কার্ল মার্কস-এর পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রীদের সাধারণত বলা হয় কাল্পনিক সমাজতন্ত্রী এবং এঁদের সমাজতন্ত্রবাদই কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ হিসাবে পরিচিত। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক-রহিত। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদে বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের সমালোচনা করা হয়; কিন্তু প্রতিকারের উপায়-পদ্ধতি সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলা হয় না বা অভীষ্ট সম্পর্কেও সুস্পষ্টভাবে কিছু বলা হয় না। কাল্পনিক সমাজতন্ত্র একটি আদর্শকে তুলে ধরে; কিন্তু উপনীত হওয়া সম্ভব এমন ধ্যান ধারণার কথা বলে না। মানুষ এবং প্রতিষ্ঠানসমূহের পূর্ণতাপ্রাপ্ত যথাযথ মানের ব্যাপারে এই মতবাদে আন্তরিক বিশ্বাস ও আস্থার কথা বলা হয়। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ হল সমাজতন্ত্রবাদের এক কাল্পনিক রূপ। আদর্শ সামাজিক পরিপূর্ণতার পরিপ্রেক্ষিতে কতকগুলি মতাদর্শের কথা বলা হয়। এই সমস্ত মতাদর্শের উপর কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ প্রতিষ্ঠিত। এই সমাজতন্ত্রবাদ বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানসমূহের সমালোচনায় বিশ্বাস করে এবং আদর্শ একটি সামাজিক কাঠামোর রূপরেখা তুলে ধরে। বাস্তবে এই সামাজিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব নাও হতে পারে। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রে এমন এক ব্যবস্থার প্রতিকল্প প্রতিপন্ন করা হয়, যেখানে আদর্শ পরিপূর্ণতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ইউটোপিয়া’র শব্দগত অর্থ বলতে একটি কাল্পনিক দ্বীপের কথা বলা হয়। এই দ্বীপের বর্ণনা পাওয়া যায় ১৫১৬ সালে প্রকাশিত স্যার টমাস মোর (Sir Thomas More)-এর লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ Utopia-তে।

কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীরা সমাজের একটি আদর্শ চিত্র চিত্রিত করেছেন এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরোধিতা করেছেন। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীদের মতাদর্শ সমাজের অন্যায়-অবিচার ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির সমালোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাঁরা যে আদর্শ ব্যবস্থার চিত্রকল্প তুলে ধরেন, সেই লক্ষ্যে উপনীত হওয়া সম্ভব কিনা সে বিষয়ে তাঁরা কিছুমাত্র ভাবেন না। তাঁদের চিত্রকল্পের আদর্শ সমাজব্যবস্থা কি উপায়-পদ্ধতিতে বাস্তবে রূপায়িত হবে সে বিষয়ে তাঁরা নীরব। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদের প্রবক্তারা বিশ্বাস করতেন যে, বুদ্ধিমান ব্যক্তিবর্গ সহজেই তাঁদের মতাদর্শকে অনুধাবন করতে পারবেন। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীরা মূলত যুক্তি-পরামর্শ ও উদাহরণ প্রদানের উপর জোর দিয়েছেন। এ বিষয়ে ওয়েপার তাঁর Political Thought শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “They conjured up visions of beautiful roses, but preparing no soil for the rose trees, left them to feed freely on beeauty.”

কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীরা লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার উপায় হিসাবে বিপ্লবের পথকে বাতিল করে দিয়েছেন। তাঁরা মানুষের সদাশয়তা ও বদান্যতার প্রতি আবেদন জানানোর উপর জোর দিয়েছেন। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদে সহযোগিতার নীতি প্রচার করা হয়েছে এবং আদর্শ জনসম্প্রদায়ের ব্যাপারে কর্মপরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। কার্ল মার্কসের আগে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীরা বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা প্রচার করেছেন। এঁধো (Proudhon) সম্পত্তিকে চৌর্য্য (Property is theft) বলে মন্তব্য করেছন। সাঁ সিম শ্রেণীযুদ্ধের ধারণা প্রচার করেছেন। ফুরিয়ার মধ্যবিত্ত শ্রেণীসমূহকে বাণিজ্যিক স্বৈরাচারী হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। ওয়েন বলেছেন নতুন কলকারখানার যুগে প্রতিযোগিতার পরিবর্তে সহযোগিতার পরিবেশ-পরিমণ্ডলের সৃষ্টি হবে।

প্লেটোর রিপাবলিক: সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, সমাজতন্ত্রবাদ হল একটি আধুনিক ব্যবস্থা। শিল্পায়নের বিকাশ ও বিস্তারের পরিণামে অন্যায়-অবিচার ও শোষণ-বঞ্চনার সৃষ্টি হয়েছে। এ সবের মোকাবিলা করার জন্য সৃষ্টি হয়েছে সমাজতন্ত্রের। প্রকৃত প্রস্তাবে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা আজকের নয়, অনেক দিনের। প্রাচীন ধর্মীয় পুঁথিপত্রের মধ্যে সামাজিক ন্যায়বিচার সম্পর্কিত বিবিধ আদর্শবাদী বক্তব্য বর্তমান। এই সমস্ত বিষয়াদির মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার পরিচয় পাওয়া যায়। গ্রীক্ পণ্ডিত প্লেটোর Republic শীর্ষক বিখ্যাত গ্রন্থে সমাজতান্ত্রিক বক্তব্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এই গ্রন্থে প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের অভিভাবকদের জন্য সাম্যবাদী জীবনধারা নির্বাহের পরামর্শ দিয়েছেন। প্লেটোর Republic, Utopia-র উদাহরণ হিসাবে সুপরিচিত। কিন্তু এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। প্লেটো সম্পত্তির সাধারণ মালিকানার ব্যবস্থার কথা বলেছেন এবং পত্নীদের সাধারণ মালিকানার ব্যবস্থার কথা বলেছেন। কিন্তু এই ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে কেবলমাত্র ‘অভিভাবকশ্রেণী’ (Guardian Class)-র জন্য। সার্বজনীন নীতি হিসাবে এই ব্যবস্থার কথা বলা হয়নি। সম্পত্তির সাধারণ মালিকানা সম্পর্কিত প্লেটোর পরিকল্পনার বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। এই উদ্দেশ্যটি হল অভিভাবক শ্রেণীকে জাগতিক বা বৈষয়িক বিষয়াদি থেকে বিচ্ছিন্ন রাখা প্রয়োজনের সম পরিতৃপ্তির জন্য প্লেটো এই ব্যবস্থার কথা বলেননি।

সমাজতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার অন্যতম প্রাচীন উৎস হিসাবে ‘Old Testament’-এর কথাও বলা হয়। টমাস ম্যুর-এর Utopia শীর্ষক গ্রন্থেও কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদী ধ্যান-ধারণা সম্পর্কিত আলোচনা আছে। এ প্রসঙ্গে বেকন (Becon)-এর New Atlantis এবং ক্যাম্পানেলা (Campaneclla)-র City of the Sun গ্রন্থগুলিও উল্লেখযোগ্য।

কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদের প্রবক্তাদের নাম

প্রকৃত প্রস্তাবে অষ্টাদশ শতাব্দীর ফ্রান্সেই কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদের বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। হ্যাল্লোওয়েল (J. H. Hallowell) তাঁর Main Currents in Modern Political Thought শীর্ষক গ্রন্থে এ বিষয়ে বলেছেন: “The real home of what has come to be called Utopian Socialism was eighteenth century France.” অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সে বেশ কিছু সমাজতান্ত্রিক রচনা প্রকাশিত হয়। এই সমস্ত লেখালেখিতে সকলের জন্য সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচারে নিশ্চয়তা সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ সমাজের এক উজ্জ্বল রঙিন চিত্র চিত্রিত করা হয়। এই কারণে এই মতাদর্শকে সাধারণভাবে ‘কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ’ (Utopian socialism) নামে আখ্যায়িত করা হয়। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের আলোচনায় কতকগুলি নাম বিশেষভাবে বিশিষ্ট। এই নামগুলি হল সাঁ সিম (Saint Simon (1760-1825 A. D.)], চার্লস ফুরিয়ে [Charles Fourier (1772-1837 A. D.)] রবার্ট ওয়েন [Robert Owen (1771-1858 A. D.)] এবং প্রুধো [Proudhon (1809-1865 A. D.)]। এ ছাড়া এ প্রসঙ্গে বেবউফ (Babeuf), ব্লাঙ্ক (Blanc), এটিয়েনে ক্যাবে (Etienne Cabet) প্রমুখ রাষ্ট্রদার্শনিকের নাম উল্লেখ করা দরকার। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সের বিপ্লবে স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের ডাক দেওয়া হয়। ১৭৯৩ সালের সংবিধানে বলা হয় প্রকৃতিগতভাবে এবং আইনানুসারে সকল মানুষই সমান। এতদ্‌সত্ত্বেও সামাজিক অন্যায়ের অবসান ঘটেনি। সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদ্রা এ বিষয়ে প্রভাবিত হয়ে পড়েন। অবশ্য কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদের প্রবক্তাদের মধ্যে মৌলিক মতপার্থক্যের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় না। প্রুধো (Proudhon) পৃথক নৈরাজ্যবাদী মতাদর্শ গড়ে তোলেন। তবে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীরা ভবিষ্যতের এক সুন্দর সমাজের রূপরেখা তুলে ধরেন। এই সমাজে রাষ্ট্র ব্যক্তি মানুষের কার্যকলাপ এবং শিল্পব্যবস্থাকে সামগ্রিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে।

কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদের কতকগুলি মূল বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা আবশ্যক। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীরা বিদ্যমান সমাজব্যবস্থা ও সমকালীন প্রতিষ্ঠানসমূহ সম্পর্কে তাঁদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

এক: কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ হল মূলত একটি আর্থনীতিক মতাদর্শ। আর্থনীতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের, বিশেষত শিল্প-কারখানা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে এই মতাদর্শের আবির্ভাব ঘটেছে। ইংরেজ চিন্তাবিদ্‌ রবার্ট ওয়েন-এর অভিমত অনুসারে বিদ্যমান কারখানা ব্যবস্থা প্রতিযোগিতার ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। এই কারণে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অসুবিধার সৃষ্টি হয়। সহযোগিতামূলক কারখানা ব্যবস্থার মাধ্যমে এই সমস্ত অসুবিধার অবসান সম্ভব।

দুই: কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীরা সমাজের বিদ্যমান আর্থনীতিক ও রাজনীতিক কাঠামোর বিরূপ সমালোচনা করেন। শ্রমিকশ্রেণীর জীবনযাত্রার মান তাঁদের ব্যথিত করেছে। এই কারণে বিদ্যমান ব্যবস্থাসমূহের ত্রুটি বিচ্যুতি থেকে মুক্ত এক নতুন সামাজিক কাঠামোর কথা বলেছেন।

তিন: কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদে আর্থনীতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরোধিতা করা হয়েছে। প্রধো ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে চৌর্য বলে বিরূপ সমালোচনা করেছেন। সাইমন ও ওয়েন দারিদ্র্যের কারণ হিসাবে বক্তিগত সম্পত্তিকে দায়ী করেছেন। গ্রের অভিমত অনুযায়ী শ্রমিকশ্রেণী যে সম্পদ সৃষ্টি করে, লোভী মালিক শ্রেণী তা আত্মসাৎ করে। এই শ্রেণীর কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীদের মতানুসারে দারিদ্র্যের মূল কারণ হল ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং সমাজের সকল সীমাবদ্ধতার জন্য দায়ী হল ব্যক্তিগত সম্পত্তি। এ বিষয়ে কোকার বলেছেন: “These men regarded poverty as the principal source of alls of society and private property as the chief cause of poverty.”

