“কাব্যদর্শনে যাঁরা দেহাত্মবাদী, তাঁরা বলেন, ঐ বাক্য অর্থাৎ শব্দ ও অর্থ ছাড়া কাব্যের আর স্বতন্ত্র আত্মা নেই।”

ক্রৌঞ্চমিথুনের বিয়োগ-ব্যথায় ব্যথিত হয়ে আদি-কবি বাল্মীকি অকস্মাৎ পাদবদ্ধ ছন্দ-তন্ত্রী-লয়যুক্ত শ্লোক উচ্চারণ করবার পর বিস্মিতচিত্তে নিজেই প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন ‘কিমিদং ব্যাহৃতং ময়া’। অর্থাৎ এখানেই প্রথম কাব্যের স্বরূপ বিষয়ে প্রথম জিজ্ঞাসা উচ্চারিত হয়েছিল। এরপর শতাব্দীর পর শতাব্দী বাহিত হয়ে চলেছে কাব্যের স্বরূপ-বিষয়ে, কাব্যের আত্মা-বিষয়ে নানা মতবাদ উপস্থাপিত হয়েছে, খণ্ডিত হয়েছে, কিন্তু এ বিষয়ে সর্ববাদীসম্মত কোনো শেষ-মীমাংসায় সম্ভবত আজো আমরা পৌঁছুতে পারিনি। তবে পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে একটার পর একটা স্তর অতিক্রম করে আমরা যে ক্রমশঃ কাব্যের আত্মার কাছাকাছি অন্ততঃ পৌঁছুতে পেরেছি, এ কথা নিশ্চয়ই অস্বীকার করা যায় না। তবে শুধু কাব্যের বহিরূপাদান অর্থাৎ দেহ নিয়েই।

প্রথম ভারতীয় আলঙ্কারিক ভরতমুনিই সর্বপ্রথম কাব্যের নির্মাণ-আদি অর্থাৎ দেহ, আত্মা ইত্যাদি বিষয়ে প্রায় চরম সত্যে উপনীত হবার কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। তিনি কাব্যকে একটি জৈববস্তু-রূপে কল্পনা করে তাকে একটি সর্বাঙ্গসমন্বিত বৃক্ষের সঙ্গে উপমিত করে বলেছেন

‘যথা বীজাদ ভবেন্দ্বক্ষো বৃক্ষাৎ পুষ্পং ফলং

তথা তথা মূলং রসাঃ সর্বে তেভ্যো ভাবা ব্যবস্থিতাঃ।”

