প্রশ্নঃ কান্টের মতানুসারে একটি ইচ্ছাকে কখন নৈতিক দিক থেকে বিচার করা যায়? এ প্রসঙ্গে তার সদিচ্ছার ধারণা ব্যাখ্যা কর। 

অথবা, ইচ্ছা সম্পর্কে কান্টের ধারণা কি? কান্টের সদিচ্ছার ধারণাটি ব্যাখ্যা কর। 

অথবা, ইচ্ছা সম্পর্কে কান্টের ধারণা কি? কান্টের সদিচ্ছার ধারণাটি ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর। 

ভূমিকাঃ জার্মান দার্শনিক ইমান্যুয়েল কান্ট দর্শনের ইতিহাসে এক অনন্য নাম। তিনি জ্ঞান বিদ্যা, অধিবিদ্যা, ও মূল্যবিদ্যার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রেখেছেন। মূল্যবিদ্যার একটি রূপ হচ্ছে নীতিবিদ্যা। নীতি বিদ্যা হলো আচরণ সম্পর্কীয় বিজ্ঞান। নীতিবিদ্যা হলো জীবন ধারা বা চরিত্র ও বিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা। নীতবিদ্যার সঠিক অর্থ অনুধাবণের ক্ষেত্রে যে দুটো শব্দের অর্থ সম্পর্ক করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে আচরণ ও বিজ্ঞান। নীতি বিদ্যা হলো এমন ধরনের বিজ্ঞান যার লক্ষ্য হচ্ছে সত্যতাকে অর্জন করা।

ইচ্ছা সম্পর্কে কান্টের ধারণাঃ আমাদের মনে কোন অবস্থার কল্পনা জাগে তারপর যে বস্তু বা অবস্থাকে বাস্তবে পরিণত করার ইচ্ছায় আমরা কোন বিশিষ্ট ক্রিয়াতে প্রবৃত্ত হই। আমাদের ইচ্ছাশক্তি কোন বিষয়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে আমাদেরকে প্রবৃত্ত করে থাকে। আমি এখন একটি বই লেখার চেষ্টা করছি। যে বই লিখতে চেয়েছি তা বর্তমানে নাই। এই বই-এর কল্পনা দ্বারাই আমার ইচ্ছাশক্তি নিয়ন্ত্রিত হয়। বর্তমানে লেখার কাজে আমাকে প্রবৃত্ত করেছে। কোনো কাল্পনিক বিষয়ের সক্রিয় অভিমুখীনতা বা মনন প্রবৃত্তির নামই ইচ্ছা। আমরা সজ্ঞানে যা কিছু করি তার মূলেই ইচ্ছা বর্তমান। এ ইচ্ছা যে সবসময় চলে তা নয়। পাগলের কখন কি ইচ্ছা হয় বলা যায় না। তার ইচ্ছা কোনো নিয়মের অধীন নয়। কান্টের মতে, যখন আমাদের ইচ্ছা এই রকম কোনো নিয়মের বশবর্তী হয়ে চলে, তখনই তাকে মানুষের মত বুদ্ধিমান জীবের উপযুক্ত বলা যেতে পারে। এই রকম ইচ্ছাকে প্রজ্ঞাতন্ত্র বলা যায়। কেননা প্রজ্ঞা হতে আমরা নিয়ম পেতে পারি। যাই হোক কান্টের মতে নিয়মানুযায়ী তাই যুক্তিযুক্ত। আমাদের কাজকর্মে ও ইচ্ছায় আমরা একাধিক নিয়ম পালন করতে পারি। কোনো না কোনো নিয়মের অধীনে চললেই আমাদের ইচ্ছার যুক্তিযুক্ততা বর্তমান থাকবে। হতে পারে স্বাস্থ্য বজায় রাখা, সুবিধা পেলেই অর্থ উপার্জন করা এবং নিজে কষ্ট করে অন্যকে সুখি করা। কোন কাজ স্বাস্থ্যের ইচ্ছায় কোনো কাজ অর্থের ইচ্ছায় এবং কোনো কাজ অন্যের সুখের জন্য করতে পারে। আমাদের নৈতিক কাজ কর্ম কোনো নৈতিক নিয়মে নিয়ন্ত্রিত তা আবিষ্কার করাই কান্টের নীতিবিচারের উদ্দেশ্য।

