মহাকবি কালিদাসের আনুমানিক আবির্ভাবকাল উল্লেখ করে তাঁর নাটকাবলীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।
মহাকবি কালিদাসের বিরচিত দুটি নাটকের পরিচয় প্রমাণ প্রসঙ্গে নাট্যকার কালিদাসের কৃতিত্ব বিচার করো।
কালিদাসের দুটি নাটকের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। মহাভারতের শকুন্তলা কাহিনী তার হাতে কীরূপ নতুন রূপ পেয়েছে তা বুঝিয়ে দাও।
‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ অবলম্বনে কালিদাসের নাট্যপ্রতিভার পরিচয়—মহাভারত থেকে কাহিনী গ্রহণ করে তিনি কি এই নাটকে নবরূপ দান করেছেন?
মহাকবি কালিদাসের আনুমানিক আবির্ভাব কাল এবং তাঁর নাটকাবলীর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।
কালিদাসের তিনটি নাটক বিশ্লেষণ করে তাঁর নাট্যপ্রতিভার পরিচয় দাও।
কালিদাসের শ্রেষ্ঠ নাটক কোনটি? সংক্ষেপে এটির কাহিনী বিবৃত করে শ্রেষ্ঠত্বের কারণ নিরূপিত করো।
কালিদাসের নাটক বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রথমেই বলে নেওয়া প্রয়োজন যে, নাটক-সম্বন্ধে একালের যে ধ্যান-ধারণা, সেই মানদণ্ডে কালিদাসের নাটক বিচার করলে অবিচারেরই আশঙ্কা থেকে যাবে। কারণ, একালের নাটক বা পাশ্চাত্র্যের নাটক-বিচার পদ্ধতিতে ঘটনা-সংঘাত, নাটকীয়তা-আদি যে ভূমিকা গ্রহণ করে, প্রাচীন ভারতীয় নাটকে তাদের স্থলবর্তী হয়েছে ভাবাবেগ ও রসোদ্বেলতা। প্রাচ্যমতে নাটকও কাব্যশ্রেণী ভুক্ত—’কাব্যেষু নাটকং রম্যম্’, কাজেই নাটকের কাব্যগুণ প্রাচ্য আলঙ্কারিকদের নিকট যেভাবে প্রশংসিত হয়, আধুনিক কালে তা’ হয় না। অতএব এ বিষয়ে সচেতন থেকেই কালিদাসের নাটক-বিচারে প্রবৃত্ত হওয়া উচিত।
কালিদাস রচিত নাটকের সংখ্যা তিনটি—(১) ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’, (২) বিক্রমোর্বশীয় এবং (৩) ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’।
১। ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ : কালিদাসের নাটকের ক্রম-পরম্পরা একান্তই অনুমান-সাপেক্ষ। অনেকেরই ধারণা ‘মালবিকাগ্নিমিত্র ই তাঁর প্রথম নাটক।
কাহিনী: নাটকটির কাহিনী ‘কালিদাস-গ্রথিত’ অর্থাৎ কালিদাসের স্ব-কল্পিত বলেই নাটকে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে কালিদাস এটিকে ঐতিহাসিক রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন বলেই মনে হয়। কারণ দুটি প্রধান চরিত্র অগ্নিমিত্র এবং পুষ্পমিত্র খ্রিস্টপূর্ব যুগের দু’জন শুঙ্গবংশীয় নরপতি ছিলেন। তবে নাটকের অপরাপর চরিত্র কিংবা ঘটনার সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। কাহিনীটি এরূপ—বিদর্ভের রাজ্যভ্রষ্ট রাজা মাধবসেন স্বীয় ভগিনী মালবিকাকে বিদিশাধিপতি অগ্নিমিত্রের হস্তে সমর্পণের উদ্দেশ্যে তাকে বিদিশায় প্রেরণ করলে পথিমধ্যে তিনি দস্যুহস্তে আক্রান্ত হন। বিদিশার সেনাপতি বীরসেন তাঁকে