কালিদাসের আবির্ভাবকাল সম্বন্ধে তোমার মতামত লেখ।
কালিদাসের জীবৎকাল বিষয়ে তিনটি অভিমত প্রচলিত আছে। স্যার উইলিয়ম জোন্স এবং ভারতের বহু মনীষী মনে করেন যে খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে উজ্জয়িনীরাজ বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় কালিদাস বর্তমান ছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিকগণ ঐ কালে ভারতবর্ষে বিক্রমাদিত্য নামে কোনো রাজার সন্ধান পান নি। এছাড়া কালিদাসের রচনায় ‘ভাস’-এর নামোল্লেখ পাওয়া যায়। অশ্বঘোষের প্রভাবের পরিচয়ও তাঁর রচনায় মেলে। অশ্বঘোষ নিশ্চিতভাবেই ১০০ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান ছিলেন এবং ভাস তৃতীয় শতকে বর্তমান ছিলেন বলে অনুমিত। ফলত সিদ্ধান্ত করা যায় যে কালিদাস-এর পরবর্তী কালের লোক ছিলেন।
কীথ-এর মতানুযায়ী গুপ্তবংশীয় সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (৩৮০-৪১৩ খ্রিস্টাব্দ) ‘বিক্রমাদিত্য’ উপাধি গ্রহণ করেন এবং রাজধানী পাটলিপুত্র থেকে উজ্জয়িনীতে সরিয়ে নিয়ে যান। সেই উজ্জয়িনীরাজ বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার এক উজ্জ্বল রত্ন ছিলেন কালিদাস। অধিকন্তু কালিদাসের বিক্রমোবশী’তে বিক্রম নামের এবং ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যে বিক্রমাদিত্য পুত্র কুমারগুপ্তের নাম সাদৃশ্যও সবিশেষ লক্ষণীয়। এইসব প্রমাণ থেকে কালিদাস যে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের শেষ থেকে পঞ্চম শতকের কিছুকাল পর্যন্ত বর্তমান ছিলেন—এই অভিমত সর্বথা গ্রহণযোগ্য।
কালিদাসের রচনাবলী বিষয়ে গবেষকদের অশান্তির কারণ কী?
মহাকবি কালিদাসের প্রকৃত রচনাবলী হিসেবে মোট সাতখানি কাবাকে সনাক্ত করেছেন সাহিত্য গবেষকগণ। তার মধ্যে তিনটি নাটক, দুটি মহাকাব্য ও দুটি খণ্ডকাব্য বর্তমান। রচনাগুলির নাম যথাক্রমে · মালবিকাগ্নিমিত্র, বিক্ৰমোবশী, অভিজ্ঞান শকুন্তলম্ কুমারসম্ভব, রঘুবংশ, মেঘদূত এবং ঋতুসংহার। শেষোক্ত যশুকাবা ঋতুসংহারের রচয়িতা প্রসঙ্গে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করে থাকেন।
‘কালিদাস’ নামে অষ্টম/নবম শতকে আরও তিনজন কবির সন্ধান পাওয়া যাওয়ার ফলে বিক্রমাদিত্যের রাজসভার উজ্জ্বল রত্ন মহাকবি কালিদাসের রচনাবলীর সঙ্গে তাদের রচনাবলীর পৃথকীকরণে সমস্যা দেখা দেয়। ফলত কালিদাসের নামে ‘নলোদয়’, ‘পুষ্পবাণবিলাস’, ‘শৃঙ্গার তিলক’, ‘শৃঙ্গাররসাষ্টক’, ‘দ্বাত্রিংশৎপুত্তলিকা’, ‘শ্রুতিবোধ, ‘দুর্ঘটকাব্যচিত্রকা’, ‘দুষ্করমালা’, ‘চিদ্গগনচন্দ্রিকা’, ‘ভ্রমরাষ্টক’, ‘অর্থাত্তর’, ‘লঘুস্তবক’, ‘কালীস্তোত্র’, ‘বিদ্বদবিশেষ কাব্য’, ‘গঙ্গাষ্টক’, ‘বৃন্দাবন কাব্য’, ‘চন্ডিকাদণ্ডস্তোত্র’, ‘ঘটকর্পর’, ‘উত্তরকালামৃতম্’, ‘রাবণবহো’ প্রভৃতি কাব্যাদি প্রচলিত। এ থেকে স্পষ্টতই অনুমিত হয় যে অপর কালিদাসের রচনাও মহাকবি কালিদাসের নামে আরোপিত হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে মহাকবির রচনা কোনগুলি তা সনাক্তকরণে তাই গবেষকদের মধ্যে নানা অশান্তি বিদ্যমান।
কালিদাসের মেঘদূতকে খন্ডকাব্য বলা হয় কেন?
