প্রশ্নঃ কান্ট কীভাবে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করেন? সমালােচনাসহ ব্যাখ্যা কর।

অথবা, কান্ট কীভাবে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের সমন্বয়সাধন করেন? কান্টের এ মতবাদের তাৎপর্য আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ ইমানুয়েল কান্ট ছিলেন নতুন তত্ত্বকথার রচয়িতা। সতেরাে শতকের দর্শন চর্চার সূচনা হয় দু’টি বিপরীত মুখ্য চিন্তাধারার মাধ্যমে। এ দু’টি মতবাদ হলাে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ। কান্টের দর্শনের সমস্যা ছিল জ্ঞানবিষয়ক সমস্যা। তিনি উক্ত মতবাদ দুটির সমালােচনা করে এদেরকে পক্ষপাতদোষে দুষ্ট বলে অভিহিত করেন। এ দু’টি মতবাদের কোনাে একটিকে গ্রহণ না করে তিনি দু’টি মতবাদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করেন এবং একটি বিচারবাদী মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি জ্ঞানের উৎপত্তি বিষয়ক মতবাদ প্রসঙ্গের মানুষের মনের দু’টি উৎসের কথা বলেন। প্রথমটি ইন্দ্রিয়শক্তি আর দ্বিতীয়টি হলাে বুদ্ধি।

বুদ্ধিবাদঃ যে জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ অনুসারে বুদ্ধিই হলাে যথার্থ জ্ঞানের একমাত্র উৎস এবং সার্বিক, যথার্থ ও শুদ্ধ সত্তার জ্ঞান একমাত্র বুদ্ধির সাহায্যেই পাওয়া যায় তাকে বুদ্ধিবাদ বলে। বুদ্ধিবাদীদের মতে, আশা সক্রিয়। বুদ্ধি হলাে আত্মার স্বাভাবিক গুণ। মন নিজের আত্মার ধারণা থেকে সক্রিয়ভাবে জ্ঞান উৎপন্ন করে। বুদ্ধি আবার বিচারশক্তির সাহায্যে নিশ্চিত বা যথার্থ জ্ঞানকে অনিশ্চিত ও অযথার্থ জ্ঞান থেকে আলাদা করতে পারে। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান অসম্পূর্ণ এবং ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে পরিবর্তন হয়। কিন্তু প্রকৃত জ্ঞান শাশ্বত, ইন্দ্রিয় আমাদের যথার্থ ও শ্বাশ্বত জ্ঞান দিতে পারে না।

অভিজ্ঞতাবাদের সংজ্ঞাঃ অভিজ্ঞতাবাদ জ্ঞানের উৎপত্তি সংক্রান্ত এমন একটি মতবাদ, যা অভিজ্ঞতা বা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণকে জ্ঞানের একমাত্র উৎস বলে মনে করে। অভিজ্ঞতাবাদীদের মতানুসারে, সংবেদন ও অনুভূতি থেকে জ্ঞানের উৎপত্তি হয়। সংবেদনের মাধ্যমে আমরা বহির্জগতের জ্ঞান পাই। অনুভূতি বা অন্তর্দর্শনের মাধ্যমে আমরা নিজেদের মানসিক অবস্থাকে জানি। অভিজ্ঞতাবাসিরা আরাে বলেন, আমরা পঞ্চেন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বস্তুর যে জ্ঞান পাই, তা বাস্তবে আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে বস্তুর কোনাে অস্তিত্ব নেই। তারা এ জগতের বাইরে অন্য কোনাে জগতের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। অভিজ্ঞতাবাদ সম্পর্কে দার্শনিক Potric তার গ্রন্থে বলেন, Introduction to philosophy, Knowledge comes neither from sense for from season. We may say that it comes from experience.

বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের সমন্বয়ে কান্টের মতবাদঃ বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। জার্মান দার্শনিক কান্ট সর্বপ্রথম উপলব্ধি করলেন যে, জ্ঞানের ক্ষেত্রে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা উভয়েরই প্রয়ােজন। এভাবে তিনি যে মতবাদ প্রচার করেন তা “বিচারবাদ” নামে পরিচিত।

উল্লেখ্য যে, কান্ট প্রথম জীবনে বুদ্ধিবাদীদের মতের সাথে একমত পােষণ করেন; কিন্তু হিউমের দর্শনে এ ধারণার বিপরীত ধারণার সৃষ্টি হয়। কান্ট বলেন, “হিউম আমাকে নির্বাচারবাদী মােহ নিদ্রা থেকে জাগিয়ে তােলেন।” কান্টের মতে, বুদ্ধির সাহায্যে নতুন জ্ঞান পাওয়া যায় না, আবার অভিজ্ঞতার সাহায্যেও সার্বিক জ্ঞান পাওয়া যায় না। তাই তিনি বুদ্ধিবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদকে নির্বিচারবাদী মতবাদ বলে অভিহিত করেন এবং নিজের যুক্তির আলােকে এদেরকে সমন্বয়সাধন করে যথার্থ মতবাদ হিসাবে “বিচারবাদ” প্রবর্তন করেন।

কান্ট নিম্নোক্ত যুক্তির সাহায্যে বুদ্ধিবাদ এ অভিভজ্ঞতাবাদকে সমন্বয়ের চেষ্টা করেনঃ

(১) বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ উভয় চরম মতবাদঃ বিচারবাদী কান্ট বুদ্ধিবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদের সমালােচনা করে বলেন যে, বুদ্ধিবাদী ও অভিজ্ঞতাবাদ উভয় মতবাদই চরম একদেশদর্শী। কেননা, বুদ্ধিবাদারা বুদ্ধির সাহায্যে জ্ঞান প্রাপ্তির কথা বলেছেন। অপরদিকে অভিজ্ঞতাবাদীরা ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন। কিন্তু কান্টের মতে, জ্ঞান হচ্ছে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার যৌথ ফসল। তার মতে, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা উভয়ই জ্ঞানের জন্য দরকার হয়।

(২) বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ উভয়ই পরস্পর নির্ভরশীলঃ বুদ্ধি জ্ঞানের সার্বিকতা দিতে পারলেও নতুনত্ব দিতে পারে না। আবার, অভিজ্ঞতা জ্ঞানের নতুনত্ব দিতে পারলেও সার্বিকতা ও আবশ্যিকতা দিতে পারে না। তাই কান্ট এই উভয়ই মতবাদের সমালােচনা করে এবং এদের সমন্বয়সাধনের চেষ্টা করেন। এ সম্পর্কে এ. মতিন তার An outline of philosophy গ্রন্থে বলেন, “কান্টের তত্ত্বকে বিচারবাদ বলা হয়, কেননা এটি আমাদের বিচার বিশ্লেষণ ও জ্ঞানের ক্ষেত্রগুলাে থেকে সৃষ্টি হয়। একে সমন্বয়বাদও বলা হয়। কারণ তা বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে।”

(৩) জ্ঞানের দু’টি দিকঃ কান্টের মতে, জ্ঞানের দু’টি দিক আছে এক, আকার এবং দুই উপাদান। জ্ঞানের উপাদান আসে ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবেদন থেকে। আর উপাদানের জন্য যে আকার প্রয়ােজন হয় তা আসে বুদ্ধিজাত ধারণা থেকে। প্রকৃত বা যথার্থ জ্ঞানের জন্য এ দু’য়ের সমন্বয় প্রয়ােজন হয়।

(৪) বস্তুর দুটি দিকঃ কান্টের মতে, বস্তুর দু’টি দিক আছে। একটি হলাে একাত্মবাদ বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং অন্যটি অতীন্দ্রিয় সত্তার দিক। অতিন্দ্রিয় সত্তা বিশৃংখলা ও তাৎপর্যপূর্ণহীন সংবেদন সৃষ্টি করে। মন এ’সংবেদনকে দেশ কালের পরমার্থে স্থাপন করে জ্ঞানের উৎপত্তি ঘটায়।

(৫) মনের সব বৃত্তিই বস্তুর বহিষ্প্রকাশঃ কান্টের মতে, মনের সব বৃত্তিই বস্তুর প্রকাশমান দিকের ক্ষেত্রে প্রযােজ্য। অতীন্দ্রিয় সত্তার দিকে নয়। সুতরাং বস্তুর ইন্দ্রিয় সত্তাই জ্ঞেয় এবং অতীন্দ্রিয় সত্তা জ্ঞেয় বা অজ্ঞতা এভাবে কান্ট প্রমাণ করে যে, আমাদের প্রাপ্ত জ্ঞান দৃশ্যমান ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের জ্ঞান অতীন্দ্রিয় জগতের জ্ঞান নয়।