কান্টের সদিচ্ছায় ধারণাঃ কান্ট বলেন, মানুষের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায় যে, তাদের মধ্যে অনেকগুলো বৃত্তি রয়েছে যার মধ্যে ইচ্ছা একটি অন্যতম প্রবৃত্তি। কান্টের মতে এই ইচ্ছা নামক প্রবৃত্তি বা কখনো নিজের দ্বারা পরিচালিত হয় না। নিচের কান্টের সদিচ্ছার ধারণা ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন করা হলো।

১. একমাত্র সদিচ্ছায় নিরপেক্ষ সৎ বস্তুঃ কান্টের মতে, যে ইচ্ছা আমাদের ফল লাভের আশায় কর্তব্যবোধ জাগ্রত করে তাই সদিচ্ছা। পৃথিবীতে একমাত্র সদিচ্ছাই নিরপেক্ষ ও সৎ বস্তু।

২. সদিচ্ছা সর্বদাই স্বাধীনঃ কান্টের মতে, ইচ্ছা যখন প্রবৃত্তির দ্বারা পরিচালিত না হয়ে কেবল বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়। তখন সে ইচ্ছাকেই বলা হয় সদিচ্ছা। সদিচ্ছা সর্বদাই স্বাধীন। এর গতিকে কোন কিছু রোধ করতে পারে না।

৩. সদিচ্ছা শর্তহীনভাবে সৎঃ কান্টের মতে, যে ইচ্ছা আমাদের ফল লাভের আশা ছাড়াই কোন কাজে গঠিত করে তাই সদিচ্ছায়। সদিচ্ছাকে সত্য হওয়ার কোন কিছুর উপর নির্ভরশীল হতে হয় না। সদিচ্ছা নিজেই সৎ।

৪. সদিচ্ছা নিজগুণেই সৎঃ কান্ট বলেন, এ জগতের ভিতরে বা বাইরে এমন কিছু চিন্তা করা যায় না, যা সদিচ্ছা নামক গুণ ছাড়া সৎ বলে অভিহিত হতে পারে। সদিচ্ছা বিনা সর্তেই সৎ।

৫. সদিচ্ছা বুদ্ধি ও কর্তব্য বোধ দ্বারা পরিচালিতঃ কান্টের মতে সদিচ্ছা বুদ্ধি ও কর্তব্য বোধ দ্বারা পরিচালিত। একজন বিক্রেতা যদি কর্তব্যের খাতিরে কর্তব্য করেন, অর্থাৎ কর্তব্যের খাতিরে ব্যবসার মূল নীতি পালনের উদ্দেশ্যে পরিমাপ ঠিক রাখে তাহলে অবশ্যই তার এই ইচ্ছাকে সদিচ্ছা বলে।

৬. সদিচ্ছা ও নৈতিক বাধ্যতাবোধঃ কান্টের মতে সদিচ্ছার সাথে নৈতিক বাধ্যবাধকতার কোন সূত্র রয়েছে। সদিচ্ছা ছাড়া কোনো কাজের নৈতিক মূল্য বিচার করা যায় না। উদাহরণ স্বরূপ, একজন পুলিশ অফিসারের ভাই আসামি বলে সে পুলিশ। অফিসারকে নৈতিক বাধ্যতাবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়ে তার ভাইকে আটক করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাকে দয়ামায়ার বন্ধন মুক্ত হতে হবে।

