প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যে সকল গুণের কারণে কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীকে শ্রেষ্ঠ কবিরাপে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে তাঁর চরিত্র সৃষ্টির নৈপুণ্যকে অন্যতম হিসেবে গ্রহণ করা হয়। মনীষী সমালোচকদের অনেকেই মন্তব্য করেছেন যে, কবিকঙ্কণ একালে জন্মগ্রহণ করলে সম্ভবত কবি না হ’য়ে ঔপন্যাসিক হতেন। উপন্যাসে যে সকল উপাদান ও লক্ষণ বর্তমান, তাদের মধ্যে ব্যক্তি চরিত্রের বিকাশ অন্যতম। যে কোনো কাহিনীতে কিছু চরিত্র থাকেই, কিন্তু সেই সকল চরিত্রের সম্যক্ বিকাশ সাধিত হয় না বলেই সেগুলি উপন্যাস হয়ে উঠতে পারে না। কবিকঙ্কণ রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে কবি সার্থক চরিত্র সৃষ্টির মতো দুর্লভ গুণটি আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন বলেই তাঁকে ঔপন্যাসিকের তুল্য মর্যাদা দান করা হয়। এই সার্থক চরিত্র সৃষ্টির পক্ষে লেখকের যে দু’টি গুণ অত্যাবশ্যক, তা হল বাস্তবনিষ্ঠা এবং নির্মমতা। নির্মমতা বলতে কী বোঝায়, সে-বিষয়ে অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন, “বাস্তবনিষ্ঠার সঞ্চারী ভাব নির্মমতা। আধুনিক ঔপন্যাসিক নিজের নাক বরাবর চলিতে কৃতসঙ্কল্প, তার ফলে তাহাকে যেখানে লইয়াই ফেলুক না কেন, তাহার দুঃখ নাই— ইহাকে বলি নির্মমতা। মমত্ববুদ্ধি, রুচি, অভিপ্রায়কে সংযত করিয়া লেখক বাস্তব সংসারকে অনুসরণ করিতেছে, সংসারের বাস্তব ধর্মকে ধরিবে এই তাহার পণ… কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে বাস্তব-নিষ্ঠা ও নির্মমতা প্রচুর পরিমাণে বিরাজমান।”

কালকেতু সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ একটি নিষ্ঠুর মন্তব্য ক’রে তাকে একটি ‘বিকৃত বৃহৎ স্থানুমাত্র বলে উল্লেখ করেছেন। সম্ভবত কবিকঙ্কণ পৌরাণিক আদর্শে কালকেতুকে একটি অসাধারণ বীর-রূপে অঙ্কন করতে গিয়ে তার সম্বন্ধে যে সকল অতিশয়োক্তি করে গেছেন তাতেই অসহিষ্ণু হ’য়ে রবীন্দ্রনাথ এই মন্তব্যটি করেছিলেন। নতুবা, কালকেতু জীবনের সমস্ত ঘটনা বিশ্লেষণ ক’রে দেখলে তার সম্বন্ধে সহানুভূতি না জাগবার কথা নয়। চরিত্রটি যে একেবারে অকর্মণ্য হয়ে উঠেছে, কিংবা দীর্ঘ-জীবন-পরিক্রমায় তার কোনো বিকাশ ঘটেনি, এমন কথা বলা চলে না।

কালকেতু শাপভ্রষ্ট দেবতা পূর্বজন্মে সে ছিল ইন্দ্র-পুত্র নীলাম্বর। মর্ত্যলোকে দেবী চণ্ডীর পূজা প্রচার করবার জন্যই তাকে মর্ত্যলোকে ব্যাধগৃহে জন্ম নিতে বাধ্য করা হয়। মানবজীবনে কালকেতুর পিতা ধর্মকেতু ব্যাধ এবং মাতা, নিদয়া। গ্রন্থের নায়ক কালকেতু, অতএব গ্রন্থকার তদুচিতভাবে শৈশব থেকেই তৈরি করে নিয়েছেন। সেকালের অথবা প্রাচীনতর আদর্শ অনুযায়ী কবি নায়ক কালকেতুকে পৌরাণিক বীরদের মতো করে এবং বিশেষভাবে মহাকাব্যের ভীমের মতো করেই গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন। এই চেষ্টার ফলে কালকেতু শৈশবেই অসাধ্য সাধন করতে আরম্ভ করে। কিন্তু এর ফলটি আমাদের কালের পরিপ্রেক্ষিতে খুব শুম্ভ বলে বিবেচিত হয় না, কারণ বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে চরিত্রটি বিশ্বাসযোগ্যতা হারায়। যেমন—দু’তিন বছর পার হতেই ‘ভল্লুক শরভ ধরি কালকেতু খেলে।’ কালকেতুর দৈহিক বর্ণনায়ও কবি পৌরাণিক উপমা গ্রহণ করেছেন—

