‘অতিথি’ গল্পের লেখক রবীন্দ্রনাথ নিজেই জানতেন যে গল্পের নায়ক তারাপদ বাস্তবানুগ গ্রহণযোগ্য চরিত্র নয়, কারণ ছিন্নপত্রে সংকলিত একটি পত্রে তিনি লিখেছেন যে একটি আষাঢ়ে গল্প লিখতে তিনি উদ্যোগী হয়েছেন। কিন্তু রচনাকালে তিনি বিভিন্ন বাস্তব ঘটনার পরিবেশে তারাপদকে স্থাপন করে তাকে একটি বিশ্বাসযোগ্য চরিত্রে রূপায়িত করেছেন যদিচ প্রকৃতির সৌন্দর্যে নিমগ্ন বালকটির বাস্তব বন্ধনের প্রতি উদাসীনতা তাকে এক বিশ্বজনীন বৈশিষ্ট্যে ভূষিত করেছে।
তারাপদ সংগীতে একান্ত মুগ্ধ ছিল, কিন্তু সংগীত ছাড়াও তার মুগ্ধতার অন্যক্ষেত্রও ছিল। গল্পকার তার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, “কেবল সংগীত কেন, গাছের ঘন পল্লবের উপর যখন শ্রাবণের বৃষ্টিধারা পড়িত, আকাশে মেঘ ডাকিত, অরণ্যের ভিতর মাতৃহীন দৈত্যশিশুর ন্যায় বাতাস ক্রদন করিতে থাকিত, তখন তাহার চিত্ত যেন উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিত। নিস্তব্ধ দ্বিপ্রহরে বহুদূর আকাশ হইতে চিলের ডাক, বর্ষার সন্ধ্যায় ভেকের কলরব, গভীর রাত্রে শৃগালের চীৎকারধ্বনি সকলই তাহাকে উতলা করিত।”
তারাপদ নানা দলের সঙ্গে ঘুরে কবিগান, পাঁচালি গান, বাঁশিবাজান প্রভৃতি অনেক বিদ্যা আয়ত্ত করেছিল। বিভিন্ন দলে মিশলেও সে নিজের স্বাভাবিক কল্পনাপ্রবণ প্রকৃতিপ্রভাবে কোনো দলেরই বিশেষত্ব পায়নি। অন্তরের মধ্যে সে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত ও মুক্ত ছিল। সংসারে অনেক কুৎসিত কথা তাকে শুনতে হয়েছে বা কদর্য দৃশ্য তাকে দেখতে হয়েছে, কিন্তু তার কোন ছাপ তার মনের উপর দাগ কাটেনি। সে যেন এই সংসারের পঙ্কিল জলের উপর দিয়ে শুভ্রপক্ষ রাজহংসের মত সাঁতার দিয়ে বেড়াত।
প্রকৃতিপ্রিয় উদাসীনচিত্তের এই কিশোরটি মানুষের সঙ্গে মেলামেশায় কোনো অন্তরাল রাখত না। সহজ -সরলতায় সে সকলকেই আপন করে নিত। মতিবাবুর নৌকায় আশ্রয় নিয়ে সে নৌকার দাঁড়িমাঝিদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল। মাল্লাদের হাত থেকে লগি নিয়ে কখনও নিজেই ঠেলতে শুরু করে দিল, কখনও বা মাঝিকে অবসর দিয়ে সে নিজেই হাল ধরল—যখন যেদিকে পাল ফেরান আবশ্যক সমস্ত সে দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করে দিল। তার দৃষ্টি, তার হাত, তার মন সর্বদাই সচল হয়ে আছে ; এই জন্য সে নিত্যসচলা প্রকৃতির মতো সর্বদাই নিশ্চিন্ত উদাসীন, অথচ সর্বদাই ক্রিয়াসক্ত। কুশ-লবের পাঁচালি গান করে সে মতিবাবু, তার স্ত্রী অন্নপূর্ণা ও মাঝিমাল্লাদের মুগ্ধ করে দিল।
কাঁঠালিয়া গ্রামে পৌঁছে নৌকা থেকে নেমে তারাপদ একবার সমস্ত গ্রাম ঘুরে এল। কাউকে দাদা, কাউকে খুড়ো, কাউকে দিদি, কাউকে মাসি বলে ডেকে দু তিন ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত গ্রামের সঙ্গে সৌহার্দ্যবন্ধন স্থাপন করে নিল। কোথাও তার বন্ধন ছিল না বলেই এই বালক আশ্চর্য তৎপরতায় ও সহজে সকলের সঙ্গে পরিচয় করে নিতে পারত। তারাপদ দেখতে দেখতে অল্পদিনের মধ্যেই গ্রামের সমস্ত হৃদয় অধিকার করে নিল।
এত সহজে মানুষের হৃদয় হরণ করবার কারণ এই যে তারাপদ সকলের সঙ্গেই তাদের নিজেদের মতো হয়ে স্বভাবতই যোগ দিতে পারত। সকলের সকল কাজেই সে চিরকালের সহযোগীর মতো অভ্যস্তভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারত। ময়রার দোকানে গল্প করতে করতে ময়রা বলে, “দাদাঠাকুর, একটু বোসো তো ভাই, আমি আসছি”—তারাপদ অম্লান বদনে দোকানে বসিয়া একখানা শালপাতা লইয়া সন্দেশের মাছি তাড়াইতে প্রবৃত্ত হয়। সে ভিয়ান করতে পারে, তাঁতের রহস্যও তার কিছু জানা আছে, কুমারের চক্রচালনও তার একেবারে অজানা নয়।