সংস্কৃত কাব্যের প্রধানত দুটি ধারা লক্ষ্য করা যায় একটি শ্রব্যকাব্য অন্যটি দৃশ্যকাব্য। এই শ্রব্যকাব্যের তিনটি ধারা—পদ্যকাব্য, গদ্যকাব্য এবং চম্পৃকাব্য। আর দৃশ্যকাব্য বলতে বোঝায় রূপক তথ্য নাটককে। পদ্যকাব্যের আবার তিনটি শাখা পাওয়া যায়—মহাকাব্য, খণ্ডকাব্য এবং কোষকাব্য। খণ্ডকাব্য বলতে সাধারণত গীতিকবিতা, নীতিকবিতা, শতক কাব্য প্রভৃতিকে বোঝায়।
গীতিকবিতা বা গীতিকাব্য বলতে কালিদাসের ‘মেঘদূত’ এবং ‘ঋতুসংহার’ কাব্যদুটির নামোল্লেখ করা হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে কালিদাসের মহাকাব্য ও খণ্ডকাব্য তথা গীতিকাব্যের মধ্যে গুণগত পার্থক্য খুব একটা নেই। আলংকারিকগণ যেভাবে মহাকাব্য ও খণ্ডকাব্যের লক্ষণাদি বর্ণনা করে তাদের শ্রেণীবিন্যাস করেছেন তাতে উভয়ের মধ্যে মূলত আকার ও বিষয়গত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। লালমোহন বিদ্যানিধি বলেন, “কোন এক বিষয়ের উপর লিখিত অনতিদীর্ঘ যে কাব্য, আলংকারিকরা তাহাকে ‘খণ্ডকাব্য’ বলেন। খণ্ডকাব্য মহাকাব্যের প্রণালীতে রচিত; কিন্তু মহাকাব্যের সম্পূর্ণ লক্ষণাক্রান্ত নহে। কোন কোন খণ্ডকাব্য মহাকাব্যের ন্যায় সর্গবন্ধে বিভক্ত নয়। আর যে সকল খণ্ডকাব্য সর্গবন্ধে বিভক্ত, তাহাতে সর্গসংখ্যা আটের অধিক দেখা যায় না। মেঘদূত ও ঋতুসংহার প্রভৃতির ন্যায় কাব্য খণ্ডকাব্য।”
বস্তুত মহাকাব্যের ধারায় রচিত হলেও যেহেতু মেঘদূত কাব্য একটি মাত্র বিষয়কে ভিত্তি করে অনতিদীর্ঘাকারে রচিত হয়েছে মূলত সেই কারণেই একে খণ্ডকাব্য বলা হয়ে থাকে।
কালিদাসের নাটক তিনটির নাম কী? তাদের বিষয়বস্তু কী?