‘কপাট বিশাল বুলে    নিন্দি ইন্দীবর মুখ

আকর্ণ দীঘল বিলোচন।

গতি যিনি গজরাজ    কেশরী জিনিয়া মাঝ

মোতি পাতি জিনিয়া দশন।।’

শৈশবেই কালকেতু অপরিসীম দৈহিক শক্তির অধিকারী হয়, এরই ফলে সহজেই সে শিশুদের মধ্যে মণ্ডলের পদ লাভ করে। খেলায়ও সে সকলের ওপরে –

‘যে জন আঁকড়ি ধরে    পড়য়ে ধরণী পরে

ভয়ে কেহো নিকট না হয়।’

মনে হয়, কালকেতু অল্প বয়সেই শক্তিমান হয়ে ওঠায় তার অভিভাবকগণ বিয়ের জন্য চিন্তিত হ’য়ে ওঠেন (ঘটক সোমাই ওঝা যোগ্য পাত্রীর উদ্দেশ্যে সঞ্জয়কেতুর ঘরে গিয়ে কালকেতুর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন—

‘কার করে দশম বৎসরে মাতা হাতী।

অর্জুন সমান যার ধনুকের খ্যাতি।।’

অতএব দশ বৎসর বয়সে অর্জুন-তুল্য খ্যাতিমান হয়ে ওঠা কালকেতু বিয়ে করলো সঞ্জয়কেতুর কন্যা ফুল্লরাকে। কবি এখানে বিবাহের যে বর্ণনা দিয়েছেন, আশঙ্কা হয়, ব্যাধজীবনের সঙ্গে কবির সম্ভবত কোনো প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল না। একেবারে উচ্চবর্ণের বিরহের অনুরূপ ক্রিয়াকাণ্ড ব্যাধসস্তানের বিবাহে প্রত্যাশিত নয়। এর প্রমাণ পাওয়া যাবে, কালকেতুর চণ্ডীমন্দির প্রতিষ্ঠাকালে স্বয়ং সংশয় প্রকাশ করেছে তার প্রতিষ্ঠিত দেবতার পূজায় কোনো ব্রাহ্মণ হয়তো আসবে না। ব্যাধসমাজের সঙ্গে এই অপচিয়ের ফলেই কবি কালকেতুর শৈশব ও কৈশোর জীবনের চিত্র অঙ্কনে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে কাজে না লাগিয়ে পুরাণ মহাকাব্যের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, যার ফলে চরিত্রটি অনেকাংশে অবাস্তব হয়ে উঠে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে। অথচ কবি পুরাণকে অনুসরণ না করে যখন বাস্তব ব্যাধসস্তানের সাদৃশ্যে কালকেতুর চিত্র অঙ্কন করেন, তখন তা’ কত স্বাভাবিক হ’য়ে ওঠে–

‘শিশুগণ সঙ্গে ফিরে    শশারু তাড়িয়্যা ধরে

দূরে গেলে ছুবায় কুকুরে।

বিহঙ্গে বাট্যুলে বধে    লতাএ সাঁড়ি পদে

কান্ধে ভার বীর আস্যে ঘরে।।’

যাহোক, কালকেতু-ফুল্লরার বিবাহের পর তাদের সংসারে প্রতিষ্ঠিত ক’রে দিয়ে তার পিতামাতা কাশীবাসী হন, ফলে সংসারের সমস্ত ভার এসে পড়ে কালকেতুর ওপর। ব্যাধসস্তান কালকেতুর জীবিকা নির্বাহের উপায়–শিকার। এই শিকার করতে গিয়ে কালকেতু বনের পশুদের মধ্যে মহা ত্রাসের সৃষ্টি করে। কবি এখানেও কালকেতুকে মহাভারতের বীর অর্জুনের সঙ্গে তুলনা ক’রে দেখিয়েছেন