চার: বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাসমূহের অপসারণের ব্যাপারে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদের পরিকল্পনা পৃথক প্রকৃতির। এই মতাদর্শের প্রবক্তাদের অভিমত অনুসারে ভবিষ্যতের নতুন সমাজব্যবস্থা ও জনসম্প্রদায় ন্যায়বিচার নীতিবোধ এবং সততা-সরলতার উপর প্রতিষ্ঠিত হবে।

পাঁচ: কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন না। তাঁরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাসমূহের বিরোধিতা করেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাসমূহের অবসানের ব্যাপারে তাঁরা মার্কসীয় উপায়-পদ্ধতিকে সমর্থন করেন না। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধনের ব্যাপারে তাঁরা বৈপ্লবিক বা রাজনীতিক কার্যকলাপকে সমর্থন করেন না। তাঁরা ন্যায়বিচার ও কল্যাণমূলক আদর্শের ভিত্তিতে আদর্শ ও স্থায়ী জনসম্প্রদায় (Community) গড়ে তোলার কথা বলেন। এইভাবে সৃষ্টি হবে এক আদর্শ সমাজের। এই সমাজ হবে সহযোগিতামূলক। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীদের অভিমত অনুযায়ী পুঁজিবাদী অর্থনীতিক ব্যবস্থায় শ্রমিকশ্রেণীর দুরবস্থার অবসান বিবর্তনমূলক পরিবর্তন ও সামাজিক সংস্কার সাধনের মাধ্যমে সম্ভব। এক্ষেত্রে তাঁরা মানবিকতাবোধ, ন্যায়নীতিবোধ ও যুক্তিবোধের উপর গুরুত্ব আরোপের পক্ষপাতী। এ প্রসঙ্গে কোকার মন্তব্য করেছেন: “They looked for relief, however, not as the Marxists to the revolutionary or other aggressive action of oppressed groups organised to avail themselves of the benefits of a natural evolution of society, but to the deliberate and pacific efforts of men inspired by feelings of benevolence and justice.”

ছয়: কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদে বিশ্বাস করা হয় যে, সাম্য ও সম্প্রীতির পরিবেশে মানুষের বসবাস করার কথা। শোষণ-পীড়ন এবং সব ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষ প্রকৃতির নির্দেশের বিরোধী। 

সাত: কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদে এক বিশেষ ধরনের শিল্পসমাজের পরিকল্পনার কথা বলা হয়। এই শিল্পসমাজে আর্থনীতিক সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে সাম্য বর্তমান থাকবে। এ ধরনের সমাজব্যবস্থায় কেউই অপরের পরিশ্রমের ফলের উপর জীবনধারণ করতে পারবে না।

আট: বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার বৃহৎ শিল্প-শক্তিসমূহ কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের পরিকল্পনাসমূহের বাস্তবায়নের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে কিনা, এ বিষয়ে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীরা মোটেই চিন্তিত নয়। তাঁরা মোটামুটিভাবে সামাজিক বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী।

বিশিষ্ট কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদিগণ

প্রথম যুগের সমাজতন্ত্রীরাই ‘কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদী’ হিসাবে পরিচিত। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে সংঘটিত শিল্প বিপ্লব ও ফরাসী বিপ্লবের পরিমন্ডলে এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীদের উদ্ভব হয়েছে। এঁদের মধ্যে আছেন কয়েকজন ফরাসী ও ইংরেজ চিন্তাবিদ। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদী হিসাবে তিনজনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁরা হলেন: ফরাসী চিন্তাবিদ সাঁ সিমঁ ও চার্লস ফুরিয়ে এবং ইংরেজ চিন্তানায়ক রবার্ট ওয়েন। মার্কস-এঙ্গেলসের ‘কমিউনিস্ট ইস্তাহার’-এর তৃতীয় অধ্যায়ে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদী হিসাবে এই তিনজনের কথাই বলা হয়েছে। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদী হিসাবে এই তিনজনই বিশেষভাবে পরিচিত। এই তিনজন সমাজতন্ত্রী কল্পনাবিলাসী এবং মানবতাবাদী। তাঁরা ভবিষ্যৎ সমাজের নৈতিক ও সামাজিক বিষয়াদি তুলে ধরেছেন। তাঁরা চিন্তা-ভাবনা করেছেন বিভিন্ন ধরনের সামাজিক-নৈতিক বিষয়াদি নিয়ে।

উল্লিখিত তিনজন কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীদের বক্তব্য বিষয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বিশেষত ইংরেজ চিন্তাবিদ ওয়েনের সঙ্গে ফরাসী চিন্তানায়ক সাঁ সিঁম ও ফুরিয়ের ধ্যান-ধারণায় পার্থক্য বর্তমান। এই কারণে এঁদের প্রত্যেকের কাল্পনিক সমাজতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করা আবশ্যক।

সাঁ সিঁম [ Saint Simon (1760-1825AD) ]

