স্থায়ী ভাবেই রসের মূল উপাদান। (মনে যে সব রোধ জাগে—তাকে ভাব বলে, ঘটনা বা চিন্তার ফলে মনে এই বোধ জাগে। আলংকারিকেরা মনের ন’টি স্থায়ীভাব স্বীকার করেছেন, যেমন—রতি, হাস, শোক, ক্রোধ, উৎসাহ, ভয়, জুগুপ্সা, বিস্ময় ও শম। এছাড়া আরও অনেক ভাব আছে, তাদের স্থায়ীভাব বলা হয়।) এই স্থায়ী ভাবগুলি উপযুক্ত বিভাব, অনুভাব এবং সঞ্চারী (ব্যভিচারী) ভাবের সংযোগে রসে পরিণত হয়।
তাই বিভাব, অনুভাব এবং সঞ্চারী ভাবকে কাব্যনির্মাণের কৌশল বলা হয়েছে। সে কথা আলোচনার পূর্বে কোন স্থায়ীভাব কি রসে পরিণত হয় তা আমাদের জেনে রাখা দরকার। রতি ভাব থেকে ‘শৃঙ্গার’ রস, এই রকম হাস থেকে ‘হাস্য’ রস, শোক থেকে ‘করুণ’, ক্রোধ থেকে ‘রৌদ্র’ উৎসাহ থেকে ‘বীর’ ভয় থেকে ‘ভয়নাক’, জুগুপ্সা, থেকে ‘বীভৎস’ বিস্ময় থেকে ‘অদ্ভুত’, আর শম থেকে ‘শান্ত’ রস—এই হচ্ছে রসপরিণতির ধারা।
ভাবকে রস পরিণতি করার কারণ বা কৌশল তিনটি
(ক) বাস্তব জগতে যে ঘটনা বা যে চিন্তা মনের স্থায়ী ভাবকে জাগিয়ে দেয়—তা’হল বিভাব আচার্য অতুলচন্দ্র গুপ্ত সংক্ষেপে বলেছেন—লৌকিক জগতে বা রতি প্রভৃতি ভাবের উদ্বোধক, কাব্যে নাটকে তাকেই বিভাব ছিল।
বিভাব দুরকমের—আলাম্বন বিভাব আর উদ্দীপন বিভাব। যে বস্তুকে আশ্রয় করে রসের সৃষ্টি—তা হচ্ছে আলম্বন বিভাব, আর যে পরিবেশ বা পরিপার্শ্ব রস-সঞ্চারের পক্ষে উপযোগী বা অনুকূল-তা হল উদ্দীপন বিভাব। নিচের উদাহরণটিতে আলম্বন ও উদ্দীপন বিভাবের পরিচয় দেখানো হয়েছে—
নদী কূলে কূলে কল্লোল তুলে গিয়েছিল ডেকে ডেকে।
বনপথে আসি করিতে উদাসী কেতকীয় রেণু মেখে।
বর্ষাশেষের গগন কোণায় কোণায়,
সন্ধ্যামেঘের পুঞ্জ সোনায় সোনায়
নির্জন ক্ষণে কখন অন্যমনায় ছুঁয়ে গেছ থেকে থেকে।
কখনও হাসিতে কখনও বাঁশিতে গিয়েছিল ডেকে ডেকে।
কবির লীলাসঙ্গিনী এখানে আলম্বন-বিভাব, আর বর্ষাচুম্বিত আকাশের প্রেক্ষাপটে ও বর্ষাকালজনিত পরিবেশ হল উদ্দীপন-বিভাব।
(খ) অনুভব বুঝতে কষ্ট নেই। মনের ভাবকে বাইরে প্রকাশ করার জন্যে যে সব অঙ্গভঙ্গি করা হয়—সেই কাজই হল অনুভাব। মানুষ রেগে গেলে চোখে মুখে, হাত পা নাড়ার মধ্যে, কথা বলার ভঙ্গিতে তার অভিব্যক্তি বা প্রকাশ ঘটে। চিত্তবৃত্তির এই যে প্রকাশনা—এই হল অনুভাব। মনে ভাব এলে—যে সব স্বাভাবিক বিকার ও উপায়ে তা বাইরে প্রকাশ হয় তাই অনুভাব। যেমন—
দ্বিধায় জড়িত পদে কম্প্রবক্ষে নম্র নেত্রপাতে
স্মিত হাস্যে নাহি চল সলজ্জিত বাসর শয্যাতে
স্তব্ধ অর্ধরাতে
“মিলন মধুর লাজে’র এই কাব্যছবিটির উপাদান হচ্ছে কয়েকটি অনুভাব।
(গ) আমরা জানি, যে স্বীকৃত স্থায়ীভাব হল ন’টি। এই স্থায়ীভাবগুলো উপভোগ করার সময়ে ওই জাতীয় আরও কিছু ভাব মনকে ঘিরে ধরে—এরাই ব্যভিচারী ভাব। মূলভাবের গতিকে সঞ্চারিত করে বলেই এদের নাম সঞ্চারীও রাখা হয়েছে। রতিভাব উপলব্ধির সময় কখনও লজ্জা, কখনও পুলক, কখনও দ্বিধাজড়িত শঙ্কা—ইত্যাদি নানা ভাব দ্রুত যাওয়া আসা করে—এরাই সঞ্চারী বা ব্যভিচারীভাব। অনেক আলংকারিক এই রকম তেত্রিশটা ভাবের উল্লেখ করেছেন। এই তেত্রিশটি ভাবের প্রধান কয়েকটির উল্লেখ করা হল—নির্বেদ (নিজেকে হেয়জ্ঞান করার ভাব, বৈরাগ্য), গ্লানি, লজ্জা, শঙ্কা, হর্ষ, দৈন্য, অসুয়া, বিষাদ, চিন্তা ত্রাস, মদ, মোহ, জড়তা, ঔৎসুক্য, বিষাদ প্রভৃতি। সঞ্চারীভাব সমূহের ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্যের ওপর রসের আস্বাদন নির্ভর করে।
সঞ্চারীভাবের স্বতন্ত্র রসমূর্তি নেই, এরা যে মূল স্থায়ীভাবকে পুষ্ট করে অবশ্য দুএকজন আলংকারিক সঞ্চারী ভাবের এক আলাদা রসমূর্তি কল্পনা করে নাম দিয়েছেন সঞ্চারী রস। তবে তাঁরা একথা মেনেছেন যে কাব্যে একটি মাত্র রসই প্রধানভাবে থাকে, সঞ্চারী রস মূল রসেরই পুষ্টি সাধন করে। তাঁরা অস্বীকার করেননি যে স্থায়ী ভাবই বিভাব অনুভাব আর সঞ্চারীভাবের মাধ্যমে অলৌকিক রসসম্পদে রূপান্তরিত হয়।
Leave a comment