তারাপদ সমস্ত গ্রামটি আয়ত্ত করে নিল কিন্তু একটি বালিকার ঈর্যা সে জয় করতে পারল না। গ্রামের সোনামণি নামের মেয়েটির সঙ্গে তার পরিচয় আছে জানায় সেই বালিকার ঈর্ষা যেন আরও জ্বলে উঠল। এই বালিকা চারুশশী তারাপদর পক্ষে পরম কৌতূহলের বিষয় হয়ে উঠল। আর একটি কৌতূহলের বিষয় ছিল জমিদার বাড়ির লাইব্রেরির ইংরেজিছবির বইগুলি। মতিবাবু তাকে ইংরাজি শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিলেন। এই নূতন ভাষাচর্চায় তার সামনে জ্ঞানজগতের এক নূতন দিগন্ত উন্মোচিত হয়ে গেল। এই দুটি আকর্ষণেই তারাপদ দু’বছর কাঁঠালিয়া গ্রামে থেকে গেল। চারুশশীর সঙ্গে তার সংঘর্ষ ও তার প্রতি আকর্ষণ তারাপদকে এক নূতন অনুভূতির স্বাদ দিল।
মতিবাবু ও তাঁর পত্নী চারুশশীর সঙ্গে তাঁরাপদর বিবাহ স্থির করে সব আয়োজন করলেন। নববর্ষার আবির্ভাবে এই সময় প্রকৃতি এক নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে উঠল। দেখতে দেখতে পূর্বদিগন্ত থেকে ঘনমেঘরাশি প্রকাণ্ড কালো পাল তুলে দিয়ে আকাশের মাঝখানে উঠে পড়ল, চাঁদ আচ্ছন্ন হল—পুরে বাতাস বেগে বইতে লাগল, মেঘের পিছনে মেঘ ছুটে চলল, নদীর জল খলখল হাস্যে স্ফীত হয়ে উঠতে লাগল—নদীতীরবর্তী আন্দোলিত বনশ্রেণীর মধ্যে অন্ধকার পুঞ্জীভূত হয়ে উঠল, ডেক ডাকতে আরম্ভ করল, ঝিল্পিধ্বনি যেন করাত দিয়ে অন্ধকারকে চিরতে লাগল।
পরদিন তারাপদর মা ও ভাইয়েরা কাঁঠালিয়ায় এসে উপস্থিত হলেন, কলকাতা থেকে বিয়ের সকল উপচার নিয়ে তিনখানি বড় নৌকা এসে পৌঁছল। কিন্তু পরদিন তারাপদকে দেখা গেল না। স্নেহ-প্রেম-বন্ধুত্বের ষড়যন্ত্রবন্ধন তাকে চারিদিক থেকে সম্পূর্ণরূপে ঘিরে ফেলবার আগেই সমস্ত গ্রামের হৃদয়খানি চুরি করে বর্ষার মেঘান্ধকার রাত্রে এই বালক আসক্তিবিহীন উদাসীন জননী বিশ্বপৃথিবীর কাছে চলে গেছে।
পদ্মায় বোটে বাসকালে রবীন্দ্রনাথ খুব কাছ থেকে গ্রামীণ জীবন ও মানুষের পরিচয় পেয়েছিলেন। তারই নিদর্শন পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের প্রথম যুগের ছোটগল্পগুলিতে। এ কথা অনস্বীকার্য যে পল্লীর জনজীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত হওয়া সম্ভব ছিল না। পল্লীর জীবনধারা তিনি বাইরে থেকে দেখেছেন এবং কল্পনা করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প সম্পর্কে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয় যখন তিনি বলেন, “রবীন্দ্রনাথের ঔৎসুক্য প্রধানত চরিত্রসৃষ্টিতে ও জীবনপর্যবেক্ষণে নহে, জীবনের মধুর কাব্যময় পরিবেশে চারিত্রিক লীলার স্ফূর্তি ও বিকাশে। তত্ত্বের দ্রবীভূত রস ও সৌন্দর্যরূপেই তাঁহার প্রধান আকর্ষণ। অনেক সময়ে গল্পের ছোটখাপে সাংকেতিকতার তরবারি দীপ্তিভাস্বর হইয়া উঠিয়াছে।” ‘অতিথি’ গল্পের তারাপদ মানবমনের অসীমের আকাঙ্ক্ষার সংকেতরূপে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। কাহিনীর ঘটনার প্রবাহের সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটেছে এক সাংকেতিক সৌন্দর্য। এখানেই ‘অতিথি’ গল্পটির সার্থকতা।
Leave a comment