“অভিনব গুপ্ত বিভাব ও অনুভাবকে বলেছেন—’সকল হৃদয়ে সমবাদী।”

“কাব্যে স্যারী ভাবের স্বতন্ত্র রসমূর্তি নেই।”

“সঞ্চারী দিয়ে পরিপুষ্ট না হলে রসের রসত্নই হয় না।”


বহির্জগৎ কিংবা আন্তর্জগতের নানারূপ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া আমাদের মনে যে বিচিত্র চিত্তবৃত্তি বা ‘ইমোশনে’র সৃষ্টি করে তাদের বলা হয় ‘ভাব’। কাব্যজগতের বাহ্য উপাদানের ক্রিয়ায় মনের লৌকিক ‘ভাব’ অসাধারণ কবি-প্রতিভার স্পর্শে কাব্যে অলৌকিক রসমূর্তি লাভ করে থাকে। এই কারণেই রস-বিচারে আলঙ্কারিকগণ ‘ভাব’ নিয়েও বিস্তর ভাবনা চিন্তা করেছেন, তাদের পুঙ্খানপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও বর্গীকরণ করেছেন এবং রসনিষ্পত্তিতে এদের মূল্য নির্ধারণও করেছেন।

‘ইমোশন’ বা ‘ভাব’ হচ্ছে একটি সর্বাবয়ব মানসিক অবস্থা। নানা কারণেই মানসিক অবস্থার পরিবর্তনে ভাবেরও পরিবর্তন ঘটে, ফলতঃ ভাবের সংখ্যা গণনা সম্ভবপর নয়। তৎসত্ত্বেও মনোবিজ্ঞানী এবং আলঙ্কারিকগণ ব্যবহারিক সুবিধার জন্য এদের প্রধান কয়েকটির নামকরণ করেছেন। আচার্য ভরত এদের সংখ্যা বলেছিলেন আট, কিন্তু ‘সাহিত্যদর্পণ’কার এর সঙ্গে ‘শম’ যোগ করে মোট প্রধান ভাবের সংখ্যা নির্ণয় করেছেন নয়টি—”রতিহাসশ্চশোকশ্চ ক্রোধোৎসাহৌ ভয়ং তথা। জুগুপ্সা বিস্ময়শ্চেখমষ্টো গ্লোবাঃ শমোঽপি চ।।” আচার্য অভিনব গুপ্ত বলেন, “ভাবরূপ চিত্তবৃত্তির মধ্যে যে ভাব মনে বহুলরূপে প্রতীয়মান হয়, সেটি স্থায়িভাব।” এই হিসেবে এবং নয়টি ভাবকেই ‘স্থায়িভাব’-রূপে অভিহিত করা হয়। এই স্থায়িভাবগুলিই কাব্যের বিভাব-অনুভাব-আদির সহায়তায় নয়টি রসে পরিণত হয়—রতিভাব শৃঙ্গার রসে, হাস্যভাব হাস্যরসে শোকভাব করুণ রসে, ক্রোধভাব রৌদ্ররসে, উৎসাহভাব বীররসে, ভয়ভাব ভয়ানক রসে, জুগুপ্সা ভাব বীভৎস রসে, বিস্ময়ভাব অদ্ভুতরসে এবং শমভাব শান্তরসে পরিণতি লাভ করে। অতএব দেখা যাচ্ছে, রস-সৃষ্টির মূল উপাদান কোনো-না-কোনো স্থায়িভাব। সাহিত্যে এই স্থায়িভাবই অলৌকিকরূপে পরিবেষিত হয়; কিন্তু একমাত্র স্থায়িভাবের সহায়তায় রস-সৃষ্টি পরিপূর্ণভাবে সার্থকতা লাভ করতে পারে না বলেই আদি আলঙ্কারিক আচার্য ভরতমুনি এবং তাঁর উত্তরসূরীরা রসনিষ্পত্তিতে আরও কিছু ভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। ভরতমুনি বলেন, ‘বিভাবানুভাব-ব্যাভিচারি-সংযোগাদ্রসনিষ্পত্তি’। অর্থাৎ ‘বিভাব, অনুভাব এবং সঞ্ঝারী তথা ব্যাভিচারী ভাবের সহযোগেই রসনিষ্পত্তি হয়। রস নিষ্পত্তির এই ব্যাখ্যার বিশ্লেষণ থেকে অনেকে বলেন যে স্থায়িভাবই স্থায়ি রস সৃষ্টি করে, ব্যভিচারী ভাব স্থায়িভাবকে বিচিত্রভাবে রূপায়িত করে কিন্তু স্বয়ং স্থায়ি রস সৃষ্টি করতে পারে না। স্থায়িভাব এবং সঞ্চারী ভাবের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে অভিনব গুপ্ত বলেন, স্থায়ী ভাবসমূহ যেন রক্ত-পীত-নীল-হরিতাদি বর্ণের দ্বারা রঞ্জিত কতকগুলি সূত্র। এই সূত্রদ্বারাই যেন ক্ষণিক উদয়-ব্যয়শালী বিচিত্র লীলাগর্ভ স্ফটিকস্বচ্ছ ব্যভিচার ভাবসমূহ নিরন্তর গ্রথিত হয়। …সুতরাং দৃঢ়মূল স্থায়িভাবই ব্যভিচার-ভাবের ভিত্তি।’

