ভূমিকা: কায়কোবাদের কবিভাষা ও শিল্পচেতনায় তাঁর সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি ও সাধনার একনিষ্ঠতা সহজেই প্রত্যক্ষ করা যায়। কাব্যের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কবি যেমন সচেতন ও আন্তরিক ছিলেন, কাব্যের আঙ্গিক নির্মাণ ও শিল্প প্রকরণের দিকেও তিনি ছিলেন সজাগ-সতর্ক। অবশ্য উভয় ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তাধারা ও বিশ্বাসকেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর কবি ভাষা ও শিল্পচেতনার স্বরূপ বিশ্লেষণে দেখা যায়, কাব্যচর্চাকে যেমন জীবনের অঙ্গীভূত করেছিলেন, কাব্যের শৈল্পিক সাধনায়ও নিজেকে রেখেছেন নিমগ্ন। কাব্য সম্পর্কে যেমন তাঁর নিজস্ব একটি দৃষ্টিভঙ্গি ও রীতিকে অনুসরণ করেছেন। এ কারণে কবি-ভাষা ও শিল্পচেতনায় পরিশীলনের ছাপ ততটা সুস্পষ্ট না হলেও স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিক সাধনা ও প্রখর সচেতন শিল্পবোধের ঔজ্জ্বল্য তাঁর অধিকাংশ-কাব্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সফল ও সার্থক।

বাঙালি মুসলমানকে যখন হীনম্মন্যতা গ্রাস করেছিল কায়কোবাদ তখন সাহিত্যক্ষেত্রে আবির্ভূত হয়েছিলেন একজন আত্মসচেতন, আত্মপ্রত্যয়ী ও মানবতাবাদী কবি হিসেবে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একচ্ছত্র অধিকারী হিন্দু সাহিত্যিকগণ সেদিন অবাক বিস্ময়ে তাকে খাঁটি ও প্রতিভাবান কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। ব্যক্তি মানুষ ও কবি কায়কোবাদ অনেক বেশি আধুনিক, মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, মানবকল্যাণকামী ও জীবন ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

ভারতের প্রধান দুই সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে আবহমান বাঙালির সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এ বোধ ও বিশ্বাস থেকেই তাঁর চৈতন্যে নির্মিত হয়েছে এক সীমাহীন ঔদার্য, সংকীর্ণতামুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি। মূলত এ অসাম্প্রদায়িক উদার মনোভাব কায়কোবাদের কবি মানসের এক বিশেষ ও উজ্জ্বল বৈশিষ্ট্য। যা তাকে আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয় ও প্রাসঙ্গিক করে তুলে। স্বজাতির ঐতিহ্য ও ধর্মীয়বোধ সম্পর্কে সচেতন থেকেও তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় জাতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এমন এক উদার ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি কায়কোন থেকেও তিনি হিন্দু-মুসলমান অন্যান্য কবি সাহিত্যিকের মধ্যে লক্ষ করা যায় না। নিচে বিভিন্ন কাব্য অকারনে বাদের কমলা, যা তার সমকালের চিন্তাচেতনার মনোভাব আলোচনা করা হলো:কায়কোবাদ তাঁর ‘মহাশশ্মশান’ মহাকাব্যে এমন একটি ঐতিহাসিক কাহিনিকে অবলম্বন করেছেন, যে কাহিনিতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় জাতির ঐতিহ্য ও বীরত্বের কথা আছে। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধের কাহিনি নিয়ে কাচিত বিপুলিনিতে হিন্দু এ কাব্যে হিন্দু-মুসলমান উভয় জাতির একটি চরম সংকটকে গ্রন্থের কেন্দ্রীভূত আবেগ হিসেবে বর্ণনা করেছেন অনে নিরপেক্ষ উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে। স্বধর্ম ও স্বসম্প্রদায়ের প্রতি বিশ্বস্ত ও শ্রদ্ধাবান থেকেও অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি তিনি ছিলেন সহনশীল। তাঁর অসাম্প্রদায়িক মনোভাব ও চিন্তাচেতনাই ছিল এর মূল কারণ। এ কাব্যের অসাম্প্রদায়িকতার প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সৈয়দ আলী আহসান বলেন, “এই কাব্যপাঠে কায়কোবাদের যে বিশিষ্টতা আমার কাছে ধরা পড়েছে। তা হচ্ছে কবির নিরঙ্কুশ অসাম্প্রদায়িকতা।”

