মধ্যযুগীয় বাংলা পদাবলি সাহিত্যে দুই প্রধান ধারা– (১) বৈষ্ণব পদাবলি (২) শাক্তপদাবলি। এই দুই পদসাহিত্যের মূল বৈশিষ্ট্য ভক্তিসংগীত। কিন্তু ভক্তসাধকদের কাছে ভক্তির রসভাবনা তাঁদের সাধনার লক্ষ্য হিসাবে অনেকখানি পৃথক। বৈষ্ণবপদের ধারা যখন অন্তর্হিত প্রায়, তখনই আবির্ভাব ঘটে শাক্তপদের। এই শাক্তপদের উদ্ভবের পিছনে বৈশ্বব পদাবলির প্রভাবকে অস্বীকার করা যায় না।

সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন – “বৈষ্ণব সাধনার অন্তরঙ্গ সুর ও বিগলিত ভাবাবেশ মাধুর্য শাক্ত কাব্যেও সংক্রামিত হইল—দেবীর স্তব-স্তুতির মধ্যে ভক্তের আত্মসমর্পণও একান্ত নির্ভয়ের ভাবটি বৈষ্ণব কবিতার প্রভাবে ফলস্বরূপ ফুটিয়া উঠিল।” কোনো কোনো সমালোচক শাক্ত কবিতায় বৈষ্ণব প্রভাবের কথা অস্বীকার করলেও উভয়ের তুলনামূলক আলোচনায় এই প্রভাবের স্বরূপটি উদ্‌ঘাটিত হয়ে আসে।

বাঙলা ভাষায় প্রচলিত গীতাবলীর বিশেষ করে বৈষ্ণব পদাবলির সঙ্গে শাক্ত পদাবলির কিছু কিছু সাদৃশ্য থাকলেও বৈসাদৃশ্য বড়ো কম নয়। ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বৈষ্ণব গীতিকবিতার জন্মলগ্ন। বাংলাদেশের শ্রেণিবিভক্ত সমাজ ও বর্ণবিদ্বেষ কবলিত সমাজকাঠামো তুর্কি আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়, বাংলাদেশ বিদেশি শক্তির কবলিত হয়ে পড়ে। বিদেশি শক্তির আগ্রাসী ধর্মীয় আচার আচরণ প্রতিরোধে সেদিন প্রয়োজন ছিল সমস্ত বর্ণের মানুষকে একত্রিত করা। এই অভূতপূর্ব মিলন উৎসবে সমবেত সংগীতের যে উৎসার ঘটল তাই বৈষ্ণব পদাবলি নামে অভিহিত।

শাক্ত পদাবলির সূচনা অষ্টাদশ শতাব্দীর যুগসন্ধিক্ষণের পটভূমিকায়। শাক্তপদাবলির জন্মলগ্নে বৈষ্ণব প্রভাব গতানুগতিক পুনরাবৃত্তিতে প্রেরণাহীন হয়ে পড়েছিল। দৈনন্দিন জীবনের অনিশ্চয়তা, অভ্যন্তরীণ সংকটের তীব্রতা, দোদুল্যমান জীবনের মাধুর্যের লীলাবিলাসী দেবতার পরিবর্তে ভয়ভীতির প্রতীকরূপে দেবতার স্তুতি গাওয়া হল। ফলে শাক্তপদের উৎপত্তি ঘটল।

বিষয়বস্তু ও কাব্যপ্রেরণাগত পার্থক্য : বৈষ্ণব পদাবলির বিষয়বস্তু রাধাকৃষ্ণলীলা, আর শাক্ত পদাবলির বিষয়বস্তু জগজ্জননী মহামায়ার লীলা। একটির আরাধ্য শ্যাম অপরটির আরাধ্য শ্যামা, একটির শাস্ত্র ভাবগত অপরটির শাস্ত্র তন্ত্র। অবশ্য উভয় ক্ষেত্রেই আরাধ্য, রসরূপ বা আনন্দ স্বরূপ—তাই নিৰ্গুণ পরমতত্ত্ব ভক্তের সহিত স্নেহ-প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ। বৈষ্ণব পদাবলিতে ভগবান মাধুর্যের আকার, শাক্ত পদাবলির আগমনী বিজয়া গানে মাতা কন্যার স্নেহ-সম্পর্কের চিত্রটি অঙ্কিত হয়েছে। উমার মর্ত্যে আগমন লীলাতত্ত্বের আভাসমাত্র। মেনকার উক্তিতে এ সত্য প্রকাশিত—

“গিরি, গৌরী আমার এসেছিল!

স্বপ্নে দেখা দিয়ে, চৈতন্য করিয়ে

চৈতন্যরূপিণী কোথা লুকালে।”

শাক্ত পদাবলির প্রেরণা গোষ্ঠীগত নয় ব্যক্তিগত। শাক্ত কবিরা ভক্তি সাধনার শুষ্ক আচারবাদের ওপর হৃদয়াবেগের পলিমাটির আস্তরণ বিছিয়ে দিয়েছেন কিন্তু বৈষ্ণুব কবিরা শ্রীরাধার প্রেমে ব্যক্তির সঙ্গে সমাজের দ্বন্দ্বের রূপটি স্পষ্ট করে তুলতে পারেনি।

