‘কালকেতুর উপাখ্যানে’ বর্ণিত যে কোন দুইটি ঘটনার সাহায্যে কবিকঙ্কণের গল্পরস ও কৌতুক সৃষ্টির দক্ষতার পরিচয় দাও।
কবি মুকুন্দের ‘চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে’ হাস্যরস ও লঘু কৌতুক যে নিদর্শন পাওয়া যায়, তার পরিচয় দাও।
আধুনিক পূর্ব যুগের বাংলা সাহিত্যে নির্মল শুভ্র হাস্যরসের পরিচয় আমরা পাইনে বল্লেই চলে। বস্তুতঃ রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রকে যে জাতীয় নির্মল শুভ্র হাসারসের স্রষ্টা বলে স্বীকৃতি জানিয়েছেন, সে জাতীয় হাস্যরস আধুনিক যুগেরই সৃষ্টি। কাজেই প্রাগাধুনিক যুগে এ জাতীয় হাস্যরসের অসদ্ভাব থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা বলে সে যুগের সাহিত্যে প্রভূত উপকরণ থাকা সত্ত্বেও হাস্যরস থাকবে না— এটা হতে পারে না। কাজেই প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যেও নিশ্চিতই কোন না কোন প্রকারের হাস্যরস বর্তমান ছিল এবং সম্ভবতঃ তা ছিল অনেকটা স্থূল এবং অমার্জিত। আমরা কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্য বিশ্লেষণ করলেও হাস্যরসের প্রচুর দৃষ্টান্ত পাই, যার কিছু অংশ স্থূল হলেও অপরাংশ অপেক্ষাকৃত মার্জিত।
আমরা দুঃখে কাঁদি, সুখে হাসি, আবার কৌতুকেও আমরা হেসে থাকি। সুখের হাসি এবং কৗতুকের হাসিতে পার্থক্য রয়েছে যথেষ্ট। রবীন্দ্রনাথ ‘কৌতুহাস্য’ এবং ‘কৌতুকহাস্যের মাত্রা প্রবন্ধ দুটিতে এ বিষয়ে সুন্দর বিশ্লেষণাত্মক মন্তব্য করেছেন। আনন্দের প্রকাশ স্মিতহাস্য এবং আমোদ ও কৌতুকের প্রকাশ উচ্চহাস্যে সে হাস্য যেন একটা দ্রুত আঘাতের পাড়ন বেগে সশব্দে ঊর্ধ্বে উদ্গীর্ণ হইয়া উঠে।” মুকুন্দের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে আমরা উভয়বিধ হাস্যরসের পরিচয় পেয়ে থাকি। তবে, বলাইবাহুল্য আনন্দের হাসি বা সুখের হাসি উচ্ছ্বসিত নয় বলেই তার যথার্থ উপলব্ধির জন্য সূক্ষ্ম অনুভূতির প্রয়োজন—তার বহিঃপ্রকাশ শুধু ওষ্ঠাধর প্রাস্ত বলেই সহজে তাকে বোঝা যায় না। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের জনৈক রস-ভোক্তা সমালোচক কবি মুকুদের হাস্যরসের স্বরূপ বিশ্লেষণ করে লিখেছেন, “…জীবনের প্রতি একটি সর্বাত্মক প্রসন্নতাবোধই তাঁর কাব্যকে একটি অনিন্দ্য সুন্দর বৈশিষ্ট্য দান করেছে। এই প্রসন্নতাবোধের জন্যই দুঃখ দারিদ্র্য উৎপীড়নের বর্ণনা থাকলেও তার কাব্যে হাস্যরসের অভাব