দস্যুহস্ত থেকে উদ্ধার করে রাজমহিষী ধারিণীর পরিচালিকা রূপে নিযুক্ত করেন। অগ্নিমিত্র মালবিকাকে কারারুদ্ধ করেন। বিদষকের সহায়তায় রাজা অগ্নিমিত্র মালবিকাকে কারাগার থেকে উদ্ধার করেন। ওদিকে রাজ্যচ্যুত মাধবসেনও রাজ্য পুনঃপ্রাপ্ত হন। মহিষী ধারিণী মালবিকার প্রকৃত পরিচয় অবগত হয়ে স্বেচ্ছায় অগ্নিমিত্রের সঙ্গে তার বিবাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
কাব্য-বিচার : সেকালের সংস্কৃত নাটক সাধারণত যে-রূপ হত, কালিদাসের নাটক ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’ তারই প্রতিনিধিস্থানীয়। তাৎকালিক নাট্যরীতি-বিষয়ে কিছু মূল্যবান তথ্যনির্দেশ এতে পাওয়া যায়। বিষয়বস্তুর বিচারেও তৎকালে যে রাজকীয় প্রেমই নাটকের প্রধান বিষয় এবং প্রচুর বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়েই নায়ক-নায়িকার মিলন সাধিত হত—সেই গতানুগতিকরীতিরই সম্ভবত সূত্রপাত ঘটেছিল এখানে। প্রেমই নাটকের মুখ্য উপাদান; গভীর জীবন-দর্শনের প্রতি নাট্যকার কিংবা নায়ক-নায়িকার কোনো আগ্রহ নেই, তবে তৎকালিক রাজ-অন্তঃপুরের প্রতি কিছু তির্যক দৃষ্টির পরিচয় রেখে গেছেন নাট্যকার কালিদাস। নাটকটি সম্বন্ধে ড. সুশীলকুমার দে মন্তব্য করেছেন, ‘It is a light-hearted comedy of court life in five acts, in which love is a pretty game and in which the hero need not to be of heroic proposition, nor the heroine anything but a charming and attractive maiden.”। ‘মালবিকাগ্নিমিত্র ‘কে কালিদাসের প্রথম নাটক বলে মনে করা হলেও এতে অপরিপক্কতার বিশেষ কোনো পরিচয় নেই।
২। বিক্রমোর্বশীয় : বিক্রমোর্বশীয় একটি পঞ্চাঙ্ক ব্রোটক। ব্রোটক অর্থাৎ সঙ্গীতবহুল মিলনান্তক নাটক। কালিদাস রচিত দ্বিতীয় নাটক।
কাহিনী: শিবপূজান্তে কৈলাস থেকে প্রত্যাবর্তন-পথে অপ্সরা উর্বশী দৈত্যহস্তে যখন নিপীড়িতা, তখন সূর্যপূজাত্তে প্রত্যাবৃত রাজা পুরুরবা তাকে দেখতে পেয়ে দৈত্যহস্ত থেকে উদ্ধার করেন। অতঃপর গন্ধর্বরাজ চিত্ররথ রাজা পুরুরবাকে সংবর্ধিত করেন। বিদায়কালে নানা ছলে উর্বশীর পুরুরবার প্রতি দৃষ্টিপাতে তাঁদের পরস্পরের অনুরাগ সৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। এর পর পুরুরবা ও উর্বশীর সাক্ষাৎ এবং পত্রালাপে সেই অনুরাগ ঘনীভূত হয়ে প্রেমে পরিণত হয়। এদিকে স্বর্গে সরস্বতী বিরচিত ‘লক্ষ্মীস্বয়ম্বর’ নাটকে উর্বশীকে লক্ষ্মীর ভূমিকায় অভিনয় করতে বলা হয়েছে। অভিনয়কালে পুরুরবার প্রেমতন্ময় উবশী ‘পুরষোত্তম’ বলতে গিয়ে তৎস্থলে ‘পুরুরবা’ উচ্চারণ করে ফেল্লে আচার্য ভরত তাঁকে অভিশাপ দিলেন যে স্বর্গে তাঁর স্থান হবে না। অবশ্য দেবরাজ ইন্দ্র সেই অভিশাপকেই বরে পরিণত করে আশ্বাস দিলেন যে, পুরুরবা পুত্রমুখ দেখতে না পাওয়া পর্যন্ত উর্বশী মর্ত্যলোকে পুরুরবার সঙ্গেই বাস করবেন। এরপর একদা পুরুরবা উর্বশী