মূলত যে উপন্যাসে ‘প্লট’ বা আখ্যান ভাগ এবং বাস্তবধর্মিতা থেকে ঔপন্যাসিকের কবি দৃষ্টির লালিত্য ও ভাষার কাব্য মাধুর্য বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে তাকে কাব্যধর্মী উপন্যাস বলে। বস্তুত ইংরেজিতে যাকে ‘রােমান্স’ বলা হয়, কাব্যধর্মী উপন্যাস তার সমগােত্রীয়। বাস্তব জীবনের প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্ব সংঘাতের বদলে নিঃসঙ্গ ব্যক্তি মানসের অন্তরঙ্গ নির্জনতা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংশয় কাব্যধর্মী উপন্যাসের বিষয়—মানবজীবনের রহস্যলােকের সুপ্ত সংবেদনগুলি কাব্যময় ভাষায় উন্মােচন করা কাব্যধর্মী উপন্যাসের লক্ষণরূপে বিবেচ্য। উপন্যাসের কোনাে ঘটনা বা চরিত্র ব্যাখ্যানেই হােক বা অন্যান্য বর্ণনার প্রয়ােজনেই হােক, ভাষার গৃঢ় ইঙ্গিতময়তা ছাড়া কাব্যধর্মী উপন্যাসের সার্থকতা অসম্ভব। এরই নিরিখে রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসখানি বিচার্য।
রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসখানিকে বলা হয় ‘চরম কাব্যোপন্যাস’। প্রথাবদ্ধ যান্ত্রিক জীবনের মাঝে এই বিচিত্র ছন্দোময়, চমকপ্রদ প্রণয়লীলা যেভাবে কাব্যমণ্ডিত ভাষায় রবীন্দ্রনাথ বিদ্যুতের গগনবিস্তারী আকস্মিক সৌন্দর্যের মতাে প্রকাশ করেছেন তার তুলনা বাংলা সাহিত্যে বিরল। কেতাদুরস্ত কল্পনাবিলাসী অমিত-অমিট রে আর বিদুষী তরুণী লাবণ্যের প্রেমকাহিনি ‘শেষের কবিতা’। অমিত তার নিয়ত পরিবর্তনশীল কল্পনা ও আদর্শের চঞ্চলতা এবং অবিরাম গতিবেগের দ্বারা লাবণ্যকে অধিকার করতে চেয়েছে। লাবণ্য কিন্তু ‘রােমান্সের পরমহংস’ অমিতকে ভালােবেসেও বিয়ে করেছে শােভনলালকে। অমিত গৃহিণী করেছে ধনী দুহিতা কেটিকে। লাবণ্য থেকে গেছে তার মানসী প্রতিমারূপে। এই উপন্যাসে অমিত ও লাবণ্যের হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতি ব্যস্ত হয়েছে কবিতার ভাষায় ; কল্পনা শক্তির প্রাচুর্য ও এপিগ্রাম সমৃদ্ধ বাচনিক তীব্রতায় যা কাব্য হয়ে উঠেছে।
এ উপন্যাসের প্রতিটি শব্দ যেন কবিতার মতাে অসীমের বাণীরূপ। উপন্যাসের শেষে লাবণ্যকে বলা অমিতের এই কথাগুলাে বড়াে চমক সৃষ্টি করে- “একদিন আমার সমস্ত ডানা মেলে পেয়েছিলুম আমার ওড়ার আকাশ, আজ আমি পেয়েছি আমার ছােট্ট বাসা, ডানা গুটিয়ে বসেছি, কিন্তু আমার আকাশও রইল…ভালােবাসার সত্যকে আমি একই শক্তিতে জলেস্থলে উপলব্ধি করবাে ; আবার আকাশেও। নদীর তীরে রইল আমার পাকা দখল ; আবার মানসের দিকে যখন যাত্রা করবাে, সেটা হবে আকাশের ফাঁকা রাস্তা।”