অতএব আলঙ্কারিকদের মতে ভাবের প্রধান ভাগ দুটি—’স্থায়িভাব’ ও ‘সঞ্চারীভাব’ এবং কাব্যনির্মাণকৌশলের তিন ভাগ-বিভাব, অনুভাব ও ব্যভিচারী বা সঞ্চারী ভাব। যদি এই তিনের সঙ্গে ‘স্থায়িভাব’কে যুক্ত করা যায়, তবে রসনিষ্পত্তিতে চার প্রকার ভাবকেই স্বীকার করতে হয় ; রতি-হাসাদি নব স্থায়িভাব, বিভাব, অনুভাব ও সঞ্চারী তথা ব্যভিচারী ভাব।

১। স্থায়িভাব : রতি হাস-আদি নয়টি প্রধান ভাবের কথা পূর্বেই বলা হয়েছে। রস-সৃষ্টির প্রধান উপাদান-রূপে বিবেচিত এই নয়টি ভাবকেই ‘স্থায়িভাব’ বলা হয়; এদের সহায়তায় যথাক্রমে শৃঙ্গার, হাস্য-আদি রস সৃষ্টি হয়ে থাকে। বিশ্বনাথ ‘সাহিত্যদর্পণে’ স্থায়িভাবের সংজ্ঞা দান করেছেন—

‘অবিরুদ্ধা বিরুদ্ধা বা যং তিরোধাতুসক্ষমাঃ

আস্বাদাঙ্কুর কল্লোহসৌ ভাব, স্থায়ীতি সম্মতা।।

—‘আস্বাদকে যদি অঙ্কুর বলা হয় তবে স্থায়িভাবকে বলা চলে তার কন্দ বা মূল, বিরুদ্ধ বা অবিরুদ্ধ যাই হোক, কোনভাবই তাকে তিরোহিত করতে পারে না।

২। বিভাব : ‘সাহিত্যদর্পণ’কার বিশ্বনাথ ‘বিভাব’-এর পরিচয় দিয়েছেন এভাবে—’রত্যাদ্যবোধকাঃ লোকে বিভাবা কাব্যনাট্যয়োঃ’—অর্থাৎ লৌকিক জগতে যা রতি-হাস-শোক-আদি ভাবের উদ্বোধন ঘটায়, কাব্যে ও নাটকে তাকেই বলা হয় ‘বিভাব’। সাহিত্যদর্পণে বিভাবের যে দৃষ্টান্তটি উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে সীতা তার রূপ-গুণাদি রামচন্দ্রের মনে যে রতি-হাস্যাদি ভাবের উদ্বোধনের কারণ, তা-ই কাব্যে নিবেশিত হয়ে ‘বিভাব’ নাম ধারণ করে। অর্থাৎ লৌকিক বা বাহ্যজগতে যাকে ‘কারণ’ বলে অভিহিত করা হয়, কাব্যজগতে তারি নাম ‘‘বিভাব’। আচার্য অভিনব গুপ্ত অবশ্য বলেন, লৌকিক জ্ঞানের উপায়কে বলে ‘কারণ’ এবং বিশিষ্ট জ্ঞানের উপায়ই ‘বিভাব’—’বিভাবো বিজ্ঞানার্থঃ লোকে কারণমেব অভিধীয়তে, ন বিভাবঃ।’ বিভাব দ্বিবিধ—(ক) আলম্বন বিভাব ও (খ) উদ্দীপন বিভাব।