সহ যখন কৈলাসশিখরে গন্ধমাদন বনে বিহার করছিলেন তখন উর্বশী কার্তিকেয়ের জন্য সংরক্ষিত কুমারবনে প্রবেশ করেন—কিন্তু এখানে স্ত্রীলোকের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। সেই নিষেধ অমান্য করায় উর্বশী সেখানে লতায় পরিণত হলেন। রাজা পুরুরবা উন্মত্তের মতো উর্বশীকে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। অকস্মাৎ সেখানে একটি মণি কুড়িয়ে পেলে দৈববাণী হল যে ঐ মণির সাহায্যেই তিনি তাঁর হারানো প্রেমিকাকে খুঁজে পাবেন। বস্তুত সেই মণি হাতে নিয়ে কৌতূহলভরে তিনি একটি লতাকে স্পর্শ করতেই সেই লতা উর্বশীতে রূপান্তরিত হল। যথাসময় রাজা পুরুরবা পুত্রমুখ দর্শন করলেন, ফলে উর্বশীর শাপমোচন হওয়াতে তাঁর স্বর্গে ফিরে যাবার সময় উপস্থিত হল। তার যখন আয়োজন চলেছে এবং পুরুরবা স্থির করেছেন যে তিনি পুত্র আয়ুকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করে স্বয়ং বনে গমন করবেন, তখন নারদ এসে জানালেন যে রাজাকে বনে যেতে হবে না, দেবাসুর যুদ্ধে তাঁকে দেবতাদের সহায়তা করতে হবে এবং উর্বশীকে পুরুরবার সহধর্মিণী রূপে থাকবার আদেশ দিয়েছেন।
কাব্য বিচার : ঋগ্বেদে, ব্রাহ্মণ সাহিত্যে, মহাভারতে এবং বিভিন্ন পুরাণে পুরুরবা উর্বশী কাহিনী বর্ণিত হলেও কালিদাস তাকে নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছেন। তিনি মূলত বিষাদান্তক কাহিনীটিকে মিলনান্তক করেছেন এবং নানাবিধ কাল্পনিক ঘটনার সন্নিবেশ ঘটিয়ে কোথাও কোথাও রূপকথার আমেজ নিয়ে এসেছেন। সমগ্র কাব্যটিতে উল্লেখ করার মতো নাট্যগুণের চেয়ে এর কাব্যগুণই অধিকতর দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। বিশেষত ‘বিক্ৰমোবশীয়’ নাটকের চতুর্থ অঙ্কে নাটকীয়তা কিংবা ক্রিয়মানতা তেমন কিছু না থাকা সত্ত্বেও এর প্রকৃতিচিত্রণ এবং কবিত্বই একে উন্নত মহিমা দান করেছে। ড. সুশীল কুমার দে বিশেষভাবে এই অঙ্কটি বিষয়ে অভিমত প্রকাশ করেছেন, “The fourth act on the madness of Pururabas is unique in this sense. The scene is hardly dra matic and has no action, but it reaches an almost lyric height in depicting the tumultuous ardour of undisciplined passion. It is a fantasy in soliloquy… The whole scene is melodramati cally conceived… The stanzas are charged with exuberance of emotion and play of fancy…” আরও একদিক থেকে ‘বিক্রমোবশীয়’ নাটকের বিশেষ মূল্যবত্তা স্বীকার করতে হয়—এটি সেকালের বিচারে একমাত্র গীতিনাট্য এবং এতেই পাওয়া যায় অপভ্রংশ ভাষায় রচিত কতকগুলি গান, যাকে উক্ত ভাষার সর্বপ্রাচীন নিদর্শন রূপে গ্রহণ করা হয়। এ বিষয়ে ড. সুকুমার সেন লিখেছেন, “বিক্রমোরশীয় কালিদাসের (এবং সমগ্র প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের) একমাত্র গীতিনাট্য। (অবশ্য একালের সংজ্ঞা অনুসারে নয়, একালের কথ্যভাষায় গানের গীতিনাট্যে নিকটতম প্রাচীন নাট্যনিবন্ধ হিসাবে।) সেকালের কথ্যভাষায় গানের সবচেয়ে পুরাতন এবং খাঁটি নিদর্শন ‘বিক্রমোর্কশীয়’র চতুর্থ অঙ্কেই পাইতেছি। এই গানগুলি অপভ্রংশ ভাষায় সবচেয়ে পুরানো নিদর্শনও বটে।”