ফরাসী দার্শনিক সাঁ সিঁম শিল্পসমাজের সমর্থনে এবং সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী শিল্পসমাজের প্রাণ হল শিল্পশ্রমিকরা। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল শিল্পকর্মীদের জন্য মুক্ত ও স্বাধীন জীবন উপভোগের সুযোগ সৃষ্টি করা। ফরাসী বিপ্লবের ধ্যান-ধারণা সাঁ সিঁমকে অনুপ্রাণিত করেছে। সমকালীন বৃহদায়তন শিল্প কারখানাগুলির অবস্থা তাঁকে শ্রমজীবীদের প্রতি অনুভূতিশীল করে তুলেছে। শ্রমজীবী জনতার কল্যাণ সাধনকেই তিনি মতাদর্শগত অন্যতম উদ্দেশ্য হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তিনি নতুন একটি সমাজব্যবস্থার রূপরেখা রচনা করেছেন। এই সমাজব্যবস্থার মুখ্য উদ্দেশ্য হবে শিল্পের প্রগতি সাধন। এই সমাজ হল শিল্পসমাজ। এই শিল্পসমাজকে নেতৃত্ব দেবে উৎপাদকশ্রেণী। উৎপাদকশ্রেণী বলতে তিনি শ্রমজীবী শ্রেণী বা মেহনতী মানুষকে বুঝিয়েছেন।

ফ্রান্সে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ‘তৃতীয় বর্গের মানুষজন’ (Third Estate) রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও আনুষঙ্গিক পুরাতন ব্যবস্থাদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। সামগ্রিক বিচারে সাঁ সিঁম এই তৃতীয় বর্গের তাত্ত্বিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই কারণে প্রাথমিকভাবে তিনি শ্রমজীবী মানুষ ও শিল্পের কর্ণধার উভয়কেই অভিন্ন গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হিসাবে দেখেছেন।

সাঁ সিঁম ১৮১৬ সালে ঘোষণা করেন যে রাজনীতি হল উৎপাদনের বিজ্ঞান। তিনি অর্থনীতির মধ্যে রাজনীতির অন্তর্ভুক্তির কথাও বলেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী রাজনীতি হল উৎপাদনকর্মের বিজ্ঞান। সুতরাং রাজনীতি ও অর্থনীতিকে অভিন্ন রূপে ভাবা দরকার। সাঁ সিমঁর মতানুসারে রাষ্ট্রের আসল কাজ হল উৎপাদন প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান। এ কথা সাঁ সিমই প্রথম অনুধাবন করেন। সাঁ সিমোঁ সম্পর্কে এঙ্গেলস মন্তব্য করেছেন: “In 1816 he declared that politics was the science of production, and foretold the complete merging of Politics into economics. We have a definite statement that the political government of men will be transformed into the administration of things and the management of the process of production.”

সাঁ সিঁম শিল্পকর্ম বলতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর বা শ্রেণীর মানুষকে বুঝিয়েছেন। এই গোষ্ঠী বা শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হলেন পুঁজিপতি, কারখানার মালিক, বণিক সম্প্রদায় এবং অবশ্যই শ্রমজীবী মানুষ। তবে সাঁ সিঁম সমকালীন সমাজের শ্রেণীবিন্যাস সম্পর্কে সম্যকভাবে সচেতন ছিলেন। তিনি তাঁর সমসাময়িক সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্বের কথা বলেছেন। এই শ্রেণীগুলি হল সামন্ত ভূস্বামী শ্রেণী, মধ্যবিত্তশ্রেণী এবং শিল্পকর্মী শ্রেণী। শিল্পকর্মী শ্রেণীর তিনি উপরিউক্ত ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

সাঁ সিঁম রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী একটি সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এই ব্যবস্থার মধ্যে তিনটি কক্ষ থাকবে। প্রতিটি কক্ষের গঠন ও কার্যাবলী হবে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। প্রথম কক্ষটিকে বলা হবে ‘উদ্ভাবনী কক্ষ (House of Invention)। ইঞ্জিনিয়ার, কবি ও শিল্পীদের নিয়ে এই কক্ষ গঠিত হবে। দ্বিতীয় কক্ষটি পরিচিত হবে ‘পরীক্ষা কক্ষ’ (House of Examination) নামে। পদার্থবিদ্যাবিশারদ ও গণিতজ্ঞদের নিয়ে এই কক্ষটি গঠিত হবে। তৃতীয় কক্ষটির নাম হবে ‘কার্যনির্বাহী কক্ষ (House of Execution)। কেবলমাত্র শিল্পের কর্ণধারদের নিয়ে এই কক্ষটি গঠিত হবে। প্রথম কক্ষ বিভিন্ন ধরনের আইন ও বিধিব্যবস্থা সুপারিশ করবে। সেই সমস্ত আইন ও বিধি প্রণয়ন করবে দ্বিতীয় কক্ষ। সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি ব্যবস্থাকে বলবৎ করবে তৃতীয় কক্ষ। সাঁ সিমোঁর অভিমত অনুযায়ী নতুন রাষ্ট্র হবে শিল্প-রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র অবশ্যই চার্চের জায়গা দখল করে নেবে এবং জনসাধারণের মধ্যে চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে। এইভাবে জনজীবনের সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিস্থিতি-পরিমন্ডলের সৃষ্টি হবে। জোহারী তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “ St. Simonargued that the new industrial state must take the place of the church as the supreme authority among men to bring harmony into their lives.”