ঘটেনি……. জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা, মানবজীবনের প্রতি সর্বব্যাপিনী সহানুভূতি এবং কবিজনোচিত সমদর্শিতার সঙ্গে উচ্ছল হাস্যরসিকতার মিলনেই তাঁর কাব্যে হাস্যরসের ধারা প্রবাহিত হয়েছে। প্রকৃত হাস্যরসিকের মতো তিনি পথভ্রষ্ট, বিকৃতবুদ্ধি দ্বিতীয় শ্রেণীর চরিত্রগুলিকে সমাজ থেকে আহরণ ক’রে তাদের ভ্রান্তি ও বিকৃতিকে এমনভাবে চিহ্নিত করেছেন যে তাদের প্রতি আমাদের কোনো বিদ্বেষ বা বিরূপতা জাগে না, নির্মল হাসির স্রোতে সব বিরূপতা ভেসে গিয়ে তাদের ভ্রাপ্তি বা বিকৃতির জন্য সমবেদনায় মন ভরে ওঠে। তেমনিভাবে কবি দারিদ্র্যপীড়িত মধ্যবিত্ত বাঙালী সমাজের প্রাত্যহিক দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে হাসির ক্ষণিক ঝিলিক দিয়ে দুঃখের তিক্ততাকে কৌতূকের প্রসন্ন কিরণসম্পাতে বাষ্পীভূত ক’রে দিয়েছেন।”
কাব্যে কবি প্রথম হাস্যরস সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন দক্ষযজ্ঞভঙ্গের বর্ণনায় যজ্ঞব্রতী ব্রাহ্মণগণ বীরভদ্র ও তার চেলা-চামুণ্ডাদের হাতে যেভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, তার বর্ণনায় পাঠক কিছুটা আমোদ অনুভব করেন, কারণ এখানে ব্রাহ্মণের কার্যের সঙ্গে তার ফলের অসঙ্গতি রয়েছে—
“যেই জন পালায় দানা ধরিয়া তায়
পড়িয়া উপাড়ে দাড়ি।
ছিণ্ডিল বসন ভাঙ্গিল দশন
স্রুবের মারিয়া বাড়ি।।”
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, অপরের প্রতি নিষ্ঠুরতা অথবা অপরের প্রতি পীড়নের মধ্যে হাস্যরসের উদ্ভব ঘটে থাকে কেন? এ বিষয়ে আবার রবীন্দ্রনাথের পূর্বোক্ত প্রবন্ধ দুটির শরণ গ্রহণ করা চলে : “কৌতূকের মধ্যেও নিয়মভঙ্গজনিত একটা পীড়া আছে; সেই পীড়াটা অতি অধিকমাত্রায় না গেলে আমাদের মনে যে একটা সুখকর উত্তেজনার উদ্রেক করে, সেই আকস্মিক উত্তেজনার আঘাতে আমরা হাসিয়া উঠি… ইচ্ছার সহিত অবস্থার অসঙ্গতি, উদ্দেশ্যের সহিত উপায়ের অসঙ্গতি, কথার সহিত কার্যের অসঙ্গতি— এগুলির মধ্যে নিষ্ঠুরতা আছে। অনেক সময় আমরা যাহাকে লইয়া হাসি সে নিজের অবস্থাকে হাস্যের বিষয় জ্ঞান করে না।… অসঙ্গতি যখন আমাদের মনের অনতিগভীর স্তরে আঘাত করে তখনি আমাদের কৌতুক বোধ হয়, গভীরতর স্তরে আঘাত করিলে আমাদের দুঃখবোধ হয়। স্থূল কথাটা এই যে, অসঙ্গতির তার অল্প অল্প চড়াইতে চড়াইতে বিস্ময় ক্রমে হাস্যে এবং হাস্য ক্রমে অশ্রুজলে পরিণত হইয়া থাকে।” অর্থাৎ মূলত কোনো বিষয়ে অসঙ্গতি দেখা দিলেই তাতে আমরা কৌতুক বা আমোদ অনুভব করি এবং উচ্চ হাস্যে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। নিচে আমরা চণ্ডীমঙ্গল কাব্য থেকে হাস্যরসের যে সকল দৃষ্টান্ত উল্লেখ করবো, তাতে আমরা প্রধানত এই অসঙ্গতি জনিত হাস্যরসেরই পরিচয় পাবো।
