দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে ক্যারিবিয়ান সাগরে অবস্থিত পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে সর্ববৃহৎ দ্বীপ কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি নির্মাণকে কেন্দ্র করে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক স্বল্পকালীন দ্বন্দ্ব শুরু হয় যার নাম কিউবার ক্ষেপনাস্ত্র সংকট।

[1] পটভূমি: কিউবা ১৮৯৮ খ্রি. স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার পর উন্নতির লক্ষ্যে মার্কিন মুখাপেক্ষী হয়ে পড়ে। এই সুযােগ নিয়ে মার্কিন পুঁজিপতিরা কিউবার অর্থনীতির মূলভিত্তি আখের খেতের ৪০ ভাগ দখল করে নেয়। কিউবার ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমেরিকা তার অনুগামী ফ্যালজেনিকো বাতিস্তাকে ১৯৫৪ খ্রি. রাষ্ট্রপতি পদে বসায়। কিন্তু তিনি মার্কিন পুঁজিবাদের তাঁবেদারে পরিণত হওয়ায় কিউবাবাসী বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়।

[2] ফিদেল কাস্ত্রোর ভূমিকা: বাতিস্তা সরকারের জনবিরােধী কাজকর্মের প্রতিবাদে কিউবার তৎকালীন ছাত্রনেতা ফিদেল কাস্ত্রো তীব্র সরকারবিরােধী আন্দোলন গড়ে তােলেন। ক্রমশ জনসমর্থন আদায় করে এক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের দ্বারা বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটিয়ে। কাস্ত্রো কিউবার ক্ষমতা দখল করেন (১৯৫৯ খ্রি., ১ জানুয়ারি)। কিউবার রাষ্ট্রপতি কাস্ত্রো এরপর পুঁজিবাদী আমেরিকার দিক থেকে সরে এসে রাশিয়া, চিন ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তােলার উদ্যোগ নেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি কিউবায় মার্কিন পুঁজিপতিদের চিনি কলগুলি জাতীয়করণ করেন। তার পাশাপাশি মার্কিন পুঁজিপতি গােষ্ঠীর পরিচালনাধীন ব্যাংক ও অন্যান্য শিল্পকেন্দ্রগুলিও জাতীয়করণ করেন।

[3] কাস্ত্রো অপসারণে আমেরিকার ভূমিকা: আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কাস্ত্রোর এরকম কার্যকলাপে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে নানাভাবে কাস্ত্রো সরকারের পতনের পরিকল্পনা নেয়। মার্কিন গােয়েন্দা বিভাগের (CIA) গােপন সহায়তায় ১,৪০০ ভাড়াটে সৈন্য মার্কিন জাহাজে করে কিউবার ফ্লোরিডা উপকূলের কাছে পিগ উপসাগরে পৌছােয়। বিদ্রোহীদের সহায়তার জন্য মার্কিন বি-২৬ বিমান প্রস্তুত ছিল। কিন্তু কিউবার সেনাদল তাদের চূড়ান্তভাবে পরাজিত করলে মার্কিন চক্রান্ত ব্যর্থ হয়।

[4] কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি গঠন: কাস্ত্রো সরকার ৫০ লক্ষ কিউবাবাসীকে রক্ষার জন্য রাশিয়ার সাহায্যে কিউবাতে একটি ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকে কিউবার রাষ্ট্রপতি ফিদেল কাস্ত্রো রাশিয়া থেকে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র (IRBM অর্থাৎ Intermediate Range Ballistic Missiles) গােপনে আমদানি করে কিউবাতে প্রতিস্থাপন করেছিলেন।

[1] যুদ্ধােদ্যোগ হ্রাসে: এই সংকটের ফলেই শেষপর্যন্ত মস্কো ও ওয়াশিংটনের তরফে যুদ্ধাদ্যোগ হ্রাস পেতে থাকে।

[2] মানবতার জয়ে: কিউবা সংকটকে কেন্দ্র করেই রুশ-মার্কিন উভয় পক্ষই আণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতা উপলদ্ধি করতে সক্ষম হয়। ফলে হিংসার বিরুদ্ধে সংযম, শুভবুদ্ধি ও মানবতাবাদ শেষপর্যন্ত জয়যুক্ত হয়। ধ্বংসের হাত থেকে পৃথিবী রক্ষা পায়।

[3] পারস্পরিক আলােচনায়: উভয়শক্তিই এরপর থেকে পারস্পরিক আলােচনার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানের পথ গ্রহণ করে। উভয়ের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে।

