কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী সম্বন্ধে সুধী সমালোচকগণ যে সকল মন্তব্য প্রকাশ করেছেন, তাতে একটি বিষয়ে সকলেই অভিন্নমত যে কবি মুকুন্দ ছিলেন বাস্তব রসের কারবারী। বক্তৃত সুক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তির সহায়তায় তিনি সমাজ-জীবনকে খুব ভালো করেই চিনেছিলেন এবং তাকে যথাযোগ্যভাবেই তার চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে উপস্থাপিত করেছেন। এই কারণেই বাস্তবতা তাঁর কাব্যে এত স্বাভাবিকভাবেই ধরা পড়েছে। কিন্তু এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হ’বে, কবিকঙ্কণ ছিলেন মধ্যযুগের কবি, সেকালের বাস্তবতাবোধ এবং একালের বাস্তবতাবোধের মধ্যে একটি উপলব্ধি-গত পার্থক্য রয়েছে। সমকালের পাঠকেরা রামায়ণ-মহাভারত-আদি কাব্য পাঠে তাদের অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন নায়ক-নায়িকাদের যে সমস্ত যুগের পরিচয় পেয়েছেন, আলোচ্য কাব্যের নায়ককে অস্তত তার কাছাকাছি আনতে না পারলে সেই পাঠকদের কাছে তা অতিশয় ‘জলো’ বা তরল বলে মনে হবে। এই কারণেই, মুকুন্দ কবিকেও চণ্ডীমঙ্গল কাব্য সমকালের অপরাপর কাব্যের সমতালে চলতে হয়েছে। তাই তার বাস্তব চিত্রেও কিছুটা অতিকৃতি লক্ষ্য করা যায়। তবে তাতে প্রকৃতি চিত্রটি চাপা পড়েনি।
গ্রাম জীবনের সঙ্গে, দারিদ্র্যের সঙ্গে কবিকঙ্কণ যে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন,” তাও এই ভোজনচিত্রে প্রকট। দরিদ্র গ্রামবাসীদের ভোজ্যবস্তুর উপাদান এবং তাদের রন্ধনপ্রণালীও কবির যথেষ্ট পরিচিত, তারও পরিচয় পাওয়া যায় আলোচ্য বর্ণনায়। সাধারণভাবে বলা যায় এদের খেটে খেতে হয় বলেই দৈহিক পরিপুষ্টির কারণে ভোজনের পরিমাণটা বেশ বেশিই হ’য়ে থাকে। সাধারণ নগরবাসীর নিকট এদের ভোজন ব্যাপারটি হাস্যকর বলে মনে হতে পারে। ভোজনের পরিমাণ বেশি হলেও ভোভ্যবত্ব কিংবা ভোজ্যপাত্রাদি যে অতি নিম্নমানের এবং স্বল্পমূল্যের তা থেকেই এদের আর্থিক দুর্গতির চিত্রটিও স্পষ্ট ফুটে ওঠে।
সর্বশেষ বলা যায় – এখানে কবির হাস্যরস সৃষ্টির একটি সচেতন প্রচেষ্টার পরিচয় বর্তমান, যা প্রকৃতিতেও অভিব্যক্ত হয়েছে। ভোজন পর্ব বিশ্লেষণে এই সব বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যাবে।
ব্যাধসস্তান কালকেতু ‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে’র আখেটিক খণ্ডের নায়ক। কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী চণ্ডীমঙ্গল কাব্য রচনা করতে গিয়ে নায়ক কালকেতুকে একটি প্রকৃত বীরের মূর্তিতে উপস্থাপিত করেছেন। মুকুন্দ কবি যেকালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেকালে সমাজে খলচরিত্র লোকের অভাব না থাকলেও সম্ভবত প্রকৃত বীরের দর্শন ছিল সুদূর্লভ। তাই খল চরিত্র সৃষ্টিতে কবি বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণ শক্তিকে কাজে লাগাতে পারলেও আদর্শ বীর-চরিত্র অঙ্কনে তাঁকে প্রধানত কল্পনা-শক্তির ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। কবির কল্পনাশক্তি খুব প্রবল ছিল না; তাই কালকেতুর চিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে তিনি পুরাণের সহায়তা গ্রহণ করেছিলেন বলেই মনে হয়। বিশেষত চণ্ডীর মাহাত্ম্য ব্যাপক বলেই একটি পৌরাণিক পরিবেশ এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে, সম্ভবত এই কারণেই তিনি কালকেতুর রূপগুণ বর্ণনাতেও অনেকাংশে পুরাণের সহায়তা গ্রহণ করেছেন। বীরত্বের ক্ষেত্রে কবি কালকেতুকে অন্যত্র অর্জুনের সঙ্গে উপমিত করেছেন কিন্তু ভোজনের ক্ষেত্রে অর্জুনের পারদর্শিতার কথা জানা না থাকায় সম্ভবত কবির চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল বীর বৃকোদরের চিত্রটি, কারণ বৃকোদর ভীমের ভোজনরসিক বলে বেশ খ্যাতি রয়েছে।