‘অনুদিন পশু বধে বীর মহাবল।

কুরুরাজ সেনা যেন বধে বৃহন্নল।।’

শুণ্ডে ধরি মগজ আছাড়িয়া মারে মাতঙ্গেরে। দত্ত উপাড়িয়া বীর আনে বোঝা ভারে।।

চুবড়ি মেলয়ে দণ্ড বেচেন ফুল্লরা। 

কৃষাণে যেমন দেই মূলার পশরা।।’

বনের পশুদের ওপর কালকেতুর এই অত্যাচারের পর পশুরা সিংহের কাছে গিয়ে তাদের দুর্দশার বিবরণ দিলে সিংহ কালকেতুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সেই যুদ্ধে পশুরা পরাজিত হয়, পশুরাজ সিংহ দেবীর বাহন বলে কালকেতুর হাত থেকে মৃত্যু এড়াতে পারলো

‘দেবীর বাহন বলি নাহি মারে বীর।

প্ৰাণ পায়্যা সিংহ গিয়া পান কৈল নীর।’

যে কালকেতু অবহেলায় হাতিকে শুঁড়ে ধরে আছাড় মারতে পারে এবং সিংহকে অক্লেশে করে পরাজিত, তার ভোজনের চিত্রও অনুরূপ হওয়া চাই। বীরত্বে যিনি অর্জুন, ভোজেতে তিনি ভীম—মহাভারতের দুটি বিরাট পুরুষের চরিত্রকে কবি মেলাতে চেয়েছেন কালকেতুর মধ্যে। তার আহারের বর্ণনা

‘মোচড়িয়া গোঁফ দুটা বান্ধি ঘাড়ে।

এক শ্বাসে সাত হাঁড়ি আমানি উজাড়ে….

চারি হাড়ি মহা বীর খায় খুদ-জাউ। 

ছয় হাড়ি মুসুরী সুপ মিশ্যাই তথি লাউ।।

ঝুড়ি দুই তিন খায় আলু ওল পোড়া।

কচুর সহিত খায় করঞ্জা আমড়া।।’

এভাবে এক অস্বাভাবিক ভোজন পর্ব সমাধানের পর সম্ভবত হাস্যরস সৃষ্টির জন্যই লিখলেন—

‘শয়ন কুৎসিত বীরের ভোজন বিটকাল।

ছোট গ্রাস তোলে যেন তেয়াটিয়া তাল।।’

বক্তৃত এখানেই কালকেতুর বাস্তব রূপটি ধরা পড়েছে।

কালকেতুর অত্যাচারে বনের পশুরা অতিষ্ঠ হয়ে দেবী চণ্ডীর কাছে তাদের দুঃখ নিবেদন করলো। পশুদের বিলাপে অত্যাচারী কালকেতুর যে রূপটি ধরা পড়ে তাতে কালকেতুকে অত্যাচারী ডিহিদার মামুদ সরীফেরই দ্বিতীয় সংস্করণ বলে বোধ হয়। কবি এখানে হয়তো কালকেতুকে বীরধর্মে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যই তাকে উৎপীড়ক শাসক-রূপে উপস্থাপিত করেছেন এবং সম্ভবত এর পশ্চাতে অত্যাচারী শাসকের স্বরূপ উদ্‌ঘাটনই ছিল কবির মনস্তত্ত্বে—কিন্তু কালকেতুর চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা তার এই অত্যাচারের একটি মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ দিতে বাধ্য। কালকেতুকে এখানে যে নিষ্ঠুর অত্যাচারী রূপে দেখানো হয়েছে, এটিকে তার স্বভাবধর্মরূপে চিহ্নিত করা যায় না। তার সংসার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব রয়েছে এবং তার ভোজন-সামগ্রীর প্রয়োজনও অপরিমিত অথচ আর্থিক দিক থেকে সে অতিশয় দুর্বল, অসহায়। তার এই অভাব পূরণ করবার প্রয়োজনেই তাকে পরাক্রান্ত শক্তিমানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হ’তে হয়। পরবর্তীকালে কালকেতুর যখন আর কোনো অভাব রইল না, তখন সে তার প্রজাদের প্রতি যে সহানুভূতির পরিচয় দিয়েছে, তাতে তার হিতব্রতী মনোভাবেরই পরিচয় পাওয়া যায়।