স্মিত হাস্যের পরিচয় এই কাবো খুব বেশি পাওয়া যাবে না। একটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত : পার্বতীর তপস্যায় সন্তুষ্ট হ’য়ে মহাদেব যখন তাঁকে বর প্রার্থনা করতে বললেন তখন পার্বতী বলেন—
‘কৃপা করি যদি মোরে দিলা বরদান।
আমার পিতারে নাথ করহ প্রণাম।।’
পার্বতী মহাদেবকেই পতি-রূপে কামনা করেন, কিন্তু সে কথাটি কেমন কৌশলে এখানে প্রকাশ করলেন। অনাদি পুরুষ শিবের পিতা-মাতা বা কোনো প্রণম্য নেই। তিনি পার্বতীর পিতা হিমালয়কে প্রণাম করতে পারেন মাত্র একটি অবস্থাতেই হিমালয়কে যদি তিনি শ্বশুররূপে গ্রহণ করেন। পার্বতীর বুদ্ধিমত্তায় নিশ্চয়ই আমাদেরই মতো মহাদেবের ওষ্ঠপ্রান্তেও স্মিত হাসির রেখা দেখা দিয়েছিল।
শিব-পার্বতীর বিবাহ-উপলক্ষে কবি বেশ কিছু কৌতূকজনক দৃশ্যের অবতারণা করেছেন। মহাদেব যেন ইচ্ছা ক’রেই কিছু রগড় করবার উদ্দেশ্যে এমন বেশে বিবাহ-সভায় উপনীত হয়েছেন, যাতে শাশুড়ি মেনকা শুধু বিরক্তই হয়নি, বিব্রতও হয়েছেন অনেকখানি। পাড়াপড়শি যারা এসেছিলেন তারাও বর দেখে অতিশয় বিরূপ মন্তব্য করেন—
‘বর দেখি আয়াগণ করে কানাকানি।
মরুক কন্যার পিতা চক্ষে পড়ুক ছানি।।
হেন বরে বিভা দিল কি দেখি সম্পদ।
বাপ হৈয়া মুঢ়মতি কন্যা কৈল বধ।।
পবনে দর্শন লড়ে হেন বুড়ো বর।
দেখিয়া মেনকা দেবী জ্বলিল অস্তর।।’
এর পর মেনকা বরণডালা নিয়ে এলেন শিবের কাছে, সেই বরণডালায় ছিল ঈশের মূল—
‘ঈশের মূলের গন্ধে পালায় ভুজঙ্গ।
অঙ্গনার মাঝে হর হৈল উলঙ্গ ।।
লজ্জা পাইয়া মেনকা পালায় তড়বড়ি।
নন্দী বুঝিয়া কাজ নিভায় দেউড়ি।।’
এখানে রসিকতার প্রকৃতি অবশ্যই অতিশয় স্থূল, কিন্তু তৎকালীন গ্রাম্য সমাজে সম্ভবত এ জাতীয় রসিকতারও সমাদর ছিল। যাহোক, এর পরই মদনমোহন রূপ ধারণ করলে যে প্রতিবেশিনীরা শিবের নিন্দা ক’রেছিলেন, তাঁরাই শিবের তুলনায় নিজের নিজের পতির হীনতার কথা চিন্তা ক’রে পতিনিন্দা করতে লাগলেন। এই পতিনিন্দার বর্ণনায় শুধু হাস্যরস নয়, বীভৎস রসেরও সৃষ্টি হয়েছে।
‘এক যুবতী বলে সই গোদা মোর পতি।
কোয়া জ্বরের ঔষধ সদাই পাৰ কতি।।
ভাদ্র মাসের পাঁকই বড় দুরবার।
গোদে তৈল দিতে কত তুলিব ন্যাকার।।’