পৌরাণিক ভীমের ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক ভোজন-পটুতা মানিয়ে গেলেও ব্যাধসস্তান কালকেতুর ক্ষেত্রে অনুরূপ ভোজন অস্বাভাবিক বলেই মনে হয়। অবশ্য সাধারণের তুলনায় কালকেতুর ভোজনে কিছুটা আতিশয্য থাকতেই পারে, কিন্তু এখানে ভোজন প্রসঙ্গে কবি কালকেতুর যে চিত্র অঙ্কন করেছেন, তাকে কোনক্রমেই স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া যায় না। তবে এ কথা সত্য, এই চিত্রটি আঁকতে গিয়ে কবি যেমন কালকেতুর প্রচণ্ড বলশালিতা বোঝাতে চেষ্টা করেছেন, তেমনি কালকেতুর ভোজন প্রসঙ্গে কবি ইচ্ছাকৃতভাবেই যে কিছুটা হাস্যরস সৃষ্টিরও চেষ্টা করেছিলেন, এ-কথাও অস্বীকার করা যায় না। আর একটি কথা – কবি এখানে খাদ্যের পরিমাণ নিয়েই অতিশয়োক্তি করেছেন, কিন্তু খাদ্যের উপকরণ-ব্যাপারে তিনি যে মোটামুটিভাবে বাস্তবতার অনুগামী ছিলেন, তাও স্বীকার করতে হয়।
প্রতিদিন সকালে কালকেতু শিকারে বের হয়, সারা বন ছুঁড়ে শিকার করে শ্রস্ত হ’য়ে বীর ঘরে ফিরে আসে। কালকেতুর সাড়া পেয়েই ফুল্লরা তাড়াতাড়ি করে তার বিশ্রামের জন্য হরিণের চামড়া বিছিয়ে দেয়। তারপর তার হাতমুখ ধোবার জন্য নারকেলের মালায় করে জ এগিয়ে দেয়। কালকেতু হাতমুখ ধোবার ফাকে ফুল্লরা খাবার ঠাঁই করে দেয়। কালকেতু খেতে বসে, ফুল্লরা তার সামনে পেতে দেয় মাটির থালা (মাটিয়া পাথরা) আর ব্যঞ্জনের জন্য দেয় নতুন মাটির বাটি (খাপরা)।
বীর তার অতি বৃহৎ গোঁপ জোড়া পিছনে টেনে নিয়ে ঘাড়ে বাঁধে, তারপর হাঁড়ি বোঝাই জলসহ পান্তাভাত (আমানি) চুমুক দিয়ে খায় – নিঃশেষে শেষ হয়ে যায় সাত হাঁড়ি আমানি। এরপর চার হাঁড়ি খায় খুদের জাউ আর ছয় হাঁড়ি লাউ দিয়ে রান্না করা মুসুরীর সুপ। কালকেতুর পরবর্তী খাদ্য আলু আর ওল পোড়া—এরও পরিমাণ দু’তিন ঝুড়ি। এর পর করমচা আর আমড়া দিয়ে খায় কচু (সম্ভবতঃ গলা চুলকানোর আশঙ্কাতেই ওল এবং কচুর সঙ্গে অম্লজাতীয় আমড়া করমচার ব্যবহার)। এইসব নিরামিষ আহারের পর মাংসের ব্যবস্থা। গোটা বাঁশ পুড়িয়ে ফুল্লরা হরিণ মাংসের ঝোল রান্না ক’রে দিয়েছে, এ ছাড়া দশ গণ্ডা বেজি পুড়িয়ে রেখেছিল। কালকেতু এ সকলি খেয়ে অম্বল খেলো। এরপর বলে কালকেতু—
‘রন্ধন করাছ ভাল আর কিছু আছে।’
আরো কিছু? হ্যা, তাও আছে। ফুল্লরা বলে যে একটা হরিণ দিয়ে তার পরিবর্তে সে এক হাঁড়ি দই এনেছিল গোয়ালার ঘর থেকে— সেই দই দিয়ে কালকেতু তিন হাঁড়ি ভাত খেলো।
ভোজন কালে কালকেতু গলায় ঘর ঘর শব্দ হয়, যখন কোমরের কসি খসায়, তখন মনে হয় যেন ধানের মরাই থেকে মোটা কাছি খুলে দেওয়া হ’ল। খাওয়া শেষে আচমন ক’রে বীর কালকেতু হরীতকী দিয়ে মুখশুদ্ধি ক’রে নিশাকালে শয্যায় শয়ন করে।
খাদ্যের পরিমাণে বাহুল্য থাকলেও যে সব উপকরণে তার খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত হয়েছে, তা একান্তভাবেই ব্যাধজীবনেরই উপযোগী। পাস্তাভাত বা আমানি, খুদের জাউ, মুসুরীর সুপ, স্বচ্ছন্দবনজাত আলু, ওল, কচু, আমড়া বা করমচা সহজেই ব্যাধের সংসারেও থাকতে পারে। শিকারে হরিণ বা বেজীও কালকেতুর পক্ষে দুষ্প্রাপ্য নয়, কাজেই এ-সব খাদ্যসামগ্রীতে কোনো বিলাসিতার পরিচয় নেই–ব্যাধের ঘরে দইটাই শুধু বেমানান। কিন্তু এ ক্ষেত্রে এটিও স্বাভাবিক, কারণ ফুল্লরা হরিণের বদলে দই এনেছে। কাজেই কালকেতুর ভোজনপর্বে পরিমাণের কথাটি বাদ দিলে এটিকে আর অবাস্তব মনে হয় না।
Leave a comment