৩। অভিজ্ঞানশকুন্তলম্ : ঐতিহ্যক্রমে শ্রুত, ‘ভারত’ দেশটির নামকরণ হয়েছে যার নামে সেই ভরত-জননী শকুন্তলার কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছে মহাকবি কালিদাসের নাটক ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ অথবা ‘শকুন্তল’। একদা সম্রাট্ দুষ্মন্ত মৃগয়া-ব্যপদেশে কণ্বমুনির আশ্রম-সীমান্তে উপনীত হলে মহর্ষির শিষ্যদ্বয়ের আমন্ত্রণে আশ্রমের আতিথ্য গ্রহণ করেন। কণ্বমুনি তখন আশ্রমে উপস্থিত ছিলেন না, তাঁর পালিতা কন্যা শকুন্তলার প্রতি অতিথি সৎকারের ভার অর্পিত ছিল। সম্রাট দুষ্মন্ত শকুন্তলার অসামান্য রূপ-লাবণ্য-দর্শনে মোহিত হয়েছিলেন; তারপর যখন জানতে পারলেন যে শকুন্তলা ঋষিকন্যা নন, তার মাতা অপ্সরা এবং পিতা ক্ষত্রিয়, তখন তাঁর মনস্কামনা পূর্তিতে কোনো বাধা রইলো না। তিনি মহর্ষির অজ্ঞাতেই শকুন্তলাকে গান্ধবমতে বিবাহ করে আশ্রমের রাক্ষস উৎপাত নিবারণের উদ্দেশ্যে কয়েকদিন তথায় অবস্থান করেন। প্রতিশ্রুত হন রাজধানীতে পৌঁছেই যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে শকুন্তলাকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবেন। অতঃপর প্রত্যাশিত কালপূর্ণ হলেও দুষ্মন্তের প্রেরিত কোনো বার্তা কিংবা লোক না আসায় শকুন্তলা দুষ্মন্তের চিন্তায় যখন তন্ময় ছিলেন, তখন একদিন সাতিশয় কোপপরায়ণ ঋষি দুর্বাসা আতিথ্য কামনায় কথ-কুটির দ্বারে স্বীয় আগমন ঘোষণা করলেও তন্ময়তাবশত শকুন্তলা সে বিষয়ে অবহিত হতে পারেন নি। ক্রুদ্ধ দুর্বাসা শকুন্তলাকে অভিশাপ দিলেন, যার চিন্তায় সে এমন তন্ময় হয়ে আছে, তিনি সময়কালে শকুন্তলাকে চিনতে পারবেন না। শকুন্তলা এই অভিশাপের কথা কিছু জানতে না পারলেও তার সখীদ্বয় সমস্ত শুনতে পেয়ে তৎক্ষণাৎ ছুটে এসে ক্রুদ্ধ ঋষিকে মিষ্টবাক্যে তুষ্ট করলে ঋষি জানালেন, শকুন্তলা যদি কোনো অভিজ্ঞান দেখাতে পারেন, তবেই রাজা তাকে চিনতে পারবেন। তখন সখীদ্বয় নিশ্চিন্ত হলেন এই ভেবে যে দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে অভিজ্ঞানস্বরূপ যে মুদ্রাঙ্কিত অঙ্গুরীয় দিয়ে গেছেন, তাঁর সাহায্যেই শাপমোচন হতে পারে। ইতিমধ্যে কণ্বমুনি আশ্রমে ফিরে এসে ধ্যানযোগে শকুন্তলা-বিবাহের সংবাদ জানতে পেরে আশ্রমবাসিনী গৌতমী এবং দুই শিষ্যসহ শকুন্তলাকে রাজধানীতে দুষ্মন্তের নিকট পাঠিয়ে দিলেন। দুর্বাসার অভিশাপ প্রভাবে শকুন্তলা আত্মপরিচয় দান সত্ত্বেও দুষ্মন্ত তাঁকে চিনতে পারলেন না। শকুন্তলা তখন অভিজ্ঞান-অঙ্গুরীয় দেখাতে গিয়ে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করলেন যে অঙ্গুরীয়টি কখন