বিবাহের পর শিব ঘরজামাই হ’য়ে হিমালয়-গৃহেই রয়ে গেলেন। তাদের সংসার বাড়লো মেনকার সংসারে অনটন দেখা দিল। এবং এ নিয়েই কন্যার সঙ্গে কথা কাটাকাটি। মেনকা বলেছিলেন—
‘রাদ্ধি বাড়ি আমার কাকাল্যে হৈল বাত।
ঘরে জামাই রাখিয়া জোগাব কত ভাত।।’
এর প্রত্যুত্তরে যে জগন্মাতা ভগবর্তী উমা কোমরে আঁচল বেঁধে মায়ের সঙ্গে উতোর চাপান চালাবেন, এটি কেউ ভাবতে পারে না বলেই এখানে অসঙ্গতির সৃষ্টি হয়েছে, ফলে পাঠকের নিকট ব্যাপারটি হাস্যকর বলেই মনে হয়। মায়ে-ঝিয়ে ঝগড়ার পরই উমা রাগ ক’রে পতি পুত্র সহ পতিগৃহে কৈলাসে চলে এলেন। মহাদেবের জীবিকানির্বাহের কোনো উপায় নেই বলে তিনি ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করলেন। ভিক্ষা ক’রে ফিরে এসে তিনি ঝুলি ঝেড়ে ভিক্ষালব্ধ বস্তুগুলিকে যখন ঠাই ঠাই ক’রে গুছিয়ে রাখছেন, তখন তার দুই পুত্র কার্ত্তিক আর গণেশ—
‘দেখিয়া মোদক খই দোঁহে আল্যা ধাওয়া ধাই
কোন্দল লাগিল দুই ভাই এ।’
সিদ্ধিদাতা গণেশ এবং দেবসেনাপতি কার্তিকের ভাবমূর্তি জনমানসে এত উজ্জ্বল যে তাদের এই ব্যবহারের সঙ্গে তার সামঞ্জস্যবিধান করা যায় না বলেই এই ঘটনা হাস্যরসের সৃষ্টি করে। যাহোক্, পরদিন প্রভাতে মহাদেব ঘোষণা করলেন যে ঐ দিন তিনি ভিক্ষায় যাবেন না এবং দেবীকে বল্লেন—
‘আজি গণেশের মাতা রান্ধ মোর মতো।
নিমে সীমে বেগুনে রান্ধিয়া দিবে তিত।।’
শুধু এই নয়, তালিকা অতি দীর্ঘ-কুমড়া বেগুন দিয়ে শুক্তো—তাতে নটীয়া কাঠালবীচি, ফুলবড়ি এবং প্রচুর পরিমাণ আদার রস, টাবাজল দিয়ে মুশুরি ডাল, খাঁড় (গুড়) মিশিয়ে করমচার অম্বল, ঘিয়ে ভাজা দুধে ভেজানো ফুলবড়ি, পলতাকুঁড়ি দিয়ে চচ্চড়ি, গুড় দিয়ে ছোলার ডাল, মানের বেসারে কুমড়ার বড়ি কাঠালবীচির তরকারি, ঘৃত জিরা সাঁতলে পালংশাক প্রভৃতি। প্রচুর সময়ের আবশ্যক, অতএব মহাদেব বললেন—
‘ঝাট স্নান কর গৌরী না কর বিলম্ব।’
গৌরী প্রত্যুত্তরে জানালেন—
‘রন্ধন করিতে ভাল বলিলে গোঁসাই।
প্রথমে যে দিব পাতে তাই ঘরে নাই।।’
অন্নপূর্ণার ‘ভাড়ে মা ভবানী’—অতএব উপায়—
‘আজিকার মতো যদি বান্ধা দেহ শূল।
তবে সে আনিতে পারি প্রভু হে তণ্ডুল।।’
এই দাম্পত্যকলহটুকু বড় উপভোগ্য। দেবাদিদেব মহাদেব ভোজ্যবস্তুর তালিকা এবং রন্ধনপ্রণালী বর্ণনা করেছেন, যিনি ভিক্ষা করে সংসার চালাচ্ছেন তিনি দিচ্ছেন বেয়াল্লিশ ব্যঞ্জনের ফরমায়েশ; আদ্যাশক্তি পরমাপ্রকৃতি ভগবর্তী যিনি স্বয়ং অন্নপূর্ণা, তিনি বলছেন যে ঘরে এক বিন্দু চাল নেই এবং তিনি প্রস্তাব দিচ্ছেন যে মহাদেব