কিরাত নগরে অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থার মধ্যে কালকেতু ফুল্লরাকে নিয়ে বাস করে। কালকেতু প্রত্যহ বনে গিয়া পশু শিকার করে আনে, ফুল্লরা পশুর মাংশ পাড়ায় ঘুরে বিক্রয় করে। তাতে যৎসামান্য যা কিছু পাওয়া যায় তাহাতেই তাদের দরিদ্র সংসার কোনমতে চলে যায়। কালকেতু প্রত্যহ বনে যায় এবং শিকার করে। এই পশু শিকার প্রসঙ্গে মুকুন্দরাম যে শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন তাহা প্রশংসার দাবী রাখে।

কালকেতুর ত্যাচারে বনের পশুরা সদাই সন্ত্রস্ত। সিংহের নিকট গিয়ে সমস্ত পশু অভিযোগ করে। গণ্ডার, চমরী গাই থেকে শুরু করে পতিহীনা হরিণী সকলেরই সেই একই অভিযোগ- কালকেতুর অত্যাচার হতে তাহাদের রক্ষা করতে হবে। তখন পশুদের ক্রন্দন শুনিয়া পশুরাজ সিংহ কোটালকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। কোটাল তো কাঁপিতে কাঁপিতে আসিয়া হাজির। সিংহ বলেনঃ তুমি কর্তব্য পালন করিতেছ না। ‘তোর বুক নখেতে করিব দুই চির। কোটাল বাঘ বলল : প্রভু আজ স্থির হউন। ‘কালি প্রাতে আমি দেখাব মহাবীর।

পরদিন প্রাতে সিংহ নিজেই কালকেতুর বিরুদ্ধে সমরসজ্জা করলেন। গণ্ডার বলল যে, সামান্য মানুষের বিরুদ্ধে এত বড়ো সমরসজ্জা করিবার কোনো প্রয়োজন নেই। ইহাতে সিংহ নিবৃত্ত হইয়া সসৈন্যে চন্দন গাছের নীচে ছাউনি ফেলিয়া কালকেতুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

এদিকে কালকেতু পরদিন প্রাতে উঠিয়া যথারীতি ধড়াচূড়া পরিয়া চণ্ডীর চরণে প্রণাম জানাইয়া বনে প্রবেশ করিল। বন মধ্যে বাঘ তাঁকে আক্রমণ করল। বীর কালকেতু অতি সহজেই বাঘকে নিহত করল। লোকমুখে বাঘের মৃত্যু সংবাদ শুনে সিংহ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। পশুরাজের সহিত কালকেতুর যুদ্ধ আরম্ভ হল। কিন্তু কালকেতুর বীর বিক্রমে অল্পক্ষণের মধ্যেই সিংহকে রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাতে হল। পরদিন কালকেতু আবার বনে আসলে সিংহ তাকে আক্রমণ করলো। দুজনে মিলিয়া এক প্রলয়ঙ্কর যুদ্ধ শুরু হল। এ যুদ্ধেও সিংহ পরাজিত হয়ে পলায়ন করলো। রাজার এবম্বিধ শোচনীয় বিপর্যয় দেখিয়া সকলে রণে ভঙ্গ দিল।

চণ্ডীর নিকট পশুদের দুঃখ নিবেদন— নিরুপায় পশুরা তমাল তরুমূলে চণ্ডীর দেউলে গিয়া উপস্থিত হল। চণ্ডীর নিকট পশুগণ কালকেতুর অত্যাচারের কাহিনী করুণ ভাষায় নিবেদন করতে লাগল । পশুগণের এই ক্রন্দন ও ‘বিলাপের মধ্যে একটু লক্ষ্য করিলেই তৎকালীন শোষিত মানুষের করুণ’ ক্রন্দনের সুরটুকু শোনা যায়।

প্রাণের দোসর ভাই গেল পরলোক।

উদরের জ্বালা আর সোদরের শোক ॥

সামস্ত শ্রেণির অত্যাচার প্রপীড়িত বাঙ্গলাদেশের সাধারণ মানুষের এটাই মর্মকথা। বিশেষ করে ভল্লুক যখন বলে—

উই চারা খাই পশু নামেতে ভালুক।

নেউগী চৌধুরী নই না করি তালুক৷৷

তখন একদিকে যেমন দুর্বলের করুণ অসহায় রূপটি চোখের সম্মুখে ফুটে ওঠে অন্যদিকে তেমনি জীবনরসিক মুকুন্দরামের স্বচ্ছ পরিহাস-তরল জীবন-দৃষ্টির শানিত বিদ্যুৎ দুঃখের বর্ষার মধ্যেও ঝিলিক দিয়ে ওঠে। দুর্বিপাকের দিনে ধনী নির্ধন সকলেরই একদর। তিমিঙ্গিলের নিকট তিমির বিরাটত্ব কিছুই নয়। বরং দরিদ্রের বা ক্ষুদ্রের আত্মরক্ষার যেটুকু উপায় অবশিষ্ট আছে ধনীর বা বিরাটের তাও নেই। তাই বৃহদাকার হস্তী দেবীর নিকট আকৃতি জানিয়ে বলে—

বড়ো নাম বড়ো গ্রাম বড়ো কলেবর! 

লুকাইতে স্খল নাহি অরণ্য ভিতর ৷৷ 

কি করিব কোথা যাব কোথা গেলে তরি। –

আপনার দম্ভ হৈল আপনার বৈরী।

হুক হুক করে বানর কেঁদে আপন দুঃখ নিবেদন করে। ‘ভূমে গড়াগড়ি কান্দে শশারু সজারু। গড়ের ভিতর লুকিয়ে থেকেও তার নিস্তার নিই, কালকেতু তার মধ্য থেকেও সজারুকে খুঁচিয়ে বের করে—

চারি পুত্র মৈল মোর মৈল চার ঝি। 

মাগু মৈল বুড়া কালে জীয়া কাজ কি।

এটা শুধু সজারুরু আত্মবিলাপ নয়, গোটা ষোড়শ শতকের নিপীড়িত শোষিত বাঙ্গালীর মমবিলাপ।

মানুষ যখন শোষণ ও অত্যাচারের ভারে বারে বারে জর্জরিত হয়, বিচারের বাণী যেখানে নীরবে নিভৃতে কাঁদে, সেখানে দেবতার অভয় চরণই একমাত্র ভরসা। তাই চণ্ডীর সমীপে পশুগণের এই বিলাপ তৎকালীন ভাগ্যহত অবক্ষয়িত বাঙ্গালীর ঈশ্বর নির্ভরতারই প্রতিধ্বনি।

পশুগণের করুণ আবেদনে দেবী চণ্ডী তাঁহাদের সম্মুখে আবির্ভূতা হলেন। চণ্ডীর সম্মুখে পশুগণ একে একে কালকেতুর অত্যাচারের কাহিনী বিবৃত করল। চণ্ডী বিস্মিত হয়ে পশুদের একে একে প্রশ্ন করেন—তারা সকলেই প্রভূত শক্তিশালী তবে কালকেতুর কাছে তারা কি ভাবে পরাজিত হল। উত্তরে পশুগণ পরাজয়ের সেই কারণ বিবৃত করল। কালকেতু তাদের অপেক্ষা অনেক শক্তিশালী। অলক্ষ্যে থেকেও সে যুদ্ধ করে। তার সঙ্গে এঁটে ওঠা কঠিন। তখন ভগবতী বললেন—

আজি হইতে মনে কিছু না করিহ ভয়। 

না বধিবে মহাবীর কহিনু নিশ্চয় ৷৷

এই কৌতুককর পশুশিকার প্রসঙ্গে মুকুন্দরামের বর্ণনার যথাযথতা আমাদের মুগ্ধ দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারে না। সিংহ হইতে আরম্ভ করে ক্ষুদ্র সজারু পর্যন্ত যে ভাবে এবং ভাষায় অভিযোগ করেছে তা তাদের শক্তি এবং বুদ্ধির পরিচয়দ্যোতক। ঐ যুগে প্রবলের অত্যাচারের ফলে সমাজে যে মাৎস্য ন্যায় চলছিল বনচারী পশুদের দুঃখের কাহিনী বর্ণনার মধ্য দিয় মুকুন্দরাম তারও ইঙ্গিত দিয়েছেন।