কোথায় হারিয়ে গেছে, তা তিনি টেরও পাননি। অতএব দুষ্মন্ত তাঁকে গ্রহণে অস্বীকৃত হয়ে তাঁকে আপাতত দুষ্মন্তের পুরোহিত-গৃহে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিলেন–কথা হল, শকুন্তলা যদি রাজচক্রবর্তীর লক্ষণযুক্ত পুত্র প্রসব করেন, তবেই তাঁকে গ্রহণ করা হবে। কিন্তু পুরোহিত-গৃহে গমনকালে এক জ্যোতি শকুন্তলাকে তুলে নিয়ে যায়। এদিকে একদিন এক ধীবর এক মৎস্যের উদর থেকে রাজনামাঙ্কিত অঙ্গুরীয় পেলে তা রাজসকাশে নিয়ে যাওয়া হয়। এই অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয় থেকে রাজা দুষ্মন্তের শকুন্তলা-সম্পর্কিত সমস্ত কথা স্মরণে আসে। তখন অনুশোচনা ছাড়া রাজার আর কিছু করণীয় ছিল না। কিছুকাল পর ইন্দ্রের আহ্বানে স্বর্গরাজ্যে গিয়ে দুষ্মন্ত দেবতাদের যুদ্ধে সহায়তা করে প্রত্যাবর্তন-পথে মহামুনি মারীচের আশ্রমে উপনীত হন। তথায় সর্বসুলক্ষণযুক্ত এক বালককে দেখে তাঁর হৃদয় বাৎসল্যরসে পরিপূর্ণ হয়। এখানেই আকস্মিকভাবে তিনি জানতে পারলেন যে এই শিশু তাঁরই পুত্র এবং শকুন্তলার সঙ্গে এখানেই তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে। পরে ইন্দ্রের রথে তাঁরা স্বরাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেন।
মহাভারতে বর্ণিত শকুন্তলা কাহিনী: পুরু-বংশীয় রাজা দুষ্মন্ত এবং শকুন্তলা-কাহিনী ‘মহাভারতে’র আদি পর্বে সংক্ষেপে বর্ণিত হয়েছে। একদা নৃপতি দুষ্মন্ত মৃগয়ায় বহির্গত হলে পথভ্রান্ত অবস্থায় মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে উপনীত হন। কম্ব তখন আশ্রমে অনুপস্থিত ছিলেন এবং তাঁর পালিতা কন্যার ওপর ছিল অতিথি-সংকারের দায়িত্ব। অতএব রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়ে তাঁর রূপ লাবণ্যে মুগ্ধ হলেন। অধিকন্তু শকুন্তলা প্রমুখ্যাত্ তাঁর জন্ম-বৃত্তান্ত জানতে পেরে বুঝতে পারলেন যে এই ক্ষত্রিয়-কন্যাকে বিবাহে কোনো বাধা নেই। অতএব তিনি শকুন্তলার সঙ্গে গান্ধর্ব বিবাহের প্রস্তাব করেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন, শকুন্তলার পুত্রই ভবিষ্যতে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হবে। এই শর্তে উভয়ের বিবাহ হল এবং যথাসময়ে তাঁদের পুত্র সর্বদমন ভরতের জন্ম হল। তার নয় বৎসর বয়সে শকুন্তলা তাকে নিয়ে রাজসকাশে উপনীত হলে লোকনিন্দার ভয়ে রাজা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। তখন এক দৈববাণীতে রাজাকে আদেশ করা হয়, তিনি যেন তাঁর পরিণীতা স্ত্রী এবং বৈধ পুত্রকে গ্রহণ করেন। অতঃপর রাজা স্ত্রী এবং পুত্রকে গ্রহণ করলেন এবং লোকলজ্জার কথাটাও স্বীকার করলেন। ‘পদ্মপুরাণে’ও দুষ্মন্ত শকুন্তলার কাহিনী রয়েছে, তবে সেই কাহিনী কালিদাসের অনুসরণে রচিত বলেই অনুমান করা হয়। ‘কট্ঠ জাতকে’র কাহিনীতে অভিজ্ঞান-রূপে অঙ্গুরীয় ব্যবহারের উল্লেখ আছে, কালিদাস অভিজ্ঞানের ইঙ্গিতটি এখান