কায়কোবাদ আন্তরিকভাবেই অসাম্প্রদায়িক ও উদার চিত্তের অধিকারী ছিলেন। তা না হলে সমকালীন প্রেক্ষাপটে ‘মহাশ্মশান’ কাব্যে হিন্দু-মুসলিম দুই জাতির সংঘর্ষ দেখাতে গিয়ে কবির পক্ষে নিরপেক্ষ থাকা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। কবির দৃষ্টিতে দু’জাতিই এটিকে ধর্মযুদ্ধ হিসেবে নিয়েছে এবং উভয় জাতিই নিজ নিজ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ব্যাকুলভাবে চেষ্টা করেছে, জীবন উৎসর্গ করার ব্রত গ্রহণ করেছে। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে একপক্ষ অন্যপক্ষকে বাক্যবাণে আহত করেছে। যেকোনো এক পক্ষের বক্তব্য শুনে মনে হবে কবি বুঝি পক্ষপাতিত্ব করেছেন। কিন্তু সমগ্র কাব্যটি পড়লে সহজেই বুঝা যায় কবি উভয় পক্ষেরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাই হিন্দুর মুখে ‘যবন নিধন’ আর মুসলমানের মুখে ‘কাফের বিধ্বংস’ উভয়ই সমান গুরুত্ব পেয়েছে। কখনো তিনি হিন্দু বিদ্বেষী যেমন হননি, তেমনি স্বজাতির পক্ষও অবলম্বন করেননি।

শুধু ‘মহাশ্মশান’ কাব্যেই নয়, কায়কোবাদের অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রকাশ তার অন্যান্য কাব্যেও পাওয়া যায়। ‘অমিয়ধারা’ কাব্যের বেশ কিছু কবিতায়, ‘শিব-মন্দির বা জীবন্ত সমাধি’ কাব্যে ‘প্রেমের রানী’, ‘প্রেম পারিজাত’, ‘শ্বশানভন্ম’ প্রতিটি কাব্যেই মূলত কায়কোবাদের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। কায়কোবাদ তাঁর কাব্যে হিন্দু- মুসলমান নরনারীর প্রণয়, এমনকি বিয়ে পর্যন্ত দেখিয়েছেন। শাস্ত্রাচার, জাতিভেদ প্রথা এগুলোকে তিনি কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করেননি। ধর্ম যখন মানুষের মঙ্গলের পথে, মিলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তখনই তিনি প্রশ্ন তুলেছেন শাস্ত্র, ধর্ম, জাতিভেদ এগুলো মূলত মানুষের সৃষ্টি। হিন্দু-মুসলমান মূলত ভাই ভাই। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই তিনি তাঁর প্রায় প্রতিটি কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি কামনা করেছেন।

জাতিভেদ সব ভুলে গিয়ে হিংসা দ্বেষ ভুলে দুই জাতিকে তিনি এক হয়ে যেতে বলেছেন। তিনি তার কাব্যের হিন্দু- মুসলিম উভয় চরিত্রের মাধ্যমে উভয় ধর্মের দোষত্রুটিগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। বিশেষকরে ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার, প্রচলিত প্রথা, শাস্ত্রীয় বিধিনিষেধ, জাতিভেদ প্রথা, এসব বিষয়ের তীব্র সমালোচনা করেছেন। এসব ক্ষেত্রে তিনি মানুষকে এবং তার প্রেমকেই সবকিছুর ঊর্ধ্বে ঠাই দিয়েছেন। তাইতো ‘শিব-মন্দির’ কাব্যে মুসলমান চরিত্রের উচ্চারণ এ রকম-

“বিধাতার বিশ্ব-রাজ্যে হিন্দু-মুসলমান
একই পিতার পুত্র আমরা নির্বোধ,
না বুঝিয়া সৃজিয়াছি জাতিভেদ প্রথা।”

কবি কায়কোবাদ তাঁর প্রায় প্রতিটি কাব্যে হিন্দু-মুসলমান উভয় জাতিকে বিশেষ কোন ধর্মীয় গন্ডিতে আবদ্ধ না করে মানব সন্তান রূপে দেখেছেন। উভয় ধর্মের ত্রুটিবিচ্যুতি, সংকীর্ণতাগুলো নির্দেশ করে সকল মানুষকে একই স্রষ্টার সৃষ্টি বলে চিহ্নিত করেছেন। তার দৃষ্টিতে ধর্ম, জাতিভেদ মানুষের সৃষ্টি; স্রষ্টা মানুষকে মানুষ রূপে সৃষ্টি করেছেন, হিন্দু-মুসলমান রূপে নয়। তাঁর এ মনোভাব ‘কুসুম কানন’ কাব্য থেকে পরবর্তী প্রায় সব কাব্যেই প্রতিফলিত হয়েছে। ‘মহাশ্মশান’ তো বটেই ‘শিব-মন্দির’, ‘প্রেমের রানী’ ‘প্রেম-পারিজাত’, ‘শ্মশান ভস্ম’ প্রভৃতি কাহিনি কাব্যে চিত্রিত নায়ক-নায়িকাদের প্রায় সবাই একই দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী। তাদের কাছে ধর্ম নয়, শাস্ত্র নয়, জাতি নয়, প্রেমই সব কিছুর উর্ধ্বে।