[4] পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা নিরােধ চুক্তিতে: এই সংকটের এক গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি হল পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা নিরােধ চুক্তি স্বাক্ষর। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে সােভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা ও ফ্রান্সের মধ্যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়।

[5] হটলাইন স্থাপনে: এই সংকটের পরবর্তী সময় থেকে যে কোনাে সংকটের সরাসরি সমাধানের জন্য হােয়াইট হাউস ও ক্রেমলিনের মধ্যে হটলাইন-এর মাধ্যমে টেলিযােগাযােগ স্থাপিত হয়।

[6] কিউবায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়: ভৌগােলিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের এত কাছাকাছি একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উল্লেখ্য, কিউবাই হল পশ্চিম গােলার্ধের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

অবশেষে (২০ নভেম্বর, ১৯৬২ খ্রি.) সােভিয়েত রাশিয়া কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি সরিয়ে নিলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কিউবার বিরুদ্ধে নৌ অবরােধ তুলে নেয়। এইভাবে দুই মহাশক্তিশালী রাষ্ট্রের শুভবুদ্ধির প্রভাবে বিশ্ব একটি সর্বনাশা মহাযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পায়।

[1] আমেরিকার প্রতিক্রিয়া: ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে আমেরিকা তার গুপ্তচর বিমানের তােলা ছবি থেকে জানতে পারে যে, কিউবায় সােভিয়েত ইউনিয়ন একটি ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি তৈরি করেছে। কিউবা আমেরিকার দক্ষিণসীমা ফ্লোরিডা থেকে মাত্র ১৫০ কিলােমিটার দূরে অবস্থিত। কাজেই এখান থেকে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্র সহ সমস্ত পশ্চিম গােলার্ধের নিরাপত্তাই ব্যাহত করতে পারে। কিউবায় রাশিয়ার এই প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিটি তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে অস্থির করে তােলে।

[2] কিউবা অবরােধ: কালবিলম্ব না করে বিচলিত কেনেডি কিউবায় আর কোনাে ক্ষেপণাস্ত্র যাতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য তার চতুর্দিকে নৌ-অবরােধের আদেশ দেন। সেই সঙ্গে ২২ অক্টোবর (১৯৬২ খ্রি.) এক বেতার ঘােষণা মারফত বিশ্ববাসীকে এই ব্যবস্থার কথা জানিয়েও দেন। তিনি আরও ঘােষণা করেন যে, কিউবাগামী সমস্ত জাহাজ, এমনকি সােভিয়েত জাহাজও যথাযথ অনুসন্ধানের পরই কিউবায় ঢােকার অনুমতি পাবে।

[3] রাশিয়ার প্রত্যুত্তর: কিউবায় অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত মার্কিন রাষ্ট্রপতি কেনেডির ঘােষণায় রাশিয়ায় মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সােভিয়েত সরকার তার সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়। সেনাবিভাগের কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয় এবং সবাইকে কাজে যােগ দিতে বলা হয়। এমনকি আসন্ন বিদায়ী কর্মচারীদের অবসরগ্রহণ সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়। সেইসঙ্গে রাশিয়া দৃপ্তকণ্ঠে জানিয়ে দেয় যে, কিউবাগামী কোনাে সােভিয়েত জাহাজ পথিমধ্যে বাধাপ্রাপ্ত হলে যেন সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালানাে হয়।

[4] রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগ: কিউবা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া তিনপক্ষই রাষ্ট্রসংঘে বিষয়টি উত্থাপন করে। রাষ্ট্রসংঘের মহাসচিব উ- থান্ট এবং বিশ্বের জোটনিরপেক্ষ বিভিন্ন রাষ্ট্র দু-পক্ষের (আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত ইউনিয়ন) কাছেই শান্তিরক্ষার অনুরােধ জানাতে থাকে। শেষপর্যন্ত ২৭ অক্টোবর (১৯৬২ খ্রি.) রুশ প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভ মার্কিন রাষ্ট্রপতি কেনেডিকে জানান যে—

  • [i] মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কিউবা আক্রমণ না করার প্রতিশ্রুতি দেয়; 

  • [ii] কিউবা থেকে যদি নৌ-অবরােধ প্রত্যাহার করা হয় এবং 

  • [iii] তুরস্ক থেকে মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি যদি অপসারণ করা হয়—তাহলে রাশিয়াও কিউবা থেকে সমস্ত সামরিক বাহিনী অপসারণ করবে।