উত্তরঃ কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত ‘কালকেতু উপাখ্যান’ মধ্যযুগের আর আর মঙ্গলকাব্যের মধ্যে সাধারণ হয়েও অসাধারণ। গ্রন্থটি বহুল আলোচিত ও পঠিত। শিবের স্ত্রী পার্বতী (চণ্ডী) পূজো পেতে চায়। স্বর্গের নীলাম্বর শিবকে দেয় ফুলের মধ্যে কীট থাকায় নীলাম্বর শাপগ্রস্ত হয়ে ব্যাধ ধর্মকেতুর ঘরে কালকেতু হয়ে জন্ম নেয়। তার স্ত্রী ছায়া সঞ্জয়কেতুর ঘরে ফুল্লরা হয়ে জন্ম নেয়। কালকেতু বনের মধ্যে পশুদের সাথে খেলতে খেলতে বড় হয় এবং শক্তিশালী ব্যাধে পরিণত হয়। ফুল্লরার সাথে তার পরিণয় হয়। কালকেতুর অত্যাচারে বনের পশু অতিষ্ঠ। দেবী চণ্ডী পশুদের বনে লুকিয়ে থাকতে পরামর্শ দেয়। কালকেতু শিকারে গেলে দেবী স্বর্ণগোধিকার ছদ্মরূপ নিয়ে কালকেতুর কাছে ধরা দেয়। কালকেতু তাকে বাড়িতে রেখে বাজারে যায়। দেবী মানবী মূর্তি ধারণ করে কালকেতুকে মূল্যবান অঙ্গুরি এবং সাত ঘড়া ধন দেয়। ধন পেয়ে দেবীর কথামত নব নগর পত্তন করে এবং দেবীর পূজা প্রচার করে। শেষ পর্যন্ত পুত্র পুষ্পকেতুর হাতে রাজ্য তুলে দিয়ে কালকেতু ও ফুল্লরা স্বর্গে চলে যায়।
সংক্ষিপ্ত এ উপাখ্যানের মধ্যে কবির বিশেষ পারমঙ্গতায় গ্রন্থটি মঙ্গলকাব্যের মধ্যে অনন্য হয়ে আছে। কাব্যটিতে মধুর ও প্রশংসনীয় ভাষায় সুনিপুণভাবে সমাজ-গৃহস্থালির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
সে যুগে সমাজের নর-নারীর সুখ-দুঃখ, বেদনা-ব্যর্থতা এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন। তখনকার সামাজিক রীতি-নীতি, বৃত্তি-ব্যবসা, আচার-অনুষ্ঠান, ধর্ম- কর্ম এমনভাবে তিনি তুলে ধরেছেন যে বাস্তবতার কারণে অনেকে তাকে মধ্যযুগের ঔপন্যাসিক বলতে চান, আর কালকেতু উপাখ্যানকে বলতে চান মধ্যযুগের উপন্যাস। কবি ব্যক্তিজীবনে জমিদার কর্তৃক যে লাঞ্ছিত হয়েছেন তার সম্যক চিত্র ‘পশুগণের ক্রন্দন’ অংশের ‘সিংহীর কাছে অন্য পশুর আবেদন’ অংশে চিত্রিত হয়েছে। তাতে কবির রাজনৈতিক সচেতনতা মেলে। কালকেতু গুজরাটে যে নগর পত্তন করে তাতে সকল ধর্ম-বর্ণের লোক সমাগমের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ভাবনা উচ্চকিত হয়েছে। ‘কালকেতু’ উপাখ্যানের শ্রেষ্ঠ গুণ চরিত্র চিত্রণে। মুরারীশীল ও ভাড়দত্ত লেখকের তুলির এক বা দু পোঁচে আঁকা যে চরিত্র তা মধ্যযুগের সীমানা পেরিয়ে আজও মানুষের মুখে মুখে। বারমাসির বর্ণনা অতুলনীয়ই কেবল নয়, ব্যতিক্রমীও। কেননা ফুল্লরা তার স্বামীকে দোষারোপ করে নি। তদুপরি বারো মাসে ফুল্লরার যে দুঃখের বর্ণনা—তাতে অনেকেই কবিকে দুঃখবাদী কবি বলে আখ্যায়িত করেন।
স্বল্পকথায় বাকপ্রতিমা নির্মাণ ‘কালকেতু উপাখ্যানে’ শিল্পীর অনন্য বৈশিষ্ট্য—
১। শিয়রে কলিঙ্গরাজ বড় দুরাচার।
তোমারে বধিয়া জাতি লইবে আমার—
২। ধর্মকেতু দাদা সনে কৈলু লেনাদেনা।
তাহা হৈতে ভাইপো হৈয়াছ সেয়ানা—
৩। খুড়া তিন গোটা শর ছিল একখান বাঁশ।
হাটে হাটে ফুল্লরা পসরা দিত মাস—
৪। খুড়া তুমি হৈলে বন্দী অনুক্ষণ আমি কান্দি।
৫। গ্রাসগুলি তোলে যেন তে-আটিয়া তাল—
৬। সোনা রূপা নহে বাপা এ বেঙ্গা পিতল।
ঘসিয়া মাজিয়া বাপু করেছ উজ্জ্বল—
কাহিনী, চরিত্রচিত্রণ, ভাষা, বারমাস্যা বর্ণনা- বিবিধ গুণে মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘কালকেতু উপাখ্যান’ মঙ্গলকাব্য হয়েও আধুনিক সমাজ বাস্তবতাধর্মী শিল্পের মর্যাদা পেয়েছে।
Leave a comment