এ উক্তি গদ্যকাব্যের স্পর্শ পেয়েছে। এ ছাড়া সারা উপন্যাসেই ছড়িয়ে আছে বাংলা ও ইংরেজি কবিতার উদ্ধৃতি। যেমন—For God Shake, hold your tungh and let me love, কবি এই বাণীকে অনুবাদ করলেন-
“দোহাই তােদের একটুকু চুপ কর।
ভালােবাসিবারে দে মােরে অবসর।”
‘রােমান্সের পরমহংস’ অমিতের মুখ দিয়ে লেখক এই বাণী উচ্চারণ করলেন। কিন্তু লাবণ্যের প্রতি অমিতের নিবেদিত প্রেম কতখানি নিখাদ তা আমাদের বড়ো ভাবায়।
‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে উচ্চাঙ্গের কল্পনাশক্তির প্রাচুর্যের সমৃদ্ধি বড়াে বিস্ময়কর। জীবনে প্রেমের প্রথম আবির্ভাবে যে উন্মাদনার সৃষ্টি করে নবনব কল্পনা জালে মনপ্রাণ ভরে ওঠে, কবিত্বে ভর করে যে জীবন এগিয়ে চলতে থাকে, শেষের কবিতা তারই ধ্বজাধারী। অমিত লাবণ্যের ভিতর দিয়ে প্রেমের অসীমতার মানস সন্ধান পেয়ে তারই প্রেমকে সীমাবদ্ধ, প্রাত্যহিক ভালােবাসার সংকীর্ণতা সন্তুষ্টচিত্তে স্বীকার করে নিয়েছে। নূতন প্রেমের আলােকেই লাবণ্য তার আসল প্রণয়ীকে চিনে নিয়েছে, শােভনলালের কাছে সে যে নিজেকে সঁপে দিয়েছে তা অমিতের কাছ থেকে প্রেরণা স্বরূপ পাওয়া। মূলত লাবণ্য ‘স্বভাব দরিদ্র’ অমিতের প্রেমের প্লবনেই তার দারিদ্র্য ঘুঁচে গিয়ে সে ঐশ্বর্যশালিনী হয়েছে। সে অমিতকে যা দিয়েছিল, অমিতেরই- “তোমারে যা দিয়েছিনু সে তােমারই দান। অমিত যত গ্রহণ করেছে লাবণ্য ততই ঋণী হয়েছে। তাইতাে শােভনলালের কাছে লাবণ্যকে চলে যেতে দেখে অমিতের শেষ স্বীকারােক্তি- “কেতকীর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ ভালােবাসারই, কিন্তু সােমেন ঘড়ায় তােলা জল, প্রতিদিন তুলবাে, প্রতিদিন ব্যবহার করবাে। আর লাবণ্যের সঙ্গে আমার যে ভালােবাসা সে রইল দীঘি, সে ঘরে আনবার নয়, আমার মন তাতে সাঁতার দেবে।” প্রেম সম্পর্কে অমিতের এক চমৎকার অভিব্যক্তি।
শেষের কবিতার মধ্যে কেবল প্রেমের আবেশ সৃষ্টি নয়, নয় ঘটনার ঘনঘটা, সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে কাব্যের সুরমাধুর্য। অমিত যখন লাবণ্যকে উপলক্ষ্য করে কবিতা আওড়াতে থাকে-
“ছাদের ওপরে বহিও নীরবে ওগাে দক্ষিণ হাওয়া,
প্রেয়সীর সাথে যে নিমেষে হবে চারি চক্ষুতে চাওয়া”
কিংবা-
“আমরা যাবাে যেখানে যায়নি নেয়ে সাহস করি,
ডুবি যদিতাে ডুবি-না কেন ডুবুক সবই ডুবুক তরি।।”
তখন সন্দেহ জাগে আমরা কোনাে উপন্যাস পাঠ করছি না, কোনাে কাব্যের জগতে বিচরণ করছি। শেষের কবিতার সারা অবয়ব জুড়ে এইভাবে কাব্যিক সুর লহরি সম্পাদিত হওয়ায় এটি কাব্য ধর্মী উপন্যাসের পদমর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
Leave a comment