(ক) আলম্বন বিভাব : যে বিষয়বস্তুকে মুখ্যভাবে অবলম্বন করে রসবস্তুর উদ্‌গম ঘটে, তাকে বলা হয় ‘আলম্বন বিভাব’। “শকুত্তলা’ নাটকে দুষ্মন্ত-শকুন্তলাকে অবলম্বন করেই নাটকের যে স্থায়িভাব ‘রতি’, ‘তার প্রকাশ ঘটেছে। অতএব ‘দুষ্মন্ত-শকুন্তলা’ নাটকের আলম্বন বিভাব। শৃঙ্গার রসের উদ্বোধনে নায়ক-নায়িকা সাধারণতঃ একে অপরের আলম্বন বিভাব হয়। বৈয়ব পদাবলীতে কামিনী-দর্শনে শ্রীকৃষ্ণের উক্তি:

‘আজি মঝু শুভদিন ভেলা।

কামিনী পেখনু সিনানক বেলা।।’

এখানে ‘কামিনী’ (রাধা) আলম্বন বিভাব।

(খ) উদ্দীপন বিভাব : যে সমস্ত বিষয় রসকে উদ্দীপ্ত করে, তাকে বলা হয় ‘উদ্দীপন বিভাব’। আলম্বন বিভাবে রসের অঙ্কুর-উদ্‌গম ঘটে, উদ্দীপন বিভাব তাকে স্ফুটতর করে, অতএব উদ্দীপন বিভাব রসোগমের মুখ্য কারণ। চন্দ্র-চন্দন-কোকিলা-লাপ-ঝঙ্কার কিংবা রূপ-অলঙ্কারাদি উদ্দীপন বিভাবের কাজ করে। যেমন—

“কালি মধুযামিনীতে জ্যোৎস্না নিশীথে 

কুণ্ঠকাননে সুখে,

ফেনিলোচ্ছল যৌবনসুরা ধরেছি তোমার মুখে।”

—এখানে ‘মধুযামিনী’, ‘জ্যোৎস্না নিশীথ’ প্রভৃতি উদ্দীপন বিভাব-রূপে শৃঙ্গার রস-সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে।

দার্শনিক-প্রবর অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত তাঁর ‘কাব্যবিচার’ গ্রন্থে বিভাবের দুটি ভাগের পরিচয় দিয়ে লিখেছেন—“যে বস্তুকে অবলম্বন করিয়া রস উৎপন্ন হয় এবং পারিপার্শ্বিক সমস্ত অবস্থা রসোগারের প্রতি অনুকূল হয়, তাহাকে যথাক্রমে আলম্বন ও উদ্দীপন বিভাব কহে। ইংরেজীতে বলিতে গেলে আমরা বলিব যে ইহারা রসের objective condition “

৩। অনুভাব : ‘সাহিত্যদর্পণ’কার বিশ্বনাথ কবিরাজ ‘অনুভাব’-এর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন :

‘উদ্বুদ্ধং কারণৈ’ স্বৈঃ স্বৈবহির্ভাবং প্রকাশয়ন্।

লোকে যঃ কার্যরূপঃ সোহনুভাব, কাব্যনাট্যয়োঃ।

—অর্থাৎ ‘মনে ভাব উদ্বুদ্ধ হলে, যে-সব স্বাভাবিক বিকার ও উপায়ে তা বাইরে প্রকাশ হয়, ভাবরূপ কারণের সেই সব লৌকিক কার্য কাব্য ও নাটকের অনুভাব।’ ব্যবহারিক জগতে যে কোনো ভাবের উদয়েই শরীরে বিকার দেখা দেয়—শোকে অশ্রুপাত, আনন্দে হাস্য প্রভৃতি, এগুলি লৌকিক ‘অনুভাব’, কাব্যে এগুলিই অলৌকিকত্ব লাভ করে। স্থূলকথা, ‘বিভাবা যেন কারণ এবং সেই কারণের কার্য বা ক্রিয়াই হলো ‘অনুভাব’। ‘রতি-হাস’-আদি ভাবের ‘অনুভাব’-রূপে আটটি সাত্ত্বিক ভাব দেখা দিতে পারে, এগুলিস্তম্ভ, স্বেদ, রোমাঞ্চ, স্বরভঙ্গ, বেপথু, বৈবর্ণ, অশ্রু ও প্রলয়। অনুভাবের দৃষ্টান্ত—