কালিদাসের নাটক তিনটির নাম ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’, বিক্রমোবশী’ এবং ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’।
‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ কালিদাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তিরূপে অভিবন্দিত। মহর্ষি কল্পের আশ্রমে পুরুবংশীয় নৃপতি দুষ্মন্তের সঙ্গে শকুন্তলার গান্ধর্ব বিবাহ, দুর্বাসার অভিশাপে তাদের সাময়িক বিচ্ছেদ ও পরিশেষে মহর্ষি মারীচের আশ্রমে পুত্রবতী শকুন্তলার সঙ্গে দুষ্মন্তের মিলন এবং স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে ইন্দ্রের রথে স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন।
‘বিক্রমোবশী’ এটি পঞ্চাঙ্ক সঙ্গীত বহুল মিলনান্তক নাটক। কালিদাস রচিত দ্বিতীয় নাটক এটি। কেশী নামক দৈত্যের হাতে অপহৃতা ও নিপীড়িতা উর্বশীকে রাজা পুরুরবা রক্ষা করার পর উভয়ের মধ্যে প্রেম সঞ্চার হয়। একবার স্বর্ণসভায় সরস্বতী রচিত ও মহর্ষি ভরত পরিচালিত ‘লক্ষ্মীস্বয়ম্ভর’ নাটকে লক্ষ্মীর ভূমিকায় অভিনয়কালে, মনোবিকলন হেতু ‘প্রিয়তম’-র স্থলে ‘পুরুরবা’ উচ্চারণ করার জন্যে উর্বশী স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে মর্ত্যে নির্বাসিত হলেন। মর্ত্যে পুরুরবার পত্নীরূপে দীর্ঘকাল যাপন করে ইন্দ্রের আশীর্বাদে পুরুরবাকে সন্তানের মুখ দেখানোর পর উর্বশীর স্বর্গে প্রত্যাবর্তনের সময় এলে, আসন্ন বিচ্ছেদভারে উভয়েই ব্যথিত হলেন। এমন সময় মহর্ষি নারদ এসে বললেন। যে দেবাসুরের যুদ্ধে পুরুরবাকে দেবতাদের সহায়তা করতে হবে এবং উর্বশীকে তাঁর পত্নীরূপে আমৃত্যু সহবাসের বর দান করেছেন ইন্দ্র। মিলনের আনন্দের মধ্যে দিয়ে নাটকের পরিসমাপ্তি ঘটল।
‘মালবিকাগ্নিমিত্রম’ সম্ভবত কালিদাস রচিত প্রথম নাটক। বিদিশার রাজা অগ্নিমিত্র এবং বিদর্ভরাজ-কন্যা মালবিকার প্রণয় কাহিনীই এই নাটকটির উপজীব্য।
ঋতুসংহারের রচয়িতা সমস্যার কারণ কী?
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত – এই ছয় ঋতুকে অবলম্বন করে কিঞ্চিদধিক পৌনে দুশো শ্লোকে রচিত আদিরসাশ্রিত একটি ক্ষুদ্রকায় খণ্ডকাব্যের নাম ঋতুসংহার। কাব্যটি মহাকবি কালিদাসের রচিত কি না এ বিষয়ে পণ্ডিত মহলে মতভেদ আছে। কালিদাসের সমস্ত গ্রন্থের টীকাকার মল্লিনাথ আলোচ্য গ্রন্থটির টীকা রচনা না করায় এবং কালিদাসের অন্যান্য রচনার তুলনায় আলোচ্য খণ্ডকাব্যটি অপরিশীলিত এবং অপরিপক্ক নিদর্শন সম্বলিত হওয়ার জন্যে ভারতীয় সমালোচকগণ ঋতুসংহারকে কালিদাসের রচনা বলে মেনে নিতে কুণ্ঠাবোধ করেন। কিন্তু য়ুরোপের পণ্ডিতগণ এ বিষয়ে ভিন্নমত অবলম্বন করেন। তাঁরা ঋতুসংহারে অপরিণতির চিহ্ন থাকার জন্যেই একে কালিদাসের প্রথম দিকের রচনা বলে গ্রহণ করতে কৃতসংকল্প। কালিদাসের প্রথম রচনা হিসেবে অপরিণতির স্বাক্ষর অস্বাভাবিক নয় বলেই তাঁদের ধারণা। তাঁরা মনে করেন ঋতুসংহারের ভাব এবং ভাষা অত্যন্ত সহজ বলেই মল্লিনাথ এর টীকা রচনা করেন নি। ভারতীয় এবং পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিতদের এই মতভেদের কারণেই ঋতুসংহারের রচয়িতা সমস্যা উদ্ভূত হয়েছে। এতসত্ত্বেও কালিদাসের রচনাবলীর ভারতীয় সংস্করণগুলিতে ঋতুসংহার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে কাব্যটি পরবর্তী সংস্কৃত সাহিত্যে খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
Leave a comment