কায়কোবাদ তাঁর প্রতিটি কাব্যে হিন্দু-মুসলমানকে পাশাপাশি একই দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থিত করেছেন, তাদের মিলন কামনা করেছেন। উভয়ের মঙ্গল আকাঙ্ক্ষা করেছেন। মানবতাবাদী, সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তার এ মানসিকতার মাঝে সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। প্রথম জীবনে হিন্দু নারীর প্রতি ভালোবাসা কবির এ মিলনকামী মানসিকতার পিছনে কাজ করেছে বলে মনে করা হয়। এটি একটি কারণ হতে পারে কিন্তু কোনো ক্রমেই মূল কারণ নয়। আপন ধর্মের প্রতি অবিচল ভক্তি ও শ্রদ্ধা রেখেও কবি এতটা উদার হতে পেরেছিলেন এ কারণেই যে, তাঁর দৃষ্টিতে মানুষের মঙ্গলের মাঝেই স্রষ্টার সন্তুষ্টি নির্ভর করে। কাজেই মানুষের উপকার করার মাঝেই মানবজীবনের সার্থকতা নির্ভর করে। এভাবে তাঁর ধর্মবোধ তাকে মানবতার কবি, সাম্যের কবি, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের কবিতে পরিণত করেছে।

কবি কায়কোবাদ তাঁর কাব্য জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন উদার অসাম্প্রদায়িক এবং সংকীর্ণতামুক্ত মানবকল্যাণকামী এক কবিসত্তার অধিকারী। ‘অমিয়-ধারা’ কাব্যের দ্বিতীয় খণ্ডে লিখিত কিছু কবিতা পাঠ করলে মনে হতে পারে কবি সাম্প্রদায়িক ছিলেন। কিন্তু তা কোনক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারণ কবির সমগ্র কাব্য প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে পড়লে একথা উপলব্ধি করা যায় যে কবি কায়কোবাদ জীবনের কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। তিনি মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখেছেন, হিন্দু-মুসলমান হিসেবে নয়। তাকে তার কাব্যে ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে আবিষ্কার করা যায়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক হিসেবে নয়। আর একথা সত্য যে মানুষ নিজ ধর্মে বিশ্বাসী হতে পারে কিন্তু তাই বলে তাকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেয়া যায় না।

কবি যদি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠতেন তাহলে ‘অমিয়ধারা’ পরবর্তী সব কাব্যেই তার বহিঃপ্রকাশ ঘটত, বাস্তবে তা হয়নি। সুতরাং বলা চলে পরিস্থিতির উত্তেজনা ও প্রেরণাবশত কবি তার মৌল প্রবণতা থেকে ক্ষণিকের জন্য সরে গেছেন বটে, বিচলিত হয়েছেন মাত্র, কিন্তু স্থায়ীভাবে সরে যাননি বা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েননি। স্বাজাত্য প্রেমে উদ্বুদ্ধ মানসিক অভিব্যক্তি, যা স্থায়ীরূপ গ্রহণ করেনি পরবর্তী কবি কর্মে। অর্থাৎ তিনি তার মূল চেতনা থেকে কখন সরে যাননি। তাই কিছু কবিতার জন্য কবিকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া সঙ্গত নয়। কায়কোবাদের অসাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে আনোয়ার পাশা বলেন, “কবিত্বশক্তিতে ন্যূন হলেও কায়কোবাদের মানসিকতা সে কালের অনেক শক্তিশালী কবিদের থেকে অনেক উদার ও অসাম্প্রদায়িক ছিল।”

আলোচনার পরিশেষে এসে বলা যায়, কায়কোবাদ এক মহৎ উদার অসাম্প্রদায়িক কবি মানসের অধিকারী ছিলেন, যা তার সমকালে তো বটেই এ যুগেও অনেক ক্ষেত্রে দুর্লভ। তিনি তাঁর কাব্যে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির বীজ বপন করেছেন। তাই বলা যায়, তাঁর সময়ের দিক থেকে তিনি বিস্ময়কর রকম অসাম্প্রদায়িক ছিলেন।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।