গ্রাম্য জীবনের সঙ্গে, দারিদ্র্যের সঙ্গে কবিকঙ্কণ যে খুবই ঘনিষ্টভাবে পরিচিত ছিলেন তা ‘কালকেতুর ভোজন’ ও হাস্যরসিকতায় স্বতন্ত্র ‘কালকেতুর সমীপে ভাঁড়ু দত্তের আগমন’ অংশে প্রকট। এই দুই অংশের রচনা মুকুন্দরামকে সুদক্ষ শিল্পীর পরিচয়ে পরিচিত করেছে।

কালকেতুর ভোজন- 

“শয়ন কুৎসিত বীরের ভোজন বিটকাল। 

ছোট গ্রাস তোলে যেন তেয়াটিয়া তাল।।”

মুকুন্দরাম নির্মল শুদ্ধ সংযত হাস্যরসের সৃজন ঘটিয়েছেন কালকেতুর ভোজনে বসার বর্ণনায়—

“মোচড়িয়া গোঁফ দুটি বান্ধিলেন ঘাড়ে। 

একশ্বাসে সাত হাড়ি আমানি উজাড়ে।। 

চার হাড়ি মহাবীর খায় খুদ জাউ। 

ছয় হান্ডি মুসূরী সৃপ মিশ্যাই তথি লাউ৷৷ 

ঝুড়ি দুই তিন খায় আলু ওল পোড়া। 

কচুর সহিত খায় করঞ্জা আমড়া।।”

এরপরও কালকেতু বলে—

“রন্ধন কর্যাছ ভালো আর কিছু আছে।”

ফুল্লরা বলে একটা হরিণ দিয়ে পরিবর্তে সে এক হাঁড়ি দই এনেছিল গোয়ালার ঘর থেকে। সেই দই দিয়ে কালকেতু তিনহাড়ি ভাত খেল।

ভোজন কালে কালকেতুর গলায় ঘরঘর শব্দ হয়। যখন কোমরের কোসি খসায় তখন মনে হয় যেন ধানের মরাই থেকে মোটা কাছি খুলে দেওয়া হল। খাওয়া শেষে আচমন করে বীর কালকেতু হরিতকি দিয়ে মুখশুদ্ধি করে শয়ন করে।

খাদ্যের পরিমাণের বাহুল্য থাকলেও যে সব উপকরণে তার খাদ্য প্রস্তুত হয়েছে, তা একান্তভাবেই ব্যাধ জীবনেরই উপযোগী। পান্তাভাত, আমানী, খুদের জাউ, মুসুরীর সুপ, বনজাত ওল কচু আলু আমড়া করমচা ব্যাধের সংসারে অতি পরিচিত বস্তু। শিকারী হরিণ বা বেঁজির মাংসও সুলভ। তাই কালকেতুর ভোজন পর্ব বর্ণনা অবান্তর বলে মনে হয় না।

কালকেতুর নিকট ভাঁড়ু দত্তের আগমন : মুকুন্দরাম চক্রবর্তী কালকেতুর ভোজন পর্বের পাশে পাশেই কালকেতুর নিকট ভাঁড়ুদত্তের আগমন অংশে হাস্য পরিহাসের পরিবেশ করেছেন। কালকেতুর দরবারে ভাঁড়ু দত্তের প্রবেশ ঘটে এইভাবে—

“ভেট লয়্যা কাঁচকলা    পশ্চাতে ভাঁড়ুর শালা

আগে ভাঁড়ু দত্তের পয়াণ। 

ভালে ফোটা মহাদম্ভ    ছেঁড়া ধুতি কোঁচালম্ব

শ্রবণে কলম খরশান।।”

কারো বাড়িতে কাঁচকলা আনা এবং তা নিজের শালাকে দিয়ে বহন করানোর মধ্যে হাস্যরসের প্রবাহটি ফুটে উঠেছে। কালকেতু গুজরাট নগরীর অধীশ্বর হওয়ায় ভাঁড়ু দত্ত ঈর্ষান্বিত হয়েছিল। ভাঁড়ু দত্ত কালকেতুর রাজ্যে উপস্থিত হয়ে তাকে শেখাতে লাগল কি করে রাজ্য চালাতে হয়। রাজ্য চালান সহজ কথা নয়। কাজেই মণ্ডলের পদটি যেন তাকেই দেওয়া হয়। এই বাক্যোচ্চারণের মধ্য দিয়ে মুকুন্দরাম বুঝিয়েছেন ভাঁড় দত্ত কত ধূর্ত। ভাঁড়ু দত্তের মুখে শোনা যায়—

