় ভুলে যায় বীরসা, আজ মাথায় তুলে, কাল মাটিতে ছেঁচড়ায়।”—কথাটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
বীরসা ‘ধীরে ধীরে জননায়ক থেকে ভগবান হয়ে গেছে। বীরসা হতমান, হতসর্বস্ব দরিদ্র জাতির ভগবান। তাদের মুক্তি দাতা, তাদের ত্রাতা। সাধারণ মানুষের কাছে বীরসার উপস্থিতি কেবল নেতার নয়। সকলে ঘর ছেড়ে, সংসার ছেড়ে চলে এসেছে বীরসার ডাকে। তারা হয়ে উঠেছে বীরসাইত। যেদিন সভায় দাঁড়িয়ে সে ঘোষণা করেছে ‘উলগুলান’, সেদিন সহস্র কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে এই পঞ্চাক্ষর। হাটে-বাটে সকলের মুখে মুখে এই মন্ত্র ছড়িয়ে পড়েছে। বীরসা যদি নেতা হত, তাহলে এই ব্যাপারটা হয়ত ঘটত না। বীরসা ভগবান। কিন্তু মা-বাবার মনে সদা শঙ্কা, সদা দ্বিধা। মা-বাবা কেবল ভাবে বীরসা সাধারণ ছেলের মত হলেই ভাল হত। বা এত বিরাট না হত, তাহলে মা-বাবার এত চিন্তা থাকত না। করমি জানত যে ওর ছেলেকে ওর কোলে ধরবে না। তাই করমি ছেলেকে বলে যে তাকে দেখে বড় ভয়। কারণ ভগবান হওয়ার পথে বিপদ অনেক। মানুষই মানুষকে তার অলৌকিক গুণাবলীর জন্য ভগবানে পরিণত করে, আবার মোহভঙ্গ হলে ভগবানকে মাটিতে টেনে দেয়। সাধারণ মানুষের রুচি ও সংস্কার বড় সাময়িক। তাদের প্রীতি ও শ্রদ্ধা বড় চঞ্চল। তাই আজ যার জন্য তাদের সাধুবাদের শেষ নেই, কাল তাকেই তারা নিন্দায়, গঞ্জনায় চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেবে। জন মানসের এই ট্র্যাজেডি সুগানা করমি জানে। বীরসা আজকের ‘ধরতি আবা’, কিন্তু কাল তাকে যদি মাটিতে আছড়িয়ে ফেলে তাহলে কি হবে। মায়ের মনে এই দুশ্চিন্তা স্বভাবত জাগে, কারণ স্নেহ সদাসশঙ্ক।
Leave a comment