সাঁ সিমঁ ব্যক্তিগত সম্পত্তি ব্যবস্থার অবসানের কথা বলেন নি। তাঁর অভিমত অনুযায়ী মূলধন এবং শ্রম উভয়েরই পারিশ্রমিক পাওয়ার আইনানুগ অধিকার আছে। জমি-জমার মালিকানার উপরও তিনি কোন রকম বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে সমর্থন করেননি। তবে সাঁ সিঁম ব্যক্তিগত সম্পত্তির ব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। সমালোচনার কারণ হিসাবে তিনি বলেছেন যে, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ক্ষুদ্র একটি শ্রেণীর মানুষজনকে অলস করে তোলে। তারা অপরের শ্রমের উপর জীবনধারণের প্রক্রিয়ার সামিল হয়।

সাঁ সিমঁ শ্রমের নীতি প্রচার করেছেন। শিল্পযুগে কর্তৃত্ব এবং আস্থা ও বিশ্বাসের নতুন একটি উৎসের অনুসন্ধানে সমগ্র জীবনব্যাপী সাঁ সিঁম সক্রিয় ছিলেন। তাঁর অভিমত অনুযায়ী সম্পত্তির অধিকারসমূহ সামাজিক উপযোগিতার উপর প্রতিষ্ঠিত হবে। বণ্টনের ব্যাপারে তিনি বলেছেন: ‘সামর্থ্য অনুসারে প্রত্যেকের কাছ থেকে নিতে হবে এবং শ্রম অনুসারে প্রত্যেককে দিতে হবে’ (‘From each according to his capacity, to each according to his work’)। সাঁ সিমঁর আর্থনীতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জোহারী তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “Society must be reorganised into a ‘productive association’ with an economic rather than a political form of government. Representation in the government should be in terms of economic interests and occupation and the supreme task of government should be the development of nation’s economic resources. The idlers of drones (like nobles, barons and clergy) should go for the reason that they play no part in industrial enterprise.” সাঁ সিমোঁ ভবিষ্যতের যে সমাজব্যবস্থার কথা বলেছেন সেই সমাজ ও জাতিরাষ্ট্র হবে একটি উৎপাদনশীল সংগঠন (productive association)। অনেকের মতে সাঁ সিমোঁ রাষ্ট্র ও জাতির জন্য এক সামগ্রিক সমাজিকীকরণ প্রক্রিয়া প্রয়োগ করার পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, উৎপাদনশীলতা এবং সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। সমাজবাদী প্রবণতা সাঁ সিঁমর চিন্তা ভাবনায় ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। পরিণত বয়সে তিনি শ্রমজীবী জনতার স্বার্থের কথা গুরুত্বসহকারে তুলে ধরেছেন।

সাঁ সিমোঁ কিন্তু কাল্পনিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার আলোচনার ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খল বা সুবিন্যস্তভাবে অগ্রসর হননি। কিন্তু তাঁর চিন্তাভাবনা কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদ সম্পর্কে অন্যান্যদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে। সাঁ সিমোঁ পুঁজিবাদের সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতানুসারে পুঁজিবাদ অপচয়মূলক। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় মুষ্টিমেয় মানুষ সম্পদের অধিকার লাভ করে এবং অধিকাংশ মানুষের উপর নেমে আসে দারিদ্র্যের অভিশাপ। এই অবস্থায় পরস্পরের মধ্যে অসদ্ভাব ও বিবাদ-বিসংবাদের সৃষ্টি হয়।

চার্লস ফুরিয়ে [Charles Fourier (1772-1837 AD) ]

চার্লস ফুরিয়ে সাঁ সিমোঁ ও রবার্ট ওয়েনের সমসাময়িক। ফরাসী সমাজবাদী চার্লস ফুরিয়ে সমকালীন সমাজব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করেছেন। বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে ফুরিয়ে লেখনী ধারণ করেছেন। তিনি বিচক্ষণতার সঙ্গে বুর্জোয়াদের বিবিধ সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে ব্যঙ্গাত্মক বক্তব্য পরিবেশন করেছেন। বুর্জোয়াদের যে সকল বিষয়কে তিনি সর্বাধিক আক্রমণ করেছেন, সেই বিষয়গুলি হল বেপরোয়া ফাটকাবাজী, আক্রমণাত্মক বাণিজ্যিক মানসিকতা, বিপ্লবের পরবর্তীকালে অনৈতিক জীবনধারা প্রভৃতি। ফুরিয়ের অভিমত অনুযায়ী বুর্জোয়ারা মুখে স্বাধীনতার কথা বলে ব্যাপকভাবে। কিন্তু বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় বাস্তবে নারী স্বাধীনতার অনস্তিত্বই রূঢ় সত্য। ফুরিয়ের মতানুসারে সমাজের সামগ্রিক উন্নতি ও প্রগতির প্রকৃত মাপকাঠি হল নারী স্বাধীনতা। ফুরিয়ে বুর্জোয়া সমাজে যৌন সম্পর্কের বিকাশের চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তিনি সাধারণভাবে মহিলাদের অবস্থান সম্পর্কে সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন।

ফুরিয়ে এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, নিদারুণ দারিদ্র্যের কারণ প্রভূত প্রাচুর্যের মধ্যেই বর্তমান। এ হল বিদ্যমান সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রকৃত প্রস্তাবে বুর্জোয়া সমাজ-সভ্যতার মধ্যে বিবিধ দ্বন্দ্ব-বিবাদ ও স্ববিরোধী প্রকৃতির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। ফুরিয়েই সর্বপ্রথম এই বিষয়টিকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিপন্ন করেছেন। ফুরিয়ে বাণিজ্যিক সভ্যতার সকল সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেছেন। বাণিজ্যিক সভ্যতায় অপরাধমূলক কাজকর্মের পরিণামে পারিতোষিক ও মুনাফা পাওয়া যায়; সদাচারের পরিণামে জোটে দুঃখ-কষ্ট। বাণিজ্যিক সভ্যতার পরিমন্ডলে ব্যক্তিবর্গের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতার সৃষ্টি হয়। তীব্র প্রতিযোগিতা, লোভ, হিংসা, অমানবিকতা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয় নানান অন্যায়-অবিচারের। মানবজীবনে সমন্বয় সঙ্গতি সৃষ্টির স্বার্থে সংগঠন ও সহযোগিতা থাকা দরকার।