উপাসনার পদ্ধতিগত পার্থক্য : যে কোনো উপাসনা পদ্ধতির দুটি ধারা বাহ্যসাধন ও অন্তরসাধন। বাহ্য সাধনায় উভয় ধর্মের পার্থক্য তো স্পষ্ট প্রতীয়মান। বৈষ্ণবদের উপাস্য শ্রীকৃষ্ণ ; শাক্তদের উপাস্য কালী, তারা, দূর্গা ইত্যাদি দেবী। এদের পূজা পদ্ধতি, পূজোপকরণ এবং পূজা উৎসবের আস্তর পার্থক্য উভয় ধর্মের কাব্যসাধনায় প্রতিফলিত। উভয় ধর্মে ভক্তিবাদে পার্থক্য আছে। বৈষ্ণব ভক্তি নিষ্কাম ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ কোনোকিছুই বৈষ্ণুবের কাম্য নয়, কিন্তু শাক্তসাধক, দুর্ভাগ্যপীড়িত জীবনে মাতৃ আশ্রয় কামনা করে।

শক্তি সাধকের আস্তর সাধনা স্বতন্ত্র, শাক্ত কবিরা প্রেমের কবি নন, তাঁরা বীর্যের সাধক। তাই শাক্ত পদাবলি পরমাশক্তিকে আবাহনের উদ্দীপন সংগীত। ভক্ত-ভগবান এখানে মুখোমুখি। নায়ক-নায়িকা এখানে জগজ্জননী। বৈষ্ণব পদাবলি শুধু লীলাশ্রিত। শাক্তপদে লীলা ও তত্ত্বের সমন্বয় ঘটেছে। সাধনতত্ত্বের ভিন্নতার জন্য বৈষ্ণব পদে রামপ্রেম- পূর্বরাগ, আভিসার, মান, মিলন-বিরহের উল্লেখ্য। শাক্তপদে প্রধান উপজীব্য জননী ও সন্তান এছাড়া সাধন ক্রিয়ার যাবতীয় আচার অনুষ্ঠান আছে।

রসতত্ত্বজনিত প্রভেদ : বৈষ্ণব কবি পঞ্চরসের আরাধনা। বৈষ্ণব মতে রস পাঁচটি – শাণ্ড, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। এদের মধ্যে মধুর রস শ্রেষ্ঠ। বৈষ্ণব কবিদের শুরু শাশুরসে, সমাপ্তি মধুর রসে। তবে শাক্ত কাব্যে বাৎসল্য রসই প্রধান। বাৎসল্যই সব রসের মূল। বৈষ্ণব কবিদের বাৎসল্য রসের কাব্যে কৃষ্ণের প্রতি যশোদার অমূলক আশঙ্কাজনিত স্নেহ ব্যক্ত হলেও তা কখনই শাক্ত পদাবলির ন্যায় সাধারণীকৃত হয়ে সমগ্র জাতির মর্মবেদনার আলেখ্য হয়ে উঠতে পারেনি। আগমনী ও বিজয়া সঙ্গীতে আরাধ্যা দেবী বালিকার মূর্তিতে দেখা দিয়েছেন। স্নেহময়ী মাতার স্নেহ নিষিক্তরূপে মা মেনকা স্বপ্নে দেখেন কন্যা তার কাছে বসে আছে কিন্তু জেগে উঠেই দেখতে পান সবই মায়া –

“অচেতন পেয়ে নিধি, চেতনে হারালাম গিরি হে।”

এছাড়া মেনকা নারদের মুখে জানতে পেরেছেন পার্বতী স্বামীগৃহে বহুকষ্টে দিনপাত করছেন। সুতরাং মেনকার তীব্র অনুযোগ –

“কবে যাবে বল গিরিরাজ, গৌরীরে আনিতে

ব্যাকুল হৈয়েছে প্রাণ উমারে দেখিতে হে।”

এমন ব্যাকুলতা, এমন বাৎসল্যজনিত রস সমগ্র বৈষ্ণুব সাহিত্যে বড়োই দুর্লভ।

কাব্যমূল্য : বৈষ্ণব পদাবলি ধর্মনিরপেক্ষ একটি সার্বজনীন আবেদনের আলেখ্য। শাক্ত পদাবলিতেও তেমন লক্ষ্য করা যায়। তবে শাক্ত পদকতাগণ বৈষ্ণব পদকর্তাদের মতো সচেতন শিল্পী ছিলেন না বলে শাক্ত পদাবলি বৈষ্ণব পদের তুল্য কাব্যগুণসম্পন্ন নয়। শব্দালংকার, অর্থালংকার ও ধ্বনিব্যঞ্জনায় বৈষ্ণুবগীতি পদাবলি সমৃদ্ধ। শাক্ত পদাবলি স্বভাবত নিরলংকার। বৈষ্ণুব পদকর্তারা প্রায় সকলেই কবি-শিল্পী ছিলেন বলেই অলংকারচর্চা ও কাব্যচর্চা ছিল তাঁদের সাধনার অঙ্গরূপ। কিন্তু শাক্ত কবিরা ছিলেন সাধারণ মানুষ, কাব্যচর্চা তাদের কাছে কখনই সাধনার অঙ্গ হয়ে ওঠেনি। যুগপ্রেরণায় পদ লিখলেও শিল্পীমনের অভাবে সে পদগুলি কখনই কাব্য পদবাচ্য হয়ে ওঠেনি। বৈষ্ণব পদাবলির রাধার স্বপ্নদর্শন পদের অনুরূপ পদ আগমনী পর্যায়ে আছে। শাক্ত কবির স্বপ্নদর্শন ও রাধার স্বপ্নের মতো অপ্রাপ্তির বেদনায় বিষণ্ণ। কিন্তু উভয়ের মানসলোকের চরম বৈপরীত্য উভয় জাতীয় পদের পার্থক্য সূচিত করেছে।