কালীনাথ নবকুমারের ইয়ার বন্ধুদের অন্যতম। ‘জ্ঞানতরঙ্গনী সভার অন্যান্য সদস্যদের তুলনায় সে নবকুমারের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ, প্রায় তার নিত্য সঙ্গী। ধনী বংশে তার জন্ম, কিন্তু নবকুমারের মতো সেও এক কুলাঙ্গার। নবকুমারের মতো বিশাল পরিমাণে না হলেও ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার ব্যয়ভারের একটা অংশ সে বহন করে। নবকুমারের মতোই ইংরেজি জ্ঞান তার সামান্যই অথচ নিজের ইংরেজি বিদ্যে নিয়ে সে বড়াই করে। ‘জ্ঞা তরঙ্গিনী সভার অন্যান্য সদস্যরা তাদের নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে যতই বলুক না কেন ‘যা বল ভাই কিন্তু ওরা দুজনে লেখাপড়া বেশ জানে—প্রকৃতপক্ষে তাদের ভাষাজ্ঞান ছিল নিতান্তই দুর্বল। কথোপকথন কালে ইংরেজি বাংলা মিলিয়ে এক ধরনের জগাখিচুড়ি ভাষা কালীনাথ ব্যবহার করেছে। সে এত অজ্ঞ যে শ্রীমদ্ভাগবত এবং জয়দেবের গীতগোবিন্দর মতো অতি বিখ্যাত দুটি গ্রন্থের নামও সে শোনেনি। স্মৃতিশক্তি এতই দুর্বল যে নবকুমার শিখিয়ে দিলেও এদুটি গ্রন্থের সঠিক উচ্চারণও সে করতে পারেনি। শ্রীমদ্ভাগবত গীতাকে বলেছে ‘শ্রীমতী ভগবতীর গীত’ এবং গীতগোবিন্দকে বলেছে ‘বিন্দা দূতীর গীত’। আর তাই শুনে নবকুমার তার স্মৃতিশক্তিকে বিদ্রূপ করে বলেছে ‘ভায়ার কি চমৎকার মেমরি’।
কালীনাথ সর্বক্ষণের মদ্যপায়ী, মদ না পেলে এক মুহূর্তও চলে না। নবকুমারের বাড়ির বৈঠকখানায় উপস্থিত হয়ে সামান্য কথাবার্তার পরই সে বলেছে যে তার গলা শুকিয়ে গেছে। ‘চাকর’ বৈদ্যনাথ মদ নিয়ে এলে সে পুনঃপুনঃ তা পান করেছে এবং মদ্যপানজনিত তৃপ্তির উল্লাসকে প্রকাশ করেছে।
কালীনাথ একান্তই মিথ্যেবাদী। নবকুমারকে ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী’ সভায় নিয়ে যাবার জন্য কর্তামশায়ের কাছে নিলর্জ্জভাবে মিথ্যে কথা বলেছে। কর্তামশায়ের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য সে নিজেকে এক বিখ্যাত বৈশ্বব স্বর্গীয় কৃষ্ণপ্রসাদ ঘোষের ভ্রাতুষ্পুত্র বলে পরিচয় দিয়েছে এবং ‘জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায়’ সংস্কৃত ভাষায় চর্চা হয়, সংস্কৃত সাহিত্য ও কাব্যপাঠ হয় একথাও জানিয়েছে। গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা তার সামান্যই : নবকুমারের বাইরে বেরুনোর পথে কর্তামশাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে শুনে সে মন্তব্য করেছে, ‘হাঃ এ বুড়ো বেটা কি অকালের বাদল হয়ে আমাদের প্লেজর নষ্ট কাত্যে এলো’, আবার প্রয়োজনের মুহূর্তে বিনয়ের অবতার সেজে বলেছে “জ্যেঠামহাশয় আজ নবকুমারদাদাকে আমার সঙ্গে যেতে আজ্ঞা করুন”। মদ্যপান ভণ্ডামীতে মিথ্যে কথা বলার দক্ষতায় নিশ্চিতভাবে সে সকলকে ছাপিয়ে গেছে।
আর এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে তার প্রবল বৈশ্যাসক্তি। বারঙ্গনা পল্লিতে যে তার অবাধ যাতায়াত—একথা বলতে তার জিহ্বা এতটুকু আড়ষ্ট হয়নি। একান্তই লজ্জাহীন বলে সে বলেছে “সোনাগাছিতে তার শত শত শাশুড়ীর আলয়”। গরাণহাটায় গিয়ে প্যারী ও বিন্দি নামে দুই বারাঙ্গনার সঙ্গে সে কত স্ফূর্তি করেছে তার স্মৃতি রোমথন করেছে আনন্দের সঙ্গে।
হিন্দু কুলে জন্মগ্রহণ করে নিষিদ্ধ গোমাংস ভক্ষণ করতে তার কোনো আপত্তি নেই। গোমাংস-ভক্ষণ-কুসংস্কার থেকে মুক্তির একটা অন্যতম উপায় বলে ইয়ং বেঙ্গল দল মনে করত। কালীনাথ (সেই সঙ্গে নবকুমার) সেই ইয়ং বেঙ্গল দলেরই যোগ্য প্রতিভূ। তার নিজের চরিত্র যতই কুৎসিত ও জঘন্য হোক্ না কেন পরের চরিত্র বিচার বা সমালোচনা করতে তার এতটুকুও বাধে না। গেরুয়া বসনধারী এবং মালাজপকারী বাবাজিকে নবকুমার কর্তৃক প্রদত্ত উৎকোচের দ্বারা বশীভূত হতে দেখে সে মন্তব্য করেছে “শালা এদিকে মালা ঠক্ ঠক্ করে আবার ঘুষ খেয়ে মিথ্যা কথা কইতে স্বীকার পেলে? ‘শালা হিপক্রীট। বস্তুত নিজে একজন হিপক্রীট হয়ে আর একজনকে হিপক্রীট বলে সম্বোধন করে নিজের হিপক্রিটের মাত্রাকে সে বহুগুণ বর্ধিত করে তুলেছে।
তাছাড়া কালীনাথ যথেষ্ট ধৈর্যশীল নয়। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করে কাজ করতে সে অভ্যস্ত নয়। সিকদার পাড়ার বাবাজিকে দেখে ‘শালাকে গোটা কতক কিক্ দিয়ে একেবারে বৈকুণ্ঠে’ পাঠিয়ে দেবার কথা সে বলেছে। কিন্তু কৌশলী নবকুমার সে পথে না গিয়ে অর্থ দিয়ে তাকে বশীভূত করেছে।
Leave a comment