‘দ্বিধায় জড়িত পদে কম্প্রবক্ষে নম্র নেত্রপাতে

স্মিতহাস্যে নাহি চল সলজ্জিত বাসরশয্যাতে 

স্তব্ধ অর্ধরাতে।’

এখানে ‘মিলনমধুর লজ্জা’র ভাবটি প্রকাশিত হয়েছে যে কয়টি লক্ষণের মাধ্যমে, সেগুলিই অনুভাব—’দ্বিধায় জড়িত পদ’, ‘কম্প্ৰবক্ষ’, ‘নম্ৰনেত্রপাত’, ‘স্মিতহাস্য’ এবং ‘সলজ্জিত’ গমন। অথবা নিম্নোক্ত উদাহরণটিতে—

‘বিরহিণী তার নত আঁখি, ছলছলি

নীপ অঞ্জলি রচে বসি গৃহকোণে

ঢেলে ঢেলে দেয় তোমারে স্মরিয়া মনে,

ঢেলে দেয় ব্যাকুলতা।

—এখানে ‘গৃহকোণে বসে’, ‘আঁখি ছলছলি’, ‘নীপ অঞ্জলি’ রচনার মধ্য দিয়ে বিরহিণীর বিরহজনিত ব্যাকুলতার প্রকাশ ঘটেছে বলেই এগুলি ‘অনুভাব’-রূপে স্বীকৃত। ‘অনুভাব’-এর সংজ্ঞা দিয়েছেন অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত : “শারীরিক অঙ্গ-বিক্ষোপাদি দ্বারাই শৃঙ্গারাদি বিবিধ মনোভাব স্ফুট হইতে পারে। ইংরাজীতে বলিতে গেলে এইগুলিকে emotion-এর expression বলা যাইতে পারে। expression ছাড়া কোন emotion-ই স্ফূর্তিলাভ করিতে পারে না। এই expression-কেই অনুভাব কহে।”

কাব্যনির্মাণ কৌশলের ব্যাপারে বিভাব এবং অনুভাবের অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রাচীন আলঙ্কারিকগণও স্বীকার করেছেন যে, লৌকিক স্থায়িভাব অপর সঞ্চারী ভাবের সহযোগিতায় এবং বিভাব ও অনুভাবের মাধ্যমে অলৌকিক রসমূর্তি পরিগ্রহ করেই কাব্যাকার ধারণ করে। এখন এই বিভাব এবং অনুভাবকে বলা হয়েছে সমবাদী অর্থাৎ এরা কখনো ব্যক্তির নিজস্ব অভিজ্ঞতায় সীমাবদ্ধ না থেকে সামাজিক তথা রসঞ্জ পাঠকের মনকেও সমভাবে অধিকার করতে পারে। এবং কারণেই স্থায়িভাব—যাকে রসের মূলীভূত কারণ বলে গ্রহণ করা হয়, তা লৌকিক হওয়া সত্ত্বেও বিভাব এবং অনুভাবের আনুকূল্যেই তা অলৌকিক রসে পরিণত হতে পারে। প্রাবন্ধিকও বলেছেন যে লৌকিক ভাব ব্যক্তি-হৃদয়ে আবদ্ধ থাকে বলেই তা সামাজিক অর্থাৎ রসজ্ঞ পাঠকের হৃদয়ের বস্তু হতে পারে না। পক্ষান্তরে বিভাব এবং অনুভাব সকল হৃদয়ে সমবাদী বলেই তা সামাজিক হয়ে ওঠে এবং লৌকিক ভাবের রসমূর্তিও তারাই। প্রেমিকের হৃদয়ে আবদ্ধ ব্যক্তিগত প্রেম রস নয়। তা পরিমিত এবং সীমাবদ্ধ। কিন্তু এই পরিমিত লৌকিক ভাবই কবি-প্রতিভার স্পর্শে ‘সকল সহৃদয় সংবাদী’ অলৌকিক রসমূর্তিতে রূপান্তরিত হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় একটি বড় ভূমিকা গ্রহণ করে বিভাব এবং অনুভাব। কাব্যের বিভাব এবং অনুভাবের মধ্যে ‘সাধারণীকৃতি’ নামে এমন একটি ব্যাপার রয়েছে, যার ফলে ব্যক্তিগত ভাবনা বা অনুভূতিও সাধারণের হয়ে দাঁড়ায়। এই সাধারণীকৃতিকে একজাতীয় সর্বসাধারণ প্রতীতি বলে মেনে নেওয়া চলে। ইংরেজি সাহিত্যেও একটি universal ideal content বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিভাব ও অনুভাব সকল হৃদয়ে সমবাদী, তার এই সার্বজনীন সমবেদনার সামর্থ্যের গুণেই লৌকিক ভাব অলৌকিক রসমূর্তি ধারণ করে এবং কবির কাব্য পাঠে রসজ্ঞ পাঠক অপার আনন্দ অনুভব করেন। অধ্যাপক সুশীলকুমার দে এ বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করেছেন : “By universal sympathy on feeling we become part and parcel of the same feeling and imagine ourselves in the condition. Thus the feeling raised to a state of relish, called rasa, in which has the essence of poetic enjoyment.”