মানব সমাজের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায় প্রসঙ্গে ফুরিয়ে আলোচনা করেছেন। চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করে তিনি সামাজিক ইতিহাসের ধারাকে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। সমাজ ও রাষ্ট্র বিকশিত হয়েছে চারটি স্তর বা পর্যায়ের ভিতর দিয়ে। এই চারটি স্তর হল: (১) বন্য স্তর (savagery), (২) বর্বর স্তর (Barbar ism), (৩) পিতৃতান্ত্রিক স্তর (patriarchal) এবং (৪) সভ্য স্তর (civilization)। সর্বশেষ স্তরটি হল সভ্য স্তর এবং এই স্তরটিই হল বুর্জোয়া সমাজের স্তর। ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপে বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটে।

অনেকে মনে করেন যে, ফুরিয়ে এক ধরনের দার্শনিক নৈরাষ্ট্রবাদী ধারণা (Philosophical anar chy)-র অবতারণা করেছেন। ফুরিয়ে কতকগুলি বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এই বিষয়গুলি হল সামাজিক জীবনে সঙ্গতি সাধন, সাধারণভাবে সমাজ-সংগঠনে এবং আর্থনীতিক ও রাজনীতিক জগতে বৈরিতা-রহিত শৃঙ্খলা সৃষ্টি প্রভৃতি। তিনি ব্যক্তি-মানুষের সামাজিকতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তা ছাড়া তিনি সমিতি-সংগঠন গড়ে তোলার উপর জোর দিয়েছেন। ফুরিয়ে ‘ফালাঞ্জ’ (Phalange) নামে নতুন এক ধরনের গোষ্ঠী সংগঠিত করার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

এক একটি ফালাঞ্জ গড়ে উঠবে পাঁচশ’টি পরিবারকে নিয়ে। পুঁজিপতি, শ্রমিক এবং সৃষ্টিধর্মী কর্মচিন্তার মানুষজন প্রতিটি ফালাঞ্জের মধ্যে থাকবে। অর্থাৎ প্রতিটি ফালাঞ্জ বৃহৎ একটি সম্প্রদায় হিসাবে সংগঠিত হবে। প্রতিটি ফালাঞ্জ গোষ্ঠী বসবাস করবে এক বর্গ লীগ এলাকায়। ফুরিয়ের অভিমত অনুসারে ফালাঞ্জ ব্যবস্থার মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব হবে। শ্রমকে অধিকতর আকর্ষণীয় করে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমকে অধিকতর আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য প্রত্যেক শ্রমিককে উৎপাদনের একটি অংশ দিতে হবে। শ্রমিকের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে উদ্বেগ-আশঙ্কার অবসানের জন্য ন্যূনতম প্রাপ্তিটিও পর্যাপ্ত হওয়া দরকার। সঙ্গে সঙ্গে একঘেঁয়ে ও বিরক্তির শ্রমপ্রক্রিয়া এবং অতিরিক্ত শ্রমের ব্যবস্থাকে বন্ধ করতে হবে। প্রত্যেকের জন্য ন্যূনতম উপার্জনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। অপ্রীতিকর কাজের এবং অতিরিক্ত পরিশ্রমের কাজের জন্য বিশেষ পারিতোষিকের ব্যবস্থা থাকতে হবে। নির্দিষ্ট হারে উদ্বৃত্ত আয় বণ্টিত হবে। ফালাঞ্জ গোষ্ঠীর সদস্য হিসাবে প্রত্যেকে স্বাভাবিক স্বাধীনতার অধিকার ভোগ করার সুযোগ পাবে। এ রকম সমাজব্যবস্থায় এক সময় প্রতিষ্ঠিত হবে এক ধরনের স্বাভাবিক ঐক্যতান। তখন শোষণ-পীড়নমূলক কোন রকম ব্যবস্থার প্রয়োজন আর থাকবে না। ফুরিয়ে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানের কথা বলেননি। তিনি বলেছেন যে, প্রতিটি ফালাঞ্জ একটি যৌথ কারবারী করপোরেশন (joint stock corporation)-এর মত সংগঠন হিসাবে গড়ে উঠবে। মুনাফা সকলের মধ্যে বণ্টিত হবে। মজুরী ব্যবস্থার বিলোপ সাধিত হবে। শ্রমিকরাও মুনাফার অংশ পাবে। এই সংগঠনের সকল সদস্যের খাদ্য, আবাসন, বস্ত্র ও বিনোদনের ন্যূনতম ব্যবস্থার নিশ্চয়তা থাকবে। গাইড ও রিস্ট (C. Gide & C. Rist) তাঁদের A History of Economic Doctrines শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: ….the Phalanax would be a kind of co-operative hotel, belonging to an association and accommodating members of that association. only. It would be a small self-sufficing world, a microcosm producing everything it consumed, and consuming-as far as it could-all it produced.”

রবার্ট ওয়েন [Robert Owen (1771-1858AD)]

ইংরেজ চিন্তাবিদ্ রবার্ট ওয়েন কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীদের মধ্যে এক বিশিষ্ট অবস্থানের অধিকারী। তিনি ছিলেন ঘোরতর বস্তুবাদী। তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিরুদ্ধে আক্রমণ শাণিত করেছেন। সমকালীন সমাজব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা ব্যাপারে ওয়েন উদ্যোগ-আয়োজন গ্রহণ করেছিলেন। পরিবর্তনের পথের এবং সাম্যবাদী ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথের প্রতিবন্ধকতাসমূহ সম্পর্কেও ওয়েন বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন। ওয়েন তার সময়কার ইংল্যান্ডের বিদ্যমান বিবাহ ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় ব্যবস্থাদির অন্তর্গত বিবিধ ক্ষতিকর বিধি-রীতি, প্রথা ও সংস্কারগুলিকে চিহ্নিত করেছেন এবং সেগুলির তীব্র বিরূপ সমালোচনা করেছেন। জোহারী তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন: “..like Fourier, Owen discovers the alternative to the evils of capitalist society in establishing co-operative village societies averaging about 1,000 persons and including both agricultural and industrial workers.”