৭. সদিচ্ছা ও কর্তব্যঃ কান্টের মতে সদিচ্ছা ও কর্তব্যের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। যে ইচ্ছাকর্তব্য রক্ষার খাতিরে পরিচালিত হয়। সেই ইচ্ছার নৈতিক মূল্য রয়েছে। আর যে ইচ্ছা কর্তব্য রক্ষার খাতিরে পরিচালিত হয় তার কোনো মূল্য নেই। যে সব কাজ কর্তব্যের সাথে সংগতি রেখে করা হয় কান্ট সে সব কাজের মধ্যকার পার্থক্য দেখিয়েছেন উদাহরণস্বরূপ একজন ব্যবসায়ী যখন খরিদ্দারের উপর ন্যায় সঙ্গত দাম রাখেন তখন এ কাজটিকে দুইভাগে ভাগ করা যায় । প্রথমত কর্তব্যের খাতিরে কর্তব্য রক্ষা করা বলা যাবে। দ্বিতীয় কর্তব্যের সাথে সংগতিপূর্ণ বলা যাবে।

৮. সদিচ্ছা দ্বারা পরিচালিত কাজের উদ্দেশ্য সুখময়ঃ কান্ট বলেছেন, আমার একটা কাজের পিছনে যদি সদিচ্ছা থাকে তবে কাজটির নৈতিক মূল্য থাকবে। ব্যক্তির উচিত কর্তব্যের খাতিরে কর্তব্য করা। কান্ট মনে করেন সদিচ্ছা দ্বারা পরিচালিত হয়ে কোনো কাজ করলে জগতে পরম স্রষ্টা আমাদের পরম সুখ দেবেন আর আমরা কল্যাণলাভে সমর্থ্য হব।

সমালোচনাঃ কান্টের ধারণার ত্রুটিগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো-

১. কান্ট অনুভূতিকে আগ্রহ করেছেন এবং বিচার বুদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। কিন্তু সমালোচকরা বলেন অনুভূতিকে বাদ দিলে নৈতিক জীবন একটি শূন্য কাঠামো।

২. সমালোচকদের মতে কান্ট সদিচ্ছার ধারণাটিকে কোনো সুম্পষ্ট ব্যাখ্যা না দিয়ে শর্তহীন বলে ভালো বলেছেন। ধারণার অর্থ না বুঝে আমরা তা ব্যাখ্যা করতে পারি না।

৩. কান্টের মতে সদিচ্ছা একটি আন্ধারমূলক মতবাদ যার কোন উপাদান নেই। নীতি দার্শনিক জ্যাকোব কান্টের সদিচ্ছার ধারণাকে শূন্য ইচ্ছা বলে মনে করেন। যা কোন কিছুই ইচ্ছা করে না।

৪. সি. ভি. ব্রড কান্টের ধারণাকে সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন, শুধু সদিচ্ছাই নয় পৃথিবীতে এমন অনেক জিনিস আছে যেগুলো শর্তহীনভাবে ভালো হতে পারে। তার মতে জ্ঞান ও সদিচ্ছা মিলে স্বতভালো হয়। তাই সদিচ্ছা স্বতঃভালো নয় বরং তার একটা অংশ বিশেষ।

উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, কান্ট সদিচ্ছার ধারণার মধ্য দিয়ে নীতি দর্শনের এক বিপ্লব সাধন করেছেন। তার মতে সদিচ্ছা নিজেই সৎ। শর্তহীনভাবে সদিচ্ছা পরিচালিত হয়। তিনি মনে করেন শর্তহীনভাবে যে সদিচ্ছা পরিচালিত হয় তার নৈতিক মূল্য বিচার করা যায়। কারণ নৈতিক মূল্যের সাথে সদিচ্ছার ব্যাপক সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। কান্ট নৈতিক মূল্য বিচারের ক্ষেত্রে যে গুরুত্ব প্রদান করেন তার ভিত্তিটা তৈরি হয়েছে সদিচ্ছার ধারণার মধ্য দিয়ে।