৪। সঞ্ঝারী ভাব : মানুষের মনে অসংখ্য ভাবের উদয়-বিলয় ঘটে, এদের মধ্যে রতি-হাসি-শোকাদি কতকগুলি ভাব ‘স্থির’ বা চিরন্তন, আলঙ্কারিকগণ এদের বলেন ‘স্থায়িভাব’ এবং এদের সংখ্যা নির্দেশ করেছেন আটটি অথবা নয়টি। কিন্তু এগুলি ছাড়াও অনেকানেক ভাব স্থায়িভাবের অভিমুখে সঞ্চরণ করে, এই ভাবগুলিকে বলা হয় ‘সঞ্চারী ভাব’ বা ‘ব্যভিচারী ভাব’। আলঙ্কারিকগণ সঞ্চারী ভাবের সংখ্যা বলেছেন তেত্রিশ, এদের মধ্যে রয়েছে—’নির্বেদ, আবেগ, দৈন্য, জড়তা, উগ্রতা, অলসতা, বিষাদ, চিন্তা, বিতর্ক’ প্রভৃতি। তবে এই তেত্রিশটির বাইরেও ভাবের অস্তিত্ব অস্বীকৃত নয়। এইসব ভাবের কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব থাকে না, মনে স্থায়ি ভাবের সম্পর্কেই এদের যাতায়াত এবং এই উপায়ে মনকে স্থায়িভাবের অভিমুখে চালিত করে—এই কারণেই এদের ‘ব্যভিচারী’ বা ‘সঞ্চারী’ নামে অভিহিত করা হয়।

স্থায়িভাবের সঙ্গে সারীভাবের সম্পর্কটি বুঝিয়ে দেবার জন্য শারদা-তনয় তার ‘ভাবপ্রকাশন’ গ্রন্থে সুন্দর একটি উপমার সহায়তা গ্রহণ করেছেন—

‘উন্নজ্জত্তো নিমজ্জন্তঃ কল্লোলাশ্চ যথার্ণবে। 

তস্যোৎকর্ষং বিতন্বত্তি যান্তি তদ্রূপতামপি।

স্থায়িন্যুন্নগ্ননির্মগ্নাস্তথৈব ব্যভিচারিণঃ।

পুরান্তি স্থায়িনং স্বাংশ্চ তত্র যান্তি রসাত্মতাম্।’

অর্থাৎ কল্লোল যেমন বারংবার সমুদ্র থেকে উত্থিত হয়ে আবার সমুদ্রেই নিমজ্জিত হয়ে সমুদ্রের উৎকর্ষ বাড়িয়ে দিয়ে তদ্রূপতা লাভ করে অর্থাৎ সাগরের রূপেই রূপময় হয়, ব্যভিচারী ভাবসমূহও তেমনি স্থায়িভাবের সমুদ্রে জাত হয়ে তাতেই বারবার বিলীন হয়ে স্থায়িভাবের পোষণ করে এবং রসাত্মতা লাভ করে। কবিরাজ বিশ্বনাথও ‘ব্যভিচারী ভাব’ সম্বন্ধে একই উপমা ব্যবহার করে বলেছেন যে, তা স্থায়িভাবে একবার উঠছে একবার ডুবছে। সকল রসেই এরা সঞ্চরণ করতে পারে বলেও কেউ কেউ ‘সঞ্চারী’ নামের ব্যাখ্যা করে থাকেন। সঞ্চারীভাবের কার্যপ্রণালী-বিষয়ে অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত লিখেছেন, “যদিচ ব্যভিচারী ভাবগুলি স্থায়িভাবের সহিত সর্বদা যুক্ত থাকে না তথাপি সুপক্ক ব্যনাদিতে যেমন একই মূল আস্বাদ থাকে ও অন্যান্য প্রকারের আস্বাদ তাহার সহিত জড়িত হইয়া থাকে, তেমনি স্থায়িরূপে যে মূল রসই থাকুক, তাহার সহিত ব্যভিচার যুক্ত হইয়া তাহাকে নানা আস্বাদে সবলিত করিয়া তোলে।”