রবার্ট ওয়েনের জীবন জুড়ে কর্ম-চিন্তার বিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়ারদিকে প্রধানত একজন শিল্পপতি ও বিচক্ষণ ব্যবসায়ী হিসাবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। ধ্যান-ধারণার বিচারে তিনি ছিলেন একজন আদর্শবাদী। কলকারখানায় শ্রমিক-মালিক পারস্পরিক সুস্থ সম্পর্ক ও সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে তোলার ব্যাপারে ওয়েনের আগ্রহ ও আন্তরিকতা ছিল। শ্রমজীবী জনতার দুঃখ-দারিদ্র্য সম্পর্কে তিনি সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। মেহনতী মানুষের অভাব-অভিযোগের অবসানের উদ্দেশ্যে তিনি সামাজিক সংস্কার সাধনের পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি এক ধরনের মডেল-সমাজের কথা বলেছেন। এই মডেল সমাজে থাকবে একটি সাধারণ পরিষদ (General Council)। এই পরিষদ সমাজের আভ্যন্তরীণ প্রশাসন পরিচালনা করবে। অন্যান্য আরও পরিষদ থাকবে। এই সমস্ত পরিষদের কাজ হবে বিভিন্ন অঞ্চল ও সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে সংযোগ সম্পর্ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থাকে পরিচালিত করা। একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে ওয়েনের আগ্রহ ও আন্তরিকতা ছিল। এই উদ্দেশ্যে তিনি শ্রমিক-মালিকের মধ্যে বর্তমান যাবতীয় বিবাদ-বিসংবাদ ও প্রতিযোগিতার অবসানের পক্ষপাতী ছিলেন। এ লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য ওয়েন সমবেত প্রচেষ্টা ও শান্তিপূর্ণ সহযোগিতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

ওয়েনের কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদে এক যৌথ সম্পদায়গত জীবনযাত্রার পরিকল্পনা পাওয়া যায়। এই জীবনযাত্রার মাধ্যমে ব্যক্তিমাত্রেই তার মূল প্রকৃতিগত সদর্থক গুণাবলী অনুসারে মুক্ত ও স্বাধীন কার্যকলাপের সুযোগ-সুবিধা লাভ করবে। এই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করার লক্ষ্যে তিনি নির্দিষ্টভাবে কিছু প্রাসঙ্গিক পরিকল্পনাও রচনা করেছিলেন। রবার্ট ওয়েনের অভিমত অনুযায়ী মূল প্রকৃতিগত বিচারে মানুষ মাত্রেই ভাল। মন্দ ও ক্ষতিকারক যাবতীয় প্রবণতার সৃষ্টি হয়েছে শিল্প সভ্যতার কারণে। ওয়েন মানবসমাজের মূল প্রকৃতি ও স্বাভাবিক অবস্থা অব্যাহত রাখার পথে কতকগুলি প্রতিবন্ধকতাকে চিহ্নিত করেছেন। এই সমস্ত প্রতিবন্ধকতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ব্যক্তিগত সম্পত্তি ব্যবস্থা, ধর্মীয় ব্যবস্থা, বিবাহ ব্যবস্থা সম্পর্কিত প্রতিবন্ধকতা প্রভৃতি।

রবার্ট ওয়েনের অভিমত অনুসারে ধ্যান-ধারণা, বিবেকবুদ্ধি, নীতিবোধ, গুণাবলী এগুলি মানুষের সহজাত নয়। বিবিধ বাহ্যিক প্রভাবের মাধ্যমে মানবচরিত্র নির্ধারিত হয়ে থাকে। মানুষের গুণাবলী বা বৈশিষ্ট্যসমূহ অলৌকিক কোন শক্তির অনুগ্রহ সঞ্জাত নয়। মানুষের বিবেকবুদ্ধি একটি উৎপাদিত সামগ্রী ছাড়া আর কিছু নয়। এক্ষেত্রে তুলনা হিসাবে তিনি বস্তু থেকে উৎপন্ন সামগ্রীর কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন: “The fact is that conscience is just as much a nianufacture as cotton or any meterial “

রবার্ট ওয়েনের চিন্তা ও কর্মের সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে ইংল্যাণ্ডের সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় জীবনে! ওয়েনের প্রভাব প্রবলভাবে পরিলক্ষিত হয় ইংল্যাণ্ডের জনজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এই ক্ষেত্রগুলি হল সমবায় সমিতি গঠন, শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ রক্ষায় রাষ্ট্রীয় বিধি প্রণয়ন, শ্রমিকদের সংঘ-সমিতির উপর আরোপিত অন্যায় নিয়ম-নিষেধের অবসান প্রভৃতি। জোহারী তাঁর Principles of Modern Political Science শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “…in England Robert Owen came forward with his own design of future society based on the principles of complete equality and justice.” শ্রমিক আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ওয়েনের অবদান অনস্বীকার্য। গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চলের শ্রমজীবীদের পারস্পরিক সমঝোতার সম্পর্কের উপর ওয়েন বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। উৎপাদনশীল ও বণ্টনমূলক সহযোগিতা-সমবায়ের পথপ্রদর্শক হিসাবে ওয়েনের নাম সুবিদিত। মহাজন তাঁর Political Theory শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “The core of his message was that the condition of men would improve if they replaced competition by co-operation as the mainspring of their economic activities and social life…. The minds of the people could be so changed that they came to appreciate the advantages of co-operation. Owen helped the growth of co-operative societies and the trade union movement.”