বীজ থেকে যেমন বৃক্ষের উৎপত্তি, বৃক্ষ থেকে ফল-ফুলের উদ্ভব, তেমনি রস-বীজ থেকেই কাব্যের উৎপত্তি আর এই কাব্যের ফল পুষ্প (অর্থাৎ ভাব-অলঙ্কার প্রভৃতি) এই রসেরই স্ফূর্তি। এখানে আচার্য ভরত ‘রস’কেই কাব্যের মূলীভূত তত্ত্বরূপে স্বীকার করেও সৌন্দর্য-বিধায়ক গুণ-অলঙ্কার-রীতি প্রভৃতির উপযোগিতাকেও মেনে নিয়েছেন। কিন্তু রসের উপলব্ধি বড়ো কঠিন কর্ম বলেই সম্ভবতঃ পরবর্তীকালে অনেকেই, যাদের বলা চলে ‘দেহাত্মবাদী’ কাব্যদেহেই তার আত্মার সন্ধান করতে গিয়ে ‘রূপের পাথারে আঁখি’ ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা বুঝেছিলেন, রস-প্রতীতির জন্য যে রসাত্মক বাক্যের প্রয়োজন, তাতো কতকগুলি শব্দার্থময় পদমাত্র—এদের বাদ দিলে তো আর অসাধারণত্ব-হেতু রসের অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। এই বিচারেই সম্ভবতঃ সপ্তম শতাব্দীর আলঙ্কারিক আচার্য ভামহ বলেন ‘শব্দার্থে সহিতৌ কাব্যম্’। তিনি কাব্যে শব্দ ও অর্থের প্রাধান্য স্বীকার করে নিয়ে বস্তুতঃ প্রথম কাব্যে অলঙ্কারবাদের প্রবর্তন করেন। এরপর ‘কাবাদর্শ’-প্রণেতা আচার্য দণ্ডীও শব্দ ও অর্থ-প্রাধান্যের তথা অলঙ্কারবাদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন—’শরীরং তাবদিষ্টার্থ-ব্যবচ্ছিন্না পদাবলী’, অভীষ্ঠ অর্থযুক্ত পদসম্যুচ্চয়ই কাব্য। এমনকি, যে আচার্য বামন কাব্যদেহে অলঙ্কার ব্যতিরিক্ত অপর কোনো বস্তুর সন্ধান করেছিলেন যাকে কাব্যের আত্মারূপে গ্রহণ করা যায়, তিনিও প্রথম বলেছিলেন যে, ‘কাব্যং গ্রাহামলংকারাৎ’ অর্থাৎ অলঙ্কার গুণেই কাব্য গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে। লোকায়ত মতের অনুবর্তী দার্শনিক বা আলঙ্কারিকগণ, যাঁরা মানুষের দেহ ব্যতীত অপর কোনো সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী নন, সেই সব দেহাত্মবাদিগণও কাব্য-বিচারে এই কাব্যদেহ-নির্ভর অলঙ্কার বাদের সমর্থনে এগিয়ে এসে বলেন যে, কাব্যের আস্বাদন শব্দও অর্থের অলঙ্কারের আস্বাদন ছাড়া অপর কিছু নয়। বস্তুতঃ এই কারণেই পৃথিবীর বহু লেখকের রচনাই, যাতে অলঙ্কার ছাড়া আস্বাদনযোগ্য অপর কোনো গুণই নেই, সেগুলিও উৎকৃষ্ট কাব্য-রূপেই বিবেচিত হয়ে থাকে। লোকায়ত মতাবলম্বী না হয়েও রসবিমুখ বহু পাঠক অনুরূপ ভ্রান্তিতে পতিত হয়ে থাকেন।

কিন্তু শব্দ ও অর্থ দুটিই কাব্যদেহের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলেও, এদের যে কাব্যের আত্মা বলে স্বীকার করা চলে না, কাব্যরস-পিপাসু যে কোনো পাঠকই তা উপলব্ধি করেন। এইজন্যই অলঙ্কারবাদের অন্যতম প্রবক্তা স্বয়ং বামনও ‘অলঙ্কার’ শব্দটির নতুনতর ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করে বলেছেন, ‘সৌন্দর্যমলঙ্কারম্’ অর্থাৎ সৌন্দর্যই অলঙ্কার—তাহলে এখানে প্রচলিত অনুপ্রাসাদি শব্দালঙ্কার কিংবা উপমা-রূপকাদি অর্থালঙ্কার গ্রহণীয় নয়, অলঙ্কার হলো সৌন্দর্য। অতএব বামন এখানে প্রকারান্তরে কাব্যের বহিরঙ্গের প্রসাধক অলঙ্কারকে বর্জনই করলেন বলতে হয়।

বস্তুতঃ মনীষী সমালোচকগণ বহু উদাহরণ-সহযোগে প্রমাণ করেছেন যে, এমন অনেক অলঙ্কৃত রচনা রয়েছে, যেগুলি কাব্যরূপে বিবেচিত হবার স্বীকৃতি লাভ করেনি, পক্ষান্তরে অলঙ্কারবিহীন বহু রচনাই উৎকৃষ্ট কাব্যরূপে মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়েছে। কবিরাজ বিশ্বনাথ-রচিত ‘সাহিত্যদর্পণে’র একজন টীকাকার নিম্নোক্ত শ্লোকটি উদ্ধার করে দেখিয়েছেন যে এখানে শব্দে ও অর্থে অনুপ্রাস এবং রূপক অলঙ্কার রয়েছে, অথচ কেউ একে কাব্য বলে স্বীকার করে না

‘তরঙ্গনিকরোন্নীত তরুণীগণসকুলা। 

সরিদ্ বহতি কল্লোলবহব্যাহত তীরভূঃ।।’