(৬) জ্ঞানের উৎসঃ কান্ট তার ‘Critique of pure reason’ গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেন যে, অভিজ্ঞতার পূর্বে আমাদের কোনাে জ্ঞান থাকে না। তা সত্ত্বেও তিনি বলেন যে, শুধু অভিজ্ঞতা দিয়েই জ্ঞান পাওয়া যায় না। জ্ঞানের ক্ষেত্রে সার্বিকতা বা অনিবার্যতা আনতে বুদ্ধিবাদের প্রয়ােজন হয়। কেননা জ্ঞানের সাবিকর্তা বা অনিবার্যতা অভিজ্ঞতাপূর্ব বা পুর্বতঃসিদ্ধ।

(৭) ইন্দ্রিয় সংবেদন ও বুদ্ধির সমন্বয়ঃ কান্ট বলেন, যখন আমাদের বুদ্ধি তার অভিজ্ঞতাপূর্ব জ্ঞানের আকারগুলাে ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষণে প্রাপ্ত সংবেদনের ওপর প্রয়ােগ করে সুবিন্যস্ত করতে সক্ষম হয়, তখনই জ্ঞানােৎপত্তি ঘটে। অর্থাৎ অভিজ্ঞতালব্ধ উপাদানসমূহ বুদ্ধিজাত আকারের সমন্বয়ে প্রকৃত জ্ঞান গঠিত হয়। এভাবেই কান্ট তার বিচারবাদ মতবাদের সাহায্যে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের মধ্যে সমন্বয়সাধন করেছেন।

সমালােচনাঃ কান্টের বিচারবাদ নির্বিচারবাদের তুলনায় উন্নত হলেও তা নানাভাবে সমালােচিত হয়েছে। নিম্নে এ মতবাদের ত্রুটিগুলাে উল্লেখ করা হলাে-

(১) জগতের ব্যবধান সঠিক নয়ঃ কান্টের মতে, ইন্দ্রিয় জগত ও অতীন্দ্রিয় জগতের মধ্যে একটা ব্যবধান রয়েছে। কিন্তু এটা সঠিক নয়। কেননা, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দৃশ্যমান জগতের মধ্যদিয়েই অতীন্দ্রিয় সত্তা নিজেকে প্রকাশ করেছেন।

(২) তত্ত্বালােচনা অসম্ভবঃ কান্টের মতে অতীন্দ্রিয় সত্তা অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় কিন্তু অস্তিত্বশীল এ কথা বলে কান্ট তার বিচারবাদকে অজ্ঞেয়বাদে পরিণত করেছেন। তাই এর গভীর আলােচনা অসম্ভব।

(৩) স্ববিরােধীঃ কান্টের বিচারবাদ স্ববিরােধী। অতীন্দ্রিয় সত্তা অজ্ঞাত হলে তাকে সংবেদনের কারণ হিসাবে কীভাবে জানা যায় কান্ট তার উল্লেখ করেন নি।

(৪) বিচারকদের পরিণাম দ্বৈতবাদঃ কান্ট ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সত্তা ও অতীন্দ্রিয় সত্তার মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে বিচারবাদকে দ্বৈতবাদের পরিণত হয়েছে।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা উভয়ের অবদানকে স্বীকার করে কান্ট বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের দ্বন্দ্ব নিরসনের চেষ্টা করেছেন। তবে বস্তুগত ও অতীন্দ্রিয় সত্তার জগতের মধ্যে পার্থক্য টেনে। তিনি তার মতবাদকে দ্বৈতবাদে পরিণত করেছেন। অতীন্দ্রিয় সত্তাকে অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় বলায় তার মতবাদ অজ্ঞেয়তাবাদে রূপ নিয়েছে। ফলে তিনি যে সমন্বয়ের চেষ্টা করেছেন তা পরিপূর্ণ হতে পারেনি।