‘টেকনিক্যাল‘ বা ‘কারিগরি‘ কথাটির অর্থ হল— শিল্প প্রণালীর দক্ষতা সম্পর্কিত। যে বিশেষ শিক্ষার দ্বারা এই প্রণালীগত দক্ষতা বিকাশ ঘটানো হয়, তাকে বলে কারিগরি শিক্ষা। অর্থাৎ যে শিক্ষার দ্বারা শিক্ষার্থীকে শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি ও কলকারখানার যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেই শিক্ষাকে বলে কারিগরি শিক্ষা। যেমন—কৃষিবা কলকারখানায় যন্ত্রসামগ্রী পরিচালনার দক্ষতা অর্জন। এই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি হল—
- জুনিয়র টেকনিক্যাল স্কুল,
- মেডিক্যাল কলেজ,
- চিত্রকলা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র,
- কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়,
- পলিটেকনিক কলেজ ইত্যাদি।
কমিশনের মতানুযায়ী ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে মোট ছাত্র সংখ্যা ২০ শতাংশ এবং দশম শ্রেণী পাস করার পর ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী বৃত্তি ও কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করবে।
বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা
আধুনিক শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের জন্য পরিপূর্ণ ভাবে প্রস্তুত করা। জাতীয় শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছে “Education should be developed as to increase productivity”। অর্থাৎ উৎপাদনশীলতা বাড়ানাের জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষার এই প্রয়োজনীয়তা গুলি নিম্নে উল্লেখ করা হল—
(১) উৎপাদনশীলতা: বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষা শিক্ষার্থীদের একটি উৎপাদনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত করে সমাজ ও দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
(২) স্বনির্ভরতা: বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিটি শিক্ষার্থীকে স্বনির্ভর হতে সহায়তা করে। এই শিক্ষার ফলে শিক্ষার্থী হয় কোন চাকরির সুযোগ পায় নয়তো স্বনিযুক্ত কাজে যুক্ত হতে পারে।
(৩) জাতীয় আয় বৃদ্ধি: বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষা যেহেতু উৎপাদনভিত্তিক শিক্ষা, তাই এটি জাতীয় আয় বৃদ্ধি ও দেশের উন্নয়নে সহায়তা করে।
(৪) বিশেষজ্ঞ সৃষ্টি: এই শিক্ষার অপর একটি উদ্দেশ্য হল বিশেষজ্ঞ সৃষ্টি করা। এই শিক্ষার অর্জিত জ্ঞান বা দক্ষতা, শিক্ষার্থীকে তার ভবিষ্যৎ জীবনের নির্দিষ্ট বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে সহায়তা করে।
(৫) অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দান: বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষা শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যৎ জীবনে জীবিকা অর্জনে সহায়তা করে, যা তাকে তার জীবনের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিয়ে থাকে।
(৬) শিক্ষার্থীদের আগ্রহ, প্রবণতা ও বিশেষ ক্ষমতা অগ্রাধিকার দেওয়া: এই শিক্ষার অপর উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীর বিশেষ ক্ষমতা, আগ্রহ, চাহিদা বা প্রবণতাকে কাজে লাগানো। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের বৃত্তির মধ্যে থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিশেষ শিক্ষার বিষয়টি নির্বাচন করতে পারে।
(৭) শ্রমের প্রতি মর্যাদা: সবশেষে, এই শিক্ষা শিক্ষার্থীরা যেহেতু কায়িক শ্রমের মাধ্যমে অর্জন করে থাকে, সেহেতু এর মাধ্যমে তাদের শ্রমের প্রতি এক মর্যাদাবোধ সৃষ্টি হয়।
(৮) জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ: বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের উপায় তৈরি হয়। ব্যতিক্রমী শিশুদের জন্য এই ধরনের বৃত্তিমূলক শিক্ষা খুবই প্রয়োজন যার ফলে তারা কিছু উৎপাদন মূলক কাজে নিজেদের নিয়োগ করতে পারে এবং অর্থ উপার্জনে সক্ষম হয়।
(৯) শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি: পুথিগত নীরস শিক্ষার একঘেয়েমি থেকে দূর করে ব্যবহারিক ও হাতে কলমে শিক্ষা। এই শিক্ষায় তাদের উৎসাহ বৃদ্ধি একপ্রকার ইতিবাচক মনােভাব গড়ে তােলে।
(১০) শ্রমের প্রতি উৎসাহ: বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষা শিক্ষার্থীদের শ্রমের মর্যাদা দিতে শেখায়। নৈতিক চরিত্র গঠনে সাহায্য করে।
(১১) কর্মের সুযোগ: বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা শিক্ষার্থীদের কর্মের দক্ষতা বৃদ্ধি করে যে চাকরি বা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে।
সুতরাং, বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষা হল ব্যক্তিনির্ভর, নির্বাচন ধর্মী, বৈচিত্র্যপূর্ণ, ব্যবহারিক, স্বনির্ভরতার শিক্ষা, যা শিক্ষার্থীকে সকল দিক থেকে পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটিয়ে থাকে।
Leave a comment