এরপর পশুসন্ধানে বনে গিয়ে কালকেতু সুবর্ণগোধিকারূপিণী দেবী চণ্ডীকে ঘরে নিয়ে এসে বাসি মাংসের পশরা নিয়ে হাটে চলে গেলো। ইতিমধ্যে দেবী গোধিকা বেশ পরিহার ক’রে ষোড়শী মূর্তি ধারণ করেন। ফুল্লরা ঘরে এই মূর্তি দেখে বিস্ময় মনে যখন তার পরিচয় জিজ্ঞেস করে, তখন তিনি বলেন, ‘আনিয়াছে তোর স্বামী বান্ধি নিজ গুণে। ফুল্লরা ব্যাপারটা ফরসালা করবার জন্য হাটে গেল। তাকে দূর থেকে দেখেই কালকেতু বুঝতে পারলো, একটা কিছু অঘটন ঘটেছে, তাই জিজ্ঞেস করে

‘শাশুড়ি ননদী নাই নাই তোর সতা। 

কার সনে দ্বন্দ্ব করি চক্ষু কৈলি রাতা।’

জবাবে যখন ফুল্লরা আবার জিজ্ঞেস করে—

‘কাহার ষোড়শী কন্যা আনিয়াছ ঘরে।’

শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে কালকেতু তার চরিত্রে দোষারোপ করায় তাই সে ক্রুদ্ধ হাঁয়ে জানায় যে ফুল্লরার অভিযোগ মিথ্যা হল ‘চিয়াড়ে কাটিব তোর নাসা। কালকেতুর এই আচরণ অবশ্যই ব্যাধোচিত। এরপর দেবী আত্মপরিচয় দিলেও যে কালকেতু তা বিশ্বাস করতে পারে না, তার সহজ ব্যাখ্যা—সাধারণ লোকে দেবীকে দশভুজারূাপে দেখতেই অভ্যস্ত। শাস্ত্রজ্ঞানহীন কালকেতুর পক্ষে দেবীর এত পরিচয় না জানাই সম্ভব। এরপর দেবী-প্রদত্ত ধন নিয়ে কালকেতুর পেছন পেছন যখন দেবীও চলতে থাকেন তখন মাঝে মাঝে কালকেতু পেছন ফিরে তাকাচ্ছে—

‘মনে মনে মহাবীর করয়ে যুকতি। 

ধন ঘড়া লৈয়া পাছে পালায় পার্বতী।।’

বিধি ধন দান করেছেন অযাচিতভাবেই, তার যে ধন নিয়ে পালানোর কোনো প্রয়োজন হয় না, এই সহজ সত্যটুকু বোঝবার মতো বুদ্ধিও ছিল না নির্বোধ ব্যাধসস্তান কালকেতুর। এটিকেও তার ব্যাধোচিত সারল্যের পরিচয় বলেই বিশ্বাস করতে হয়।

দেবী-প্রদত্ত মাণিক্যের অঙ্গুরী নিয়ে কালকেতু মুরারি শীলের বাড়ি গেলে আংটি দেখে মুরারি শীল স্রেফ ধাপ্পা দিয়ে বলে ‘সোনা রূপা নহে বাপা এ বেঙ্গা পিতল’—অতএব মুরারি এর মূল্য নির্ধারণ করলো অষ্টপণ পাঁচ গণ্ডা (সোয়া আট আনা)। কিন্তু এর প্রতিবাদ করবার মতো আত্মবিশ্বাসও কালকেতুর ছিল না। তাই শুধু সে বলে,

‘কালকেতু বলে খুড়া মূল্য নাহি পাই। 

যে জন দিয়াছে দ্রব্য তার ঠাই যাই।।’