স্থায়িভাবের এই আধিপত্য এবং সঞ্চারীভাবের এই পরনির্ভরতার উপর ভিত্তি করেই অনেকে সঞ্জারীর স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকার করেন না। তাঁরা মনে করেন যে ‘কাব্যে সঞ্চারীভাবের স্বতন্ত্র রসমূর্তি নেই।’ বিভিন্ন সঞ্চারী রসের আস্বাদ্যমানতা স্থায়িভাবের পরিণতি শৃঙ্গার-হাস্যাদি নয়টি রসকেই নানারকমে পরিপুষ্টি দান করে। এই নবরসের রসত্ব অনেকটা পরিমাণেই সঞ্ঝারীর আস্বাদ্যমানতার উপর নির্ভরশীল, তৎসত্ত্বেও স্বাতন্ত্র্যের অভাবে সঞ্চারী ভাবের পরিণতিকে আলঙ্কারিকগণ রসের মর্যাদা দিতে স্বীকৃত নন। অভিনব গুপ্ত স্থায়িভাবের পরিণতিকেই শুধু রস বলে স্বীকার করেন কিন্তু তাকে অঙ্গীরস এবং সঞ্চারীকে আবার অঙ্গরসের পৃথক স্বীকৃতি দেন নি। অধিকাংশ আলঙ্কারিক এই অভিমত মেনে নিয়েছেন বলেই সঞ্চারীভাবের স্বতন্ত্র রসমূর্তি অস্বীকৃত।

সঞ্ঝারীভাব একক প্রচেষ্টায় কাব্যে রসসৃষ্টিতে সমর্থ নয়, কিন্তু স্থায়ি রসের রসত্ব অনেকটাই নির্ভর করে সঞ্চারীর আস্বাদ্যমানতার উপর—আলঙ্কারিকদের এই অভিমতটি সাধারণভাবে গৃহীত হলেও অনেকেই আবার সঞ্চারী রসের পৃথক্ অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। কারণ, তাঁরা দেখিয়েছেন যে এক প্রবন্ধে অবস্থিত নানা রসের মধ্যে যখন একটি রস প্রধান হয়ে ওঠে, তখন স্থায়িভাবের পরিণতি অপর রসগুলি তার পরিপোষক বা সঞ্চারী রসের কাজ করে। অতএব, ‘ধ্বন্যালোকে’ বর্ণিত ‘রস্যে রসাত্তরস্য ব্যভিচারী ভবতি’ অর্থাৎ “এক রস অপর রসের ব্যভিচারীর কাজ করে’—এই মতে ব্যভিচারী বা সঞ্চারীরও রসসৃষ্টির ক্ষমতা স্বীকৃত হয়েছে। সঞ্ঝারীর এই ব্যাপক ক্ষমতাদর্শনেই অনেক আলঙ্কারিক মন্তব্য করে থাকেন যে ‘সঞ্ঝারী দিয়ে পরিপুষ্ট না হলে রসের রসত্বই হয় না।