“দেহ মোরে সর্বভার    তারবালা আদি হার

তুমি থাক নিশ্চিন্তে নিশ্চয়। 

বহু প্রজা বসাইব   এক ছাইয়া পত্র লব

বন্দে বন্দে যেন প্রজারয়।।”

তদুপরি সর্বপ্রকার তোষামদ সহ যেন-তেন প্রকারেন ভাঁড়ুর ক্ষমতা লাভের প্রচেষ্টাটি এখানে প্রকাশিত হয়ে ভাঁড়ু চরিত্রের নীচতাকে উন্মাচিত করেছে।

ভাঁড়ু দত্ত প্রথমেই কালকেতুর সঙ্গে খুড়া-ভাইপো সম্পর্ক পাতিয়ে নিজের পরিচয় দিয়েছে এভাবে—

“দুই নারী মোর ধন্যা    ঘোষ বসুর কন্যা

মিত্রে কৈল কন্যা-সমর্পন।

গঙ্গার দুকুল কাছে    যতেক কুলীন আছে 

মোর ঘরে করয়ে ভোজন।।”

কালকেতু সসম্মানে ভাঁড়ু দত্তকে গ্রহণ করল। ভাঁড়ু প্রথম থেকেই কালকেতুকে কুমন্ত্রণা দিতে থাকল, কি করে বেশি প্রজা কাজে লাগিয়ে কম শস্য ভাগ দিয়ে ভাগিয়ে দেওয়া যায়। এমন কি হাটে পশারীদের কাছে থেকেও ভেট নিত। ভাঁড়ুকে দেখলে তাই পশরীরা পশরা ঢাকা দিত। কালকেতু ভাঁড়ুর প্রতি ক্ষুদ্ধ হয়। ভাঁড়ু তাকে ভর্ৎসনা করে, কালকেতুর অতীত ইতিহাসের কথা সবাইকে জানিয়ে তার সম্মান হানি ঘটাতে চেয়েছে—

“তিন গোটা শর ছিল এক গোটা বাঁশ। 

হাটে হাটে ফুল্লরা পশরা দিত মাস।।”

কালকেতু আর সহ্য না করতে পেরে তার রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দিল। যেতে যেতে ভাঁড় বলে যায়—

“হরিদত্তের বেটা হই জয়দত্তের নাতি,

হাটে লয়্যা বেচাইব বীরের ঘোড়া হাতি।। 

তবে সুশাসিত হবে গুজরাট ধরা,

পুনর্ব্বার হাটে মাংস বেচিবে ফুল্লরা।”

শেষ পর্যন্ত দেখা গিয়েছিল যে অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে ভাঁড়ু কালকেতুর সমীপে এসেছিল তার পরিণতি হয়েছিল মারাত্মক কালকেতুর ইশারায় নাপিত ঘোড়ার মূত্র দিয়ে মাথা ভিজিয়ে ভোঁতা ক্ষুর দিয়ে মাথা চেঁচে দিয়ে পাঁচ স্থানে চুল রেখে গালের একদিকে চুন ও অপর দিকে কালি দিয়ে সারা গ্রাম ঘোরায় ভাঁড়ুকে। কেউ কেউ তাকে মারধরও করে এমন কি বধূরাও। মুকুন্দরাম এই ভাঁড়ু দত্ত চরিত্রের মধ্য দিয়ে যে হাসকৌতুক সৃষ্টি করেছেন, তা বড়ই মনোরম, এবং একজন অসৎ মানুষ কেমন হয় এবং তার শেষ পরিণতি কি হয় তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন।

পরিশেষে বলতেই হয় ‘কালকেতুর ভোজন’ ও কালকেতুর নিকট ভাঁড়ু দত্তের আগমন অংশ দুটি রচনা করে মুকুন্দরাম তাঁর বাস্তবতাবোধ এবং কাব্যগুণের অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছেন। হয়ত মুকুন্দরাম বলেই একাজ সম্ভব হয়েছে। কবি বাস্তবের আঙিনায় দাঁড়িয়ে চরিত্র সৃষ্টিতে সত্যিই অবিস্মরণীয়।