আবার ‘সাহিত্যদর্পণ’ কার স্বয়ং কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যের যে বর্ণনা উদ্ধার করেছেন, সেখানে সামান্য অনুপ্রাস অলঙ্কারের আমেজ আছে মাত্র, কার্যতঃ একে নিরলঙ্কারই বলা চলে, কাব্যমাধুর্যে এটি পাঠকের হৃদয় হরণ করে নেয়। উদ্ধৃত শ্লোকটিতে অকাল বসন্তের অভ্যুদয় ভ্রমর-মৃগী-আদি তির্যক প্রাণীদের অনুরাগের লীলাটি একটু অভিব্যত্থিত হয়েছে মাত্র। শ্লোকটি এই

‘মধুদ্বিরেফ কুসুমৈকপাত্র পপৌ প্রিয়াং স্বামনুবর্তমানঃ।। 

শৃঙ্গেণ চ স্পর্শনিমীলিতাক্ষীং মৃগীমকভূয়ত কৃয়সারঃ।।

অলঙ্কারবাদীরা এখানে স্বভাবোক্তি অলঙ্কারের উপস্থিতির কথা বলতে পারেন, কিন্তু রূপ ও ক্রিয়ার স্বাভাবিক বর্ণনাকে অলঙ্কার নামে অভিহিত করা একটা অর্থহীন ব্যাপার মাত্র—এতে অলঙ্কারবাদীরা শুধু আত্মশ্লাঘাই লাভ করতে পারেন। অনুরূপ দৃষ্টান্ত বাংলা ভাষাতেও দুর্লভ নয়। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এরূপ অলঙ্কারবহুল বহু কবিতা রচনা করেছেন, যেগুলি কাব্যরসে সিক্ত হতে পারে নি

‘রবির কিরণ ছড়ায় তরল 

গোমেদ মাণিক মনঃশীলায়

ঘুমাল পাখির সুনীল পাখায়,

কুনাল পাখির আঁখির নীলায়।

এর পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশী’ কবিতার অংশবিশেষ উদ্ধার করলেই দেখা যাবে যে এর নিরলঙ্কৃত অংশও কাব্যসম্পদে কী অপূর্ব হয়ে উঠেছে—যে কোনো সনিষ্ট পাঠকই এ বিষয়ে অবহিত হতে পারেন—

‘ঘরেতে এলো না সে তো

মনে তার নিত্য আসা-যাওয়া,

পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর।

অতএব ‘কাব্যাং গ্রাহামলঙ্কারাৎ’ কিংবা ‘শব্দ ও অর্থ ছাড়া কাব্যের স্বতন্ত্র কোন আত্মা নেই’ এ জাতীয় অভিমত যারা পোষণ করেন, তাদের অভিমত সুধী সমাজে অগ্রাহ্য কাব্যরসপিপাসু পাঠক-সমালোচকগণ কাব্যরসের সন্ধানে দেহকে অতিক্রম করে তাঁরা আত্মার সান্নিধ্যে গিয়ে উপনীত হয়েছেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা চলে যে, ‘কাব্যং গ্রাহামলঙ্কারাং’ অভিমতের প্রবক্তা বামনও কিন্তু অলঙ্কারেই থেমে থাকেন নি। তিনি একদিকে যেমন সৌন্দর্যকেই অলঙ্কার বলে অভিহিত করেছেন, অন্যদিকে আবার আরও খানিক অগ্রসর হয়ে রীতিবাদে’ও উপনীত হয়েছেন। আবার কাব্য-বিষয়ে রসবাদের প্রবক্তা বিশ্বনাথ রসাত্মক বাক্যকেই কাব্য বলে অভিহিত করলেও ‘অলঙ্কার’ বা ‘রীতি’কে অগ্রাহ্য করেন নি। তিনি বলেন ‘উৎকর্ষহেতবঃ প্রোত্তাঃ গুণালঙ্কাররীতয়ঃ’ অর্থাৎ গুণ, অলঙ্কার, রীতি কাব্যের উৎকর্ষের হেতুরূপে বিবেচিত হয়।