যাঁরা এই জাতীয় অভিমত পোষণ করেন, তাঁদের মধ্যে ভাগুরি অন্যতম। তিনি স্থায়ী এবং সঞ্ঝারীর ভেদকে স্বীকার করেন এবং অপরেরাও এই ভেদের আপেক্ষিকত্ব স্বীকার করেন। স্থায়িভাবের পরিণতি কোনো রস অপর কোনো প্রধান রসের পরিপোষক হয়ে যে সঞ্চারীর কাজ করে, কাব্যে-সাহিত্যে তারও যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে স্থায়ি রসগুলির একটি প্রধান এবং অপর রসগুলি সঞ্চারী। মহাভারতে বর্ণিত একটি কাহিনী-অংশের বর্ণনায় দেখা যায়, পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের পর শ্রীকৃয়কে দূতরূপে ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধনের নিকট পাঠানোর কথা হচ্ছে। তখন দ্রৌপদীর কিছু বর্ণনা এবং উক্তি মহাভারতে বিবৃত হয়েছে। তার রস-বিশ্লেষণ দেখা যায়—এই অংশটি নানারস নিবদ্ধ, কিন্তু প্রধান রস ক্রোধ ‘রৌদ্র’। মহাকবির প্রতিভা দ্রৌপদীর ক্রোধকে অপূর্ব রসমূর্তি দান করেছে। আবার দুটি স্থায়িরস ‘বীর’ ও ‘করুণ’ এবং কয়েকটি ‘ব্যভিচারী’ রস—’বিষাদ, গর্ব ও দৈন্য’ রৌদ্ররসকে অপূর্ব বর্ণাচ্ছটায় উদ্ভাসিত করে তুলেছে। সর্বোপরি, রৌদ্র, বীর ও করুণ রসে অন্তরাল থেকে মধুর বা শৃঙ্কার রসের বিভাব সমস্ত রসের উপর একটা মাধুর্যের রশ্মিপাত করেছে। এর ফলে সব মিলিয়ে মহাভারতের এই অংশটি কাব্যশ্রীমণ্ডিত হয়ে উঠেছে।

অতএব কাব্য-বিচারে ভাব, বিভাব, অনুভাব এবং সঞ্চারীভাব কোনোটিই উপেক্ষণীয় নয়। সকলের সমবেত প্রচেষ্টার ফলেই লৌকিক ভাব অলৌকিক রসরূপ ধারণ করে। রসনিষ্পত্তি বিষয়ে ‘সাহিত্যদর্পণ’কার কবিরাজ বিশ্বনাথের অভিমত সর্বথা গ্রহণযোগ্য—’বিভাবানুভাবেন ব্যক্তঃ সঞ্চারিণা তথা। রসাতামেতি রত্যাদিঃ স্থায়ী ভাবঃ সচেতসাম্।’—অর্থাৎ ‘চিত্তের রতি প্রভৃতি স্থায়িভাব, বিভাব, অনুভাব ও সঞ্ঝারীর সহযোগে রূপান্তর প্রাপ্ত হয়ে রসে পরিণত হয়।’ লৌকিক ভাব কীভাবে অলৌকিক রসে পরিণত হয় তার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন আচার্য অভিনব গুপ্ত ঃ “ক্রৌঞ হননের ফলে উদ্ভূত সেই শোক নামক স্থায়িভাব, তাদৃশ বিভাব এবং তা থেকে জাত ক্রন্দন প্রভৃতি অনুভাব-হেতু উভয় হৃদয়ের একরূপতা এবং ক্রমানুযায়ী আস্বাদ্যমান হয়ে করুণ রসে পরিণত হয়।” লৌকিক ভাব কীভাবে অলৌকিক রসে পরিণত হয় তার দৃষ্টান্ত উল্লেখ করেছেন আচার্য অভিনব গুপ্ত : “ক্রৌঞ্চ হননের ফলে উদ্ভূত সেই শোক নামক স্থায়িভাব, তাদৃশ বিভাব এবং তা থেকে জাত কুন্দন প্রভৃতি অনুভাব-হেতু উভয় হৃদয়ের একরুপতা এবং ক্রমানুযায়ী আস্বাদ্যমান হয়ে করুণ রসে পরিণত হলো।” এখানে লৌকিক শোক উপযুক্ত বিভাব (প্রিয় থেকে বিভিন্ন ক্রৌী), অনুভাব (ক্রৌঞ্ঝীর ক্রন্দন), সঞ্চারী (মুনির বিষাদ, আবেগ) প্রভৃতি সহযোগে সাধারণীকৃত হয়ে (একরূপতা ও তন্ময়ীভবন) অলৌকিক করুণ রসে মুনি-হৃদয়কে পূর্ণ করেছে এবং সেই আস্বাদনযোগ্য কাব্যরস বা ‘মা নিষাদ’ শ্লোকরূপে উচ্চারিত হয়েছে।