যেন কামারের ঘরে তাঁর ত্রিশূল বাঁধা দিয়ে চাউলের ব্যবস্থা করেন—গোটা ব্যাপারটার মধ্যেই অসঙ্গতিবোধ এত প্রবল যে এটি অসহায় দরিদ্র ঘরের চিত্র হলেও পাঠকের মন অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে চায়। জনৈক সমালোচকও বলেন, “দেবতার দাম্পত্যজীবনে বাঙালী সংসারের দারিদ্র্যের চিত্র আরোপ ক’রে কবি যে আপাত বৈপরীত্য সৃষ্টি করেছেন, অসম্ভাব্যতার ও অবিশ্বাস্যতার পটভূমিতে তা উতরোল হাস্যের কলমুখরতায় ভেঙ্গে পড়ে।”
কালকেতুর ভোজনের যে তালিকা কবি পরিবেষণ করেছেন, তার আতিশযাও হাস্যরস উদ্রেক করে—
‘মোচড়িয়া গোঁফ দুটা বান্ধিলেন ঘাড়ে।
এক শ্বাসে সাত হাঁড়ি আমানি উজাড়ে।।
চারি হাঁড়ি মহা বীর খায় খুদ-জাউ।
ছয় হাণ্ডি মুসুরী সুপ মিশ্যা তথি লাউ।….
শয়ন কুৎসিত বীরের ভোজন বিট্কাল।
ছোট গ্রাস-তোলে যেন তে-রাটিয়া তাল।।’
কালকেতুকে ছলনা করবার জন্য দেবী সুবর্ণ গোধিকারূপ ধারণ করেছেন। কালকেতু শিকারে ব্যর্থ হ’য়ে শূন্য হাতে যখন ফিরে আসছে, তখন ঐ গোধিকাকেই ধনুকে বেঁধে নিয়ে আসে—
‘চারিপদে বান্ধি বীর ফেলিল ধনুকে।
অভয়া লম্বিত ঊর্ধ্ব-পুচ্ছ হেট-মুখে।।’
এই দুরবস্থার মধ্যেও যখন দেবী ভাবেন—
‘কিন্তু এক হৃদয়ে লাগয়ে বড় ডর।
অপমান কথা পাছে শুনেন শঙ্কর।।’
দেবীর এই করুণ অবস্থাও হাস্যরসের সৃষ্টি করে।
গোধিকারূপিনী চণ্ডী সকলের অসাক্ষাতে ষোড়শী রূপসীর মূর্তি পরিগ্রহ করেন। চমক্তি ফুল্লরা তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে তিনি দ্ব্যর্থবোধক ভাষায় আত্মপরিচয় দিয়ে যখন বলেন—
‘তুমি গো ফুল্লরা যদি দেহ অনুমতি।
এই স্থানে কতেক দিন করিব বসতি।।’
একথা শুনে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ‘হাদে বিষ মুখে মধু’ নিয়ে ফুল্লরা দেবীকে স্বগৃহে ফিরে যেতে পরামর্শ দিয়ে বলে যে সতীনকে নিয়ে ভয় পাবার কোনো কারণ নেই—
‘সতিনী কোন্দল করে দ্বিগুণ বলিবে তারে
অভিমানে ঘর ছাড়া কেনি।
কোপে কৈলে বিষপান আপনি তেজিবে প্রাণ
সতিনের কিবা হবে হানি।।’
দেবী কিছুতেই যখন ঘর ছেড়ে যেতে রাজি হলেন না, তখন ফুল্লরা চল্লো হাটে— স্বামীর সঙ্গে এক পালা ঝগড়া করবার জন্য। এই উপকাহিনীটুকু বড় মনোরম, বড় উপভোগ্য—এখানে পাঠকের মুখে স্মিতহাস্য ফুটে ওটে। যাহোক, শেষ পর্যন্ত দেবী আত্মপরিচয় দিলেন যখন কালকেতু একটি মাণিক্যের অঙ্গুরী দিলেন, তখন—
‘অভয়া দিলেন তারে মাণিক অঙ্গুরী।
লইতে নিষেধ করে ফুল্লরা সুন্দরী।।
একটি অঙ্গুরী নিলে হবে কোন কাম।
সারিতে নারিবে প্রভু ধনের দুর্নাম।।’
ফুল্লরার নির্বুদ্ধিতা এবং প্রকৃত ধনের মূল্যাবধারণের অক্ষমতা আমাদের মৃদু হাসির উদ্রেক করে। কালকেতু যখন ঘোড়া নিয়ে বাড়ি আসে, পিছনে দেবীও আসেন একটি পড়া কাখে নিয়ে, আর থেকে থেকে কালকেতু পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে—দেবী ঘড়া নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছেন কিনা—এই চিত্রটিও আমাদের হাস্যোদ্রেক করে।
মুরারী শীলের কাহিনীতে বেনে মুরারি শীল এবং তার পত্নীর ব্যবহারে যে অসঙ্গতির পরিচয় ফুটে ওঠে, তার রচনায়ও কবি অসাধারণ রসিকতাবোধের পরিচয় দিয়েছেন। স্বল্প পরিসরের মধ্যে কালকেতু ও বান্যানীর কথোপকথন, কালকেতু ও মুরারির কথোপকথন, মুরারির অতিরিক্ত আত্মীয়তা দেখানোর গরজ, কালকেতুকে ঠকানোর চেষ্টা—এ সবের মধ্যে কথায় ও ব্যবহারে যে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে, তার উপভোগ্যতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
গুজরাট নগর পত্তনে নানা জাতির নানা বৃত্তির বহুলোক এখানে বসতি স্থাপন করে— এদের মধ্যে ভালো মন্দ দুই-ই আছে। এদের কারো কারো আচার-ব্যবহার আমাদের দৃষ্টিতে সঙ্গতিপূর্ণ নয় বলেই এখানে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে।
হাস্যরস-সৃষ্টিতে মুকুন্দ কবি সর্বাধিক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন ভাড়ু দত্তের কাহিনী বয়নে। ভাড়ুদত্তের প্রথম আবির্ভাবই উচ্চহাস্য সৃষ্টি করে—
‘ভেট লয়্যা কাচকলা পশ্চাতে ভাড়ুর শালা
আগে ভাঁড়ুদত্তের পয়ান।
ভালে ফোঁটা মহাদস্ত ছেঁড়া ধুতি কোচা লম্ব
শ্রবণে কলম খরসান।।’
তারপর মহা আড়ম্বরে নিজ বংশবিবরণ দিয়ে কালকেতুর রাজসভায় সে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তারপর ভাঁড়ুর অত্যাচারে হাটুরিয়া এবং প্রজারা তার বিরুদ্ধে কালকেতুর নিকট নালিশ করলে কালকেতু ভাঁড়ুদত্তকে ভর্ৎসনা করে, অপমানিত ভাড়ুদত্ত কালকেতুর সভা ছেড়ে কলিঙ্গের রাজসভায় যোগদান করেন। তারি ষড়যন্ত্রে কলিঙ্গ রাজের সঙ্গে যুদ্ধে কালকেতু বন্দী হয়, পরে মুক্তি পেলে ভাডু এসে কালকেতুকে বলে : ‘তুমি খুড়া, হইলে বন্দী, অনুক্ষণ অমি কান্দি/বহু তোমার নাহি খায় ভাত।’ কালকেতু ভাঁডুকে ঠিকই চিনেছিল, তাকে পুনর্বসতি দিলেও তার মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে উপযুক্ত শাস্তিও দিয়েছিল। সকলে এতে প্রাণভরে হাসবার সুযোগ লাভ করে।
Leave a comment