যাহোক অঙ্গুরী বিক্রয় ক’রে কালকেতু প্রচুর ধনের অধিপতি হয়ে বিরুনিয়া দিয়ে গুজরাট বন কাটিয়ে নগর পড়ুন করলো। গুজরাট নগর পড়নের মধ্য দিয়ে কালকেতুর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিচক্ষণতার পরিচয় পাওয়া যায়। কালকেতু যে রাজ্য স্থাপন করেছিল তা’ যত ছোটই হোক্ না কেন, তা যদি স্বয়ম্ভর না হয়, তবে কোন না কোন ভাবে অপরের অধীনতায় আসতে হয়। তাই একটি রাজ্যকে সম্পূর্ণভাবে আত্মনির্ভরশীল করবার জন্য যত শ্রেণীর লোক এবং বৃত্তি ও ব্যবসাজীবীর প্রয়োজন কালকেতু তাদের সবাইকে তার রাজ্যে যথোচিত সমাদরে স্থান দান করলো। এমন কি নানা জাতির মুসলমানও সাগ্রহে কালকেতুর রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করে। এ যেন একটি প্রাচীন গ্রীক নগররাষ্ট্রের প্রতিরূপ। নানা শ্রেণীর লোকের মধ্যে বিশেষভাবে কৃষকপ্রজাদের যে সকল সুবিধাদানের প্রতিশ্রুতি কালকেতু ঘোষণা করেছিল, তা’ অতিশয় প্রশংসার যোগ্য। পশুকুলের প্রতি অত্যাচার যে তার স্বভাবজাত নয়, শুধুই প্রয়োজনের তাগিদে, তার পূর্ণ সমর্থন পাওয়া যায় এখানে প্রজাদের প্রতি তার সহানুভূতিতে।

কালকেতু সার সত্য বুঝেছিল, যে রাজ্যে প্রজার প্রতি অবিচার হয়, যেখানে প্রজার থাকে অভিযোগ, সে রাজ্য কখনো স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না। তাই প্রজাদের নানাপ্রকার সুযোগ সুবিধা দানের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে কালকেতু বুঝিয়ে দিলেন যে সে স্বভাব-অত্যাচারী নয়, তার প্রথম জীবনের দুষ্ক্রিয়া ছিল জীবন রক্ষার প্রয়োজনেই। পরিবেশ পরিবর্তনের ফলে কালকেতুর চরিত্রও যুগোপযোগী রূপে বিকাশ লাভ করেছে। ভাড়ুদত্ত প্রজা এবং হাটুরিয়াদের ওপর অত্যাচার করলে কালকেতু ভাড়দত্তকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেন, ভাঁড়ুদত্ত কলিঙ্গরাজকে কালকেতুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত ক’রে যুদ্ধে সম্মত করায়। সেই যুদ্ধে কলিঙ্গ রাজা পরাজিত হ’লেও ভাড়ুর তাড়ায় আবার ফিরে এলে কালকেতু সমস্যায় পড়ে গেল। ফুল্লরা বলে

‘হারিয়ে যে জন যায়    পুনরপি আইসে তায় 

হেতু কিছু আছয়ে বিশেষ।’

ফুল্লরার যুক্তিতে কালকেতুর বুদ্ধিনাশ ঘটলো, সে কাপুরুষের মতো প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে ধনঘরে আত্মগোপন করলেন। কিন্তু ভাঁড়ুর কৌশল এবং ফুল্লরার নির্বুদ্ধিতায়, কালকেতু ধরা পড়ে কলিঙ্গ রাজার সভায় নীত হ’য়ে যে আত্মপরিচয় দান করলো, তাতে দেবী চণ্ডীর প্রতি অসাধারণ শ্রদ্ধা পেলেও তা’ ব্যাধের স্বভাবসঙ্গত হয়নি। তার আত্মপরিচয়—

‘গুজরাটে নিবসি নিবাস চণ্ডীপুর।

আমার রাজ্যের রাজা মহেশ ঠাকুর।।’ 

আমি বটে মহাপাত্র চণ্ডী অধিকারী।

তার তেজ ধরি আমি তার আজ্ঞাকারী ।।’

কারাগারে প্রেরিত কালকেতুর শোকার্ত আকৃতিটি উল্লেখযোগ্য। সে বলে

‘মাংস বেচি ছিনু ভাল    এবে সে পরাণ গেল 

বিবাদ সাধিল কাত্যায়নী।।’

যাহোক, চণ্ডীর কৃপায় কালকেতু মুক্তি পেল এবং শেষ পর্যন্ত পুত্র পুষ্পকেতূর হাতে রাজ্যভার সমর্পণ ক’রে (সম্ভবত মাত্র কুড়ি বৎসর বয়সে) শাপমুক্তিহেতু আবার সে যথাস্থানে অর্থাৎ স্বর্গে ফিরে যায়।

কবিকঙ্কণ যদি ব্যাধ-জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হতেন, তবে কালকেতু চরিত্রে এত অসঙ্গতি দেখা দিত না এবং চরিত্রটি আরও স্বাভাবিক এবং বলিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারতো। হয়তো বা তাহ’লে রবীন্দ্রনাথেরও অনুযোগ করবার প্রয়োজন ঘটতো না।