মূলত ফরাসী বুদ্ধিজীবীদের দ্বারাই কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদের বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছে। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদের ঐতিহ্য যে সমস্ত ফরাসী চিন্তাবিদের দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছে তাঁরা হলেন সিসমন্ডি, সা সিম, লুই ব্লাঙ্ক, এটিয়েনে ক্যাবে প্রমুখ। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদের ঐতিহ্য অধিকতর জোরদার হয়েছে প্রগতিবাদী ইংরেজ বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রবার্ট ওয়েন, বেলামী, বাটলার, ওয়েলেস, টমসন প্রমুখ। কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদী হিসাবে জার্মান চিন্তাবিদ রডবার্টাস (J. K. Rodbertus)-এর নাম উল্লেখ করা দরকার।

কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদের মূল্যায়ন

(১) কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীরা বিদ্যমান ব্যবস্থা ও প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরূপ সমালোচনা করেছেন। কিন্তু তাঁদের মতাদর্শের বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ কিছু তাঁরা করেননি। এতদ্‌সত্ত্বেও রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে বা সমাজবাদী ধ্যান-ধারণার ইতিহাসে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীদের অবদান অনস্বীকার্য। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রবাদীরা পরবর্তীকালের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাবিদদের চিন্তাভাবনার পটভূমি তৈরি করে দিয়েছেন। 

(২) কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীরা বিদ্যমান শিল্পব্যবস্থার সীমাবদ্ধতাসমূহের প্রতি সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁরা ভবিষ্যতের এক বিশেষধরনের সমাজব্যবস্থার রূপরেখা রচনা করেছেন। ভবিষ্যতের এই সমাজব্যবস্থা অন্যায়-অবিচার, অসাম্য-বৈষম্য ও শোষণ-পীড়ন থেকে মুক্ত।

(৩) শিল্পবিপ্লবোত্তর ইউরোপের প্রথম পর্যায় হল কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদী ধ্যান-ধারণার পটভূমি। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রবাদীরা সমাজের উন্নয়নের সহায়ক হিসাবে শিল্পায়নের জোয়ারকে স্বীকার করেছেন এ কথা ঠিক। কিন্তু শিল্পসমাজের আর্থনীতিক অসাম্য-বৈষম্য, দুঃখ-দারিদ্র্য, অশিক্ষা প্রভৃতি কুফলসমূহকে তাঁরা স্বীকার বা সমর্থন করেন নি। শিল্পসমাজের এই সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে তাঁরা মানবসমাজের প্রগতির প্রতিবন্ধক হিসাবে কঠোর সমালোচনা করেছেন।

(৪) কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীরা আর্থ-সামাজিক কাঠামোর মৌলিক বা বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের কথা বলেননি। স্বভাবতই তাঁরা বৈপ্লবিক শক্তিসমূহকে সংগঠিত করার কথাও বলেননি। সাম্যবাদের বাস্তবায়ন আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এ বিষয়ে এই শ্রেণীর সমাজবাদীদের মধ্যে সচেতনতা ছিল না। আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের জন্য সংঘাতমূলক জঙ্গী ক্রিয়াকর্মের কথা বলেননি।

(৫) কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদের প্রবক্তারা সমকালীন অবাধ নীতির সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সকলকে অবহিত করেছেন এবং ক্ষতিকারক পরিণামের ব্যাপারে সকলকে সতর্ক করেছেন। সিসমণ্ডি প্রমুখ প্রথম দিকের কাল্পনিক সমাজতন্ত্রীরা দেখিয়েছেন যে, আর্থনীতিক লাভালাভের উপর জোর দিতে গেলে অসংখ্য মানুষের জীবনে সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশা নেমে আসবে।

(৬) এই শ্রেণীর সমাজবাদীরা সম্পদের সম্যক বণ্টনের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সম্পদ-সামগ্রী ও ভোগ্যপণ্যের অসম বণ্টনের বিষয়টি কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীদের বিচলিত করেছে। 

(৭) দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্পর্কিত সমস্যার মোকাবিলার ব্যাপারে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীরা সংঘাতমূলক জঙ্গী কার্যক্রমের কথা বলেননি। এই শ্রেণীর সমাজতন্ত্রীদের অধিকাংশই দরিদ্র ব্যক্তিবর্গের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতার ব্যবস্থা করার পক্ষপাতী। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁরা সম্পত্তিবান শ্রেণীর কাছে আবেদেন-নিবেদন করার কথা বলেছেন।

(৮) প্রকৃত প্রস্তাবে এবং চূড়ান্ত বিচারে কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদীরা হলেন মূলত মানবতাবাদী দার্শনিক। এক ধরনের মানবতাবাদী মধ্যবিত্ত ধ্যান-ধারণার ঐতিহ্য কাল্পনিক সমাজতন্ত্রের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। এই শ্রেণীর সমাজবাদী দার্শনিকরা মানবপ্রকৃতির পরিবর্তনের পক্ষপাতী ছিলেন। এবং এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তাঁরা প্রধানত শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার সাধন এবং শিক্ষাব্যবস্থার বিকাশ ও বিস্তারের উপর জোর দেওয়ার কথা বলেছেন।

কাল্পনিক সমাজতন্ত্রবাদের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে পরিশেষে ওয়েপার (C. L. Wayper)-এর অভিমত প্রণিধানযোগ্য। ওয়েপার তাঁর Political Thought শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন: “They voiced their irrational longings of the empty soul from which so much of the driving force of socialism comes……..They popularized the idea of a socialist society. They elaborated the labour theory of value. But they failed where he (Marx) succeeded because they did not see the two requisites of socialism as a serious political factor where a doctrine which maintains that real social forces are making for socialism and a permanent contact with a source of power which can be harnessed for revolutionary socialist activity.”