থেকে নিতে পারেন। মহাভারতের যে কাহিনীটি এখানে বর্ণিত হল, তা দিয়ে বড় জোর একটি কাহিনী হতে পারে, এতে কোনো ‘মহাকাব্য’ কিংবা ‘নাটক’ রচনার মতো উৎকৃষ্ট উপাদানের অভাব রয়েছে। কালিদাস স্বীয় প্রতিভা-নৈপুণ্যে শুধু অনসূয়া-প্রিয়ংবদার মতো সখীই নয়, এক আশ্চর্য বনভূমি, এক অতিশয় তাৎপর্যময় অভিশাপ, অভিজ্ঞান অঙ্গুরীয়ের অপ্রাপ্তি ও পুনঃপ্রাপ্তির অবতারণা প্রভৃতির সাহায্যে বিভিন্ন দৃশ্য-সংস্থানের সংযোজনা করে এক পরম স্বাদু ও উপাদেয় নাটক রচনা করেছেন। মহাভারতের সঙ্গে ‘শকুন্তলা’র পার্থক্য কোথায় এবং কোন কোন দিক থেকে এটি বিশিষ্টতা অর্জন করেছে, এ বিষয়ে অধ্যাপক জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তী লিখেছেন, “কাহিনীটুকুই মাত্র মহাভারত হইতে গৃহীত। অন্যান্য ঘটনার অবতারণায়, কাহিনী-বিন্যাসে ও নূতন নূতন চরিত্র-সৃষ্টিতে কালিদাস স্বতন্ত্র। মহাভারতে শকুন্তলা নিজেই দুষ্মন্তের নিকট আত্মপরিচয় দিয়াছেন, কণ্বমুনির আশ্রমেই তাঁহার সন্তান প্রসূত হইয়াছে, তিনি সন্তান সহ দুষ্মন্তের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন এবং দুষ্মন্ত সকল কথা স্মরণ করিয়াও স্মরণ করিতে পারিতেছেন না, তবু দৈব আদেশে শকুন্তলাকে গ্রহণ করিয়াছেন। কালিদাসে এ সকল ঘটনা নাই; কালিদাসে শকুন্তলা দুষ্মন্তের প্রণয়ের দূতী অনসূয়া-প্রিয়ংবদা সখীদ্বয়—তাঁহারাই রাজার নিকট শকুন্তলার জন্মবৃত্তান্ত ইঙ্গিতে প্রকাশ করিয়াছেন; শকুন্তলার পুত্র প্রসূত হইয়াছে প্রত্যাখ্যানের পর ভগবান্ মারীচের আশ্রমে, দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার শেষ মিলনও ঘটিয়াছে সেইখানে। সর্বোপরি কালিদাসের মৌলিক সৃষ্টি দুর্বাসার অভিশাপ। এই অভিশাপের ফলে রাজার মোহ বিভ্রান্তি ঘটিয়াছে, পূর্বপ্রণয়ের কোনো কথাই স্মরণ করিতে পারেন নাই; এই অভিশাপ শকুন্তলাকেও বিষয়াভিজ্ঞ করিয়া তুলিয়াছে। মহাভারতে শকুন্তলা বহুভাষিণী ও বিষয়বুদ্ধিসম্পন্না। কিন্তু কালিদাসের শকুন্তলা চিরআরণ্যক ও সরলা।” নাটকীয়তা সৃষ্টিতেও এই দুর্বাসার অভিশাপ একটা প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে, কারণ এটি না হলে শকুন্তলা প্রত্যাখ্যাত হতেন না এবং অভিশাপের আগুনে দগ্ধ হয়েই যে জৈব প্রেম শাশ্বত প্রেমে উত্তীর্ণ হল— ভারতীয় প্রেমের এই মহত্ত্বও প্রস্ফুটিত হবার অবকাশ পেতো না। আবার অভিশাপের জন্যই নদীগর্ভেই শকুন্তলার হাত থেকে রাজমুদ্রাঙ্কিত অঙ্গুরীয় পড়ে গেল এবং পুনঃপ্রাপ্তি উপলক্ষেই ষষ্ঠ অঙ্কে dramatic relief পরিকল্পিত হয়েছে তা থেকে পাঠক-দর্শক বঞ্চিত হতেন যদি দুর্বাসার অভিশাপ না থাকতো। সর্বোপরি, দুর্বাসার অভিশাপ রাজা দুষ্মন্তকে কামুকতার অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দান করে।
শকুন্তলা : শ্রেষ্ঠত্ব ও কাব্যবিচার : কোনো প্রাচীন সাহিত্যমোদী স্বীকার করেছেন, ‘কাব্যেষু নাটকং রম্যম, তত্র রম্যা শকুন্তলা। তস্যাপিচ চতুর্থোহঙ্কো যত্র যাতি শকুন্তলা।।’ অপর একজন বলেছেন, ‘কালিদাসস্য সর্বস্বম অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’। সব মিলিয়ে বলা চলে, কালিদাসের শ্রেষ্ঠ রচনা শুধু নয় ‘অভিজ্ঞানশকুন্তল’, একটি শ্রেষ্ঠ কাব্যও বটে। এ বিষয়ে বিদেশীয়দের অভিমতও যাচাই করা চলে। সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী জার্মানীর গ্যয়টে এই শকুন্তলা সম্পর্কে যা বলেছেন, তার বক্তব্যের ভাবানুবাদ – “প্রভাতের ফুল আর বর্ষশেষের ফল যদি কেউ একত্রে দেখতে চান, যা মুগ্ধ করে, যা প্রসন্ন করে, যা তুষ্টি এবং পুষ্টি আনে তা যদি একত্রে পেতে চান, একটা নামে যদি স্বর্গ ও মর্ত্যকে মেশাতে চান তাহলে, শকুন্তলা, আমি তোমারই নাম করছি, আর তা হলেই সব কথা বলা হয়ে যায়।” এবং একালের শ্রেষ্ঠ প্রাচ্য মনীষী রবীন্দ্রনাথ বলেন, “প্রথম অঙ্কবর্তী সেই মর্ত্যের চঞ্চল সৌন্দর্যময় বিচিত্র পূর্বরাগ হইতে স্বর্গতপোবনে শাশ্বত আনন্দময় উত্তরমিলনে যাত্রাই অভিজ্ঞান শকুন্তলা নাটক।”
কালিদাসের নাটক-বিচার প্রসঙ্গে একটা কথা স্মরণ রাখা কর্তব্য। যেভাবে আধুনিক নাটক বা পাশ্চাত্যের নাটকের বিচার-বিবেচনা করা হয়, আলোচ্য ক্ষেত্রে সেই মানদণ্ড গ্রহণযোগ্য নয়। নাটকের বস্তুনিষ্ঠ, ঘটনা সংঘাত, নাটকীয়তা বা ক্রিয়মানতা আদির পরিবর্তে প্রাচীন ভারতীয় নাটকে ভাবাবেগ এবং রসসৃষ্টিকেই নাটকীয় উৎকর্ষের পরাকাষ্ঠা মনে করা হত। কালিদাসের শকুন্তলা নাটক সেদিক দিয়েই বিচার্য। বিশেষত এর চতুর্থ অঙ্কে প্রকৃতির যে সজীবতা এবং প্রকৃতির সঙ্গে মানব-হৃদয়ের যে অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ বন্ধন ও কবিত্বশক্তির সঙ্গে কবির গার্হস্থ্যজীবনবোধ ও পরিমিতিবোধের যে পরিচয় দিয়েছেন এবং বিভিন্ন চরিত্রসৃষ্টিতে যে স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করেছেন, তাতে ভারতীয় নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে কালিদাসের ‘শকুন্তলা’কে এক অপূর্ব সৃষ্টি বলেই অভিহিত করতে হয়। ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলা’ নাটকের বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন, “নাটকীয়তার বিচারে অবশ্য পঞ্চম অঙ্কই শ্রেষ্ঠ, কিন্তু চতুর্থ অঙ্কে ‘শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা’র যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তার কথা কোনো পাঠক কখনও ভুলতে পারেন না। চরিত্র-সৃষ্টিতে কালিদাস দেখিয়ে দিয়েছেন, এক একটি চরিত্র যেন ফুলের পাপড়ির মতো ক্রমশ বিকশিত হয়ে উঠেছে। নাটকে কোথাও অতিনাটকীয়তা নেই, এর স্বচ্ছন্দগতি সর্বদাই অব্যাহত। ভাবপরায়ণতা কিংবা ক্রিয়াশীলতার মধ্যেও কবি কখনও সংযমের রাশ আলগা হতে দেন নি। সর্বোপরি কবির রচনা-রীতির অপূর্বতা আগাগোড়া নাটকটিকে মার্জিত রাখতে